Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

হাতের কাছেই দৃষ্টান্ত


মোহাম্মদ তারেক

রেদওয়ান রনির বাবা মো: রজব আলী একজন শিক্ষক ছিলেন তাই তাঁর কাছে প্রচুর গল্প এবং সাহিত্যের বই ছিল। শৈশবে প্রচুর বই পড়তেন রনি। বই পড়ার সময় তার মনের চোখ দিয়ে গল্পটি কল্পনা করতেন। এক পর্যায়ে তিনি অনুভব করেন তার কিছু কথা বলতে বা প্রকাশ করতে চান। সেটা কবিতা বা চিত্রের মাধ্যমে তিনি প্রকাশ করতে চেয়েছেন। তবে চলচ্চিত্র নির্মাণ ছিল তার প্রথম পছন্দ। কলেজে পড়ার সময় থেকেই রনির চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার আগ্রহ সৃষ্টি হয়। রানা নামের তার এক বন্ধু ছিল। সে অভিনেতা হতে চেয়েছিল। বন্ধু রানাই সর্বদা রনিকে চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার জন্য অনুপ্রেরণা দিতেন।
দুর্ভাগ্যক্রমে দুই বছর পরে রানা সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেলে রনির স্বপ্নগুলো থমকে যায়। নিজেকে তেরি করতে তার কিছুটা সময় লেগে যায়। তারপর আবার রনি চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার প্রেরণা ফিরে পেতে শুরু করেন। রাজশাহীর নিউ সরকারী ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করে ঢাকায় চলে আসেন রনি। ভর্তি হন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে। কম্পিউটার সায়েন্সে পড়াশোনা করতেন। একই বিষয়ে পড়াশোনা করতেন ইফতেখার আহমেদ ফাহমিও। এক পর্যায়ে দুজনের মধ্যে বন্ধু গড়ে উঠে। তাদের দুজনেরই ইচ্ছা ছিল তারা কম্পিউটার গেমস বানাবেন। কিন্তু রনির নির্মাতার হওয়ার পোকাটা মাথায় ছিল সব সময়। স্বপ্ন দেখতেন নির্মাতা হওয়ার।
রেদওয়ান রনি বলেন, আমি যখন ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে আমার প্রথম সেমিস্টারে অধ্যায়নরত ছিলাম তখন আমি এমন একজন ডিরেক্টরের সন্ধান করেছিলাম, যার কাছ থেকে আমি শিখতে পারি। ওই সময়টি মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং গিয়াস উদ্দিন সেলিমের কিছু কাজ ইটিভিতে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। আমি ইন্টারনেটে ফারুকী ভাইয়ের একটি ইমেল ঠিকানার সন্ধান করি। তখন কোনো ফেসবুক ছিল না। আমি তাকে দীর্ঘ ইমেল পাঠিয়েছি। আমি ভাবছিলাম যে সে আমার ইমেল পড়তে পারে অথবা নাও পারে। তবে আমি জানতাম যে তিনি যদি এটি পড়ে থাকেন তাহলে জবাব দিবেন। আমার কম্পিউটার ছিল না। তাই আমি প্রতিদিন কম্পিউটারের দোকানে আমার ইমেলটি পরীক্ষা করতাম। সাত-আট দিন পর সেই ইমেলের উত্তর পেয়ে আমি অবাক হয়েছিলাম। সেখানে ফারুকী ভাইয়ের ফোন নম্বরও ছিল। আমি কাজ পেতে তাকে নিয়মিত ফোন করতাম। ফোন করতে করতে একসময় ফারুকীর সহকারী হিসেবে কাজ করার সুযোগ আসে তার।
২০০৪ সালে রেদওয়ান রনি এবং তার বন্ধু ইফতেখার আহমেদ ফাহমী ছবিয়াল গ্রুপে যোগ দিয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি নাটক নির্মাণ ও চলচ্চিত্র পরিচালনা শিখেছিলেন। দুই বন্ধুর প্রথম কাজ শুরু হয় মোস্তফা ফারুকীর পরিচালনায় ‘৬৯’ ধারাবাহিক নাটকের মাধ্যমে। জনপ্রিয় এই ধারাবাহিকটি চ্যানেল আইতে প্রচারিত হয়েছিল। ২০০৭ সালে মোস্তফা সরয়ার ফারুকী পরিচালিত ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ সিনেমার সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
