Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

হার না মানা ক্যাপ্টেন!


মামুনুর রহমান

ক্রিকেটে বাংলাদেশের ছোট দল থেকে বড় দল হয়ে ওঠা মাশরাফির হাত ধরে। তিনিই সবাইকে শিখিয়েছেন কিভাবে প্রতিপক্ষের চোