সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
মোহাম্মদ তারেক
১৯৬৪ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উত্তাল সময়ে নতুন জীবন গড়তে একজন সাধারন মানুষ আব্দুর রাজ্জাক স্ত্রী ও শিশুসন্তান বাপ্পাকে নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন শূন্য হাতে। অমানুষিক জীবন সংগ্রামের পর সফল হয়ে নায়করাজ উপাধি পেয়েছেন, চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি হয়েছেন, এটা যে কারো কাছেই গল্প বলে মনে হতে পারে। মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। রাজ্জাক অসীম মনোবল, অমানুষিক পরিশ্রম আর মমতার মাধ্যমে ঠিক নিজের লক্ষ্যে পৌঁছেছেন। প্রমাণ করেছে সততা ও নিষ্ঠার মাধ্যমে জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়া যায়।
রাজ্জাকের জন্ম কলকাতার সিনেমা পাড়া টালিগঞ্জে। অর্থাৎ জন্মের পর থেকেই অভিনয়ের সঙ্গে সখ্যতা। মঞ্চের সঙ্গে জড়িত থাকলেও স্বপ্ন ছিল সিনেমাকে ঘিরে। টালিগঞ্জের সিনেমা শিল্পে তখন ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সৌমিত্র, বিশ্বজিৎদের যুগ। সেখানে রাজ্জাকের অভিনয় করার কোন সুযোগ পাবার সম্ভাবনাই ছিল না। এর মধ্যে শুরু হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এক সময় কলকাতায় থাকাটাই মুশকিল হয়ে পড়ে। তখন এক সুহৃদ রাজ্জাককে পরামর্শ দিলেন ঢাকায় চলে আসতে। বললেন, ঢাকার চলচ্চিত্র নতুন করে যাত্রা শুরু করেছে। এখানে এলে হয়তো কিছু একটা হবে।
ভদ্রলোক ঢাকার প্রথম চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ এর প্রযোজক, পরিচালকও অভিনেতা আব্দুল জব্বার খানের পরিচিত। তিনি রাজ্জাককে একটা চিঠি দিয়ে পাঠালেন তার কাছে। বলে দিলেন, ঢাকার কমলাপুরে থাকেন আব্দুল জব্বার খান। রাজ্জাক স্ত্রী-পুত্র নিয়ে ঢাকায় এসে কমলাপুরেই প্রথমে বাসা নেন। চিঠি নিয়ে যোগাযোগ করার পর জব্বার খান ইকবাল ফিল্মস লিমিটেড এ কাজ করার সুযোগ করে দেন রাজ্জাককে। সহকারী পরিচালকের কাজ। কামাল আহমেদের সহকারী পরিচালক হিসেবে তিনি প্রথম কাজ করেন ‘উজালা সিনেমাতে’। শুরু হলো ঢাকায় রাজ্জাকের চলচ্চিত্র জীবন। সহকারী পরিচালক হলেও অভিনয়ের নেশাটা মাথা থেকে কখনো সরেনা। এর মধ্যে ছোটখাটো চরিত্রে অভিনয় করেন বেশ কিছু ছবিতে। এসব ছবির মধ্যে ‘ডাকবাবু’, ‘১৩ নং ফেকু ওস্তাগার লেন’, ‘আখেরী স্টেশন’ উল্লেখযোগ্য। একসময় তিনি জহির রায়হানের সাথে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ভাগ্য খুলে যায় এখান থেকেই। হঠাৎ একদিন নায়ক হবার সুযোগ পেয়ে যান রাজ্জাক। লোক কাহিনী নিয়ে জহির রায়হান তখন ‘বেহুলা’ নির্মানের প্রস্ততি নিচ্ছেন। ‘বেহুলা’ হবেন সুচন্দা। কিন্তু লক্ষীন্দরের চরিত্রে কাউকেই তার পছন্দ হচ্ছে না। ওই সময়ে যারা একটু নামীদামী শিল্পী তারা প্রায় পুরো ছবিতেই কংকাল হয়ে শুয়ে থাকতে চাইলেন না। এমন সময় হঠাৎ একদিন জহির রায়হান বললেন, রাজ্জাক আপনিই আমার ছবির নায়ক। রাজ্জাকের চেহারার মধ্যে তখন কলকাতার রোমান্টিক ছবির নায়ক বিশ্বজিৎ এর ছায়া খুঁজে পেতেন অনেকে। যেই বলা সেই কাজ। রাজ্জাক হয়ে গেলেন বেহুলা ছবির নায়ক। সুযোগ পেয়ে রীতিমতো জ্বলে উঠলেবন রাজ্জাক। জহির রায়হানের সুনিপুন হাতের ছোঁয়ায় অসাধারণ এক লক্ষিন্দর হয়ে দর্শকদের সামনে উপস্থিত হলেন। সঙ্গে অপূর্ব সুন্দরী বেহুলারূপী সুচন্দা।