ফারুকীর সঙ্গে তিন বছর সহকারী হিসেবে কাজ করেন। রেদওয়ান রনি যখন ফারুকীর সহকারী পরিচালক হিসেবে ‘ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন তখন তিনি নির্দেশনা সম্পর্কে অনেক কিছুই তার কাছ থেকে শিখেছেন। তবে এ যাত্রাটি রনির জন্য সুখকর ছিল না। তিনি কম্পিউটার সায়েন্সের ছাত্র ছিলেন। কাজের ক্ষেত্রে নাটকীয় পরিবর্তন তার পরিবারকে হতাশ করেছিলো। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি তাদেরকে রাজি করেছিলেন।
২০১০ সালে রেদওয়ান রনি নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন উড়োজাহাজ টেলিফিল্মের মাধ্যমে। তারপর তিনি ইফতেখার আহমেদ ফাহমীর সঙ্গে যৌথভাবে পরিচালনা করেন জনপ্রিয় টিভি সিরিয়াল ‘হাউসফুল’। এই ধারাবাহিকটি করে নির্মাতা হিসেবে আলোচনায় আসেন রেদওয়ান রনি। ‘হাউসফুল’ ধারাবাহিক নাটকটি তাকে বেশি পরিচিত করে দর্শকের মাঝে।
বিজ্ঞাপন, নাটক, চলচ্চিত্র সব খানেই সমান তালে কাজ করে যাচ্ছেন এই নির্মাতা। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দাপটের সাথে নির্মাণ করে চলেছেন রেদওয়ান রনি। তার নির্মিত উল্লেখযোগ্য ধারাবাহিক নাটক গুলো হলোÑ হাউসফুল, বিহাইন্ড দ্য স্কিন, জিম্মি, বহুরুপী, হিমু, মানিব্যাগ, এন এফ, উড়োজাহাজ, প্রুফ রিডার, ইউটার্ন, ভালোবাসা ১০১, সুবর্ণপুর বেশি দুর নয়, রাঘবন্দি ও পাতা ঝড়ার দিন সহ শতাধিকেরও বেশি টিভি ফিকশন তৈরি করেছেন এই নির্মাতা।
রনি নির্মিত পাতা ঝড়ার দিন টেলিফিল্মটি একটি সত্য গল্পের ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছিল। এতে অভিনয় করেন সৈয়দ হাসান ইমাম ও ঈশিতা। ছবিয়াল দলের ভাইব্রাদার এক্সপ্রেস প্রকল্পের অংশ হিসেবে চ্যানেল আইতে প্রচারিত হয়েছিল। সেই সময় টেলিফিল্মটি প্রশংসা কুড়িয়েছিল। ভাই ব্রাদার এক্সপ্রেস প্রকল্প সম্পর্কে রেদওয়ান বলেন, আমরা একে অপরের কাজে থাকার চেষ্টা করেছি। কারণ আমরা সকলেই একই বিদ্যালয়ের অংশ। আমরা যখনই একসাথে কাজ করি তখন আমরা একে অপরের গল্প শুনি এবং পারস্পরিক ভাবে আমাদের ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশ করি। নাটকের পাশাপাশি বিজ্ঞাপনেও কাজ করেছেন তিনি। এয়ারটেল, রবি, বাংলালিংক, প্রথম আলো, স্কয়ার, ফ্রেস, ইউনিলিভার সহ নামী দামী ব্র্যান্ডের টিভিসি তৈরি করেছেন রনি।
২০১২ সালে রেদওয়ান রনির প্রথম নির্মিত চলচ্চিত্র ‘চোরাবালি’র জন্য শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এ ছবিটি ৫টি ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে। এরপর ২০১৬ সালে রনি তার দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘আইসক্রীম’ নির্মাণ করেন। এরপর জনপ্রিয় অভিনেত্রী নাবিলা ও মিথিলাকে নিয়ে রনি তার তৃতীয় ফিচার ফিল্ম ‘ব্লাড রোজ’ নির্মাণ করেন। থ্রিলার ধর্মী ছবিটি জনপ্রিয় ডিজিটাল স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম আই ফ্লিক্স এ মুক্তি পেয়েছিল।