১৯৬৬ সালে মুক্তি পেল ‘বেহুলা’। ছবি সুপার হিট। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র পেল একজন নায়ক, যিনি পরবর্তী সময়ে এদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের অপরিহার্য নায়কে পরিনত হলেনা। ঢাকার সিনেমা হল গুলোতে তখন পাক-ভারতীয় ছবির দাপট। ভারতের রাজ কাপুর দিলীপ কুমার, নার্গিস, পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলী, জেবা, সুধির শামীম আরা, ওয়াহিদ মুরাদ এবং কলকাতার ছবি বিশ্বাস, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, বিশ্বজিৎ, সৌমিত্রদের ছবির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে শুরু করল ঢাকার নির্মাতাদের নির্মিত ছবি।
আব্দুল জব্বার খান, রহমান, শবনম, খলিল, ফতেহ লোহানী, খান আতা, সুমিতা দেবী, আনোয়ার হোসেন, সুচন্দাদের সঙ্গে যোগ হলো আরেকটি নাম রাজ্জাক। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে এখানে নির্মিত বেশির ভাগ ছবির নায়ক রাজ্জাক। দুই ভাই, আবির্ভাব, বাঁশরী, এতটুকু আশা, নীল আকাশের নীচে, যে আগুনে পুড়ি, পায়েল, দর্পচূর্ণ, যোগ বিয়োগ, ছদ্মবেশী, জীবন থেকে নেয়া, মধু মিলন ইত্যাদি ছবির সাফল্যে রাজ্জাক হয়ে ওঠেন চলচ্চিত্রের অপরিহার্য নায়ক। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলাদেশে পাক-ভারতীয় ছবির প্রদর্শন বন্ধ হলে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব যাদের উপর বর্তায় তাদের একজন রাজ্জাক। রহমান, আজীম, আনোয়ার হোসেনের সঙ্গে হাতে হাত রেখে রাজ্জাক পথ চলতে শুরু করেন। এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় রহমান একটি পা হারালে চলচ্চিত্রের রোমান্টিক নায়কের শূন্যতা রাজ্জাক একাই সামাল নেন। রাজ্জাক দাপটের সাথে একের পর এক ছবিতে অভিনয় করতে থাকেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম মুক্তি পায় রাজ্জাক অভিনীত ছবি ‘মানুষের মন’। মোস্তফা মেহমুদ পরিচালিত এই ছবির ব্যবসায়িক সাফল্যে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নতুন ভাবে জেগে ওঠে।
শুরু হয় চলচ্চিত্রে নায়ক রাজ্জাকের যুগ। এই সময় মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম ছবি চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা ১১ জন’, এসএম শফির ‘‘ছন্দ হারিয়ে গেল’, বাবুল চৌধুরীর ‘প্রতিশোধ’ এবং কাজী জহিরের ‘অবুঝ মন’ ছবিতে অভিনয় করে রাজ্জাক হয়ে যান বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আইকন। ১৯৭৩ সালে জহিরুল হকের ‘রংবাজ’ ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করে রাজ্জাক বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। তিনি সূচনা করেন চলচ্চিত্রের আধুনিক অ্যাকশন যুগেরও। রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘রংবাজ’ ছবির সাফল্যের পর আমার মনে হলো, দর্শকদের এক ঘেয়েমি থেকে মুক্ত রাখতে হলে সব ধরনের চরিত্রে অভিনয় করতে হবে।
অভিনেতা হিসেবে নিজেকে অন্য সবার ধরাছোঁয়ার বাইরে নিয়ে যাওয়ার জন্য রাজ্জাককে তেমন কোনো কৌশলের আশ্রয় নিতে হয়নি। রাজ্জাক বরাবরই মানুষকে যথাযোগ্য সম্মান আর ভালোবাসা দিয়েছেন। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকাকালে রাজ্জাক প্রতি রবিবার বন্ধু-বান্ধব আর নামীদামী প্রযোজক-পরিচালকদের সম্মানে পার্টির আয়োজন করেছেন বছরের পর বছর। রাজ্জাকের স্ত্রী লক্ষ্মী রাত জেগে স্বামীর বন্ধুদের পছন্দ মতো রান্না বান্না করে খাইয়েছেন। নির্মাতারাই তাকে দিয়েছেন বাদি থেকে বেগম, সমাধি, সেতু, আগুন এর মতো জনপ্রিয় ছবির সেরা চরিত্র। একটা সময় ছিল যখন নির্মাতারা মনে করতো পর্দায় নায়ক মারা গেলে ছবি চলবে না। ঠিক ওই সময়ে বেঈমান, সমাধি আর সেতু ছবির শেষ দৃশ্যে রাজ্জাক মৃত্যুবরণ করে দর্শকদের কষ্ট দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু ছবির সাফল্যও আদায় করে নিয়েছেন।
১৯৭৭ সালে রাজ্জাক যখন পরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন তখন বেছে নেন পরিপক্ক প্রেমের গল্পকে। ছবির নাম ‘অনন্তপ্রেম’। ছবিতে রাজ্জাকের সঙ্গে ববিতা। গল্প, চিত্রায়ন, নির্দেশনা, অভিনয়, গান সব মিলিয়ে ‘অনন্তপ্রেম’ এর কথা কি সেই সময়ের দর্শকরা আজও ভুলতে পেরেছেন? প্রেমের ছবির মূল্য কথা হচ্ছে মান-অভিমান, প্রেম, ভালোবাসা এবং শেষে মিল।
বরাবরই এরকম ছবি দেখে দর্শক হাসতে হাসতে বাড়ি ফিরতো। কিন্তু ‘অনন্ত প্রেম’ নায়ক নায়িকার মৃত্যু দিয়ে শেষ করেও সাফল্য পেয়ে রাজ্জাক প্রমান করেছেন পরিচালক হিসেবেও দর্শকদের মনজয় করার ক্ষমতা রাখেন তিনি। পরবর্তীতে ‘বদনাম’ ‘সৎ ভাই’ ‘বাবা কেন চাকর’ নির্মাণ করে পরিচালক হিসেবে নিজের অবস্থানকে শক্তিশালী করে নেন।
অভিনেতা রাজ্জাকের বৈচিত্র্যময় সাহসী চরিত্রে অভিনয়ের কথা স্মরনীয় হয়ে আছে। ১৯৭৮ সালে রাজ্জাক যখন অবিশ্বাস্য জনপ্রিয় এক অভিনেতা ওই সময় আজিজুর রহমানের ‘অশিক্ষিতি’ ছবিতে দর্শকরা তাকে দেখলেন গ্রামের এক পাহাড়াদারের চরিত্রে। ছবিতে শেষ দৃশ্যে মাস্টার সুমনের মৃত্যুর পর পুলিশের খাতায় রাজ্জাকের সাক্ষর করার দৃশ্যটি দেখলে আজও সবার চোখে পানি আসে। এর দুই বছর পর একই পরিচালক আজিজুর রহমানের ‘ছুটির ঘণ্টা’ ছবিতে স্কুলের দপ্তরির চরিত্রে রাজ্জাকের অসাধারন অভিনয় কি মন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব? বড় কথা ওই সময়ে যে অবস্থান থেকে রাজ্জাক পাহারাদার কিংবা স্কুলের দপ্তরির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সেটা আজকের কোনো জনপ্রিয় নায়কের কাছ থেকে আশা করা যায়? সবচেয়ে বড় কথা রাজ্জাক খুব ভালো করে জানতেন কখন কী করতে হবে। নিজের পরিচালিত ‘বদনাম’ ছবিতে নায়ক জাফর ইকবালকে দিয়ে সবচেয়ে হিট গান ‘হয় যদি বদনাম হোক আরো’ গাইয়ে ছবির সাফল্যটা আদায় করে নিয়েছিলেন। কোন কাজ কখন কোন সময়ে কাকে দিয়ে করাতে হবে এটা ভালো ভাবে জানতেন বলেই চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার সময়ে নিজের প্রযোজনা-পরিচালনায় ‘বাবা কেন চাকর’ বানিয়ে চলচ্চিত্রের চেহারাটাই বদলে দিয়েছিলেন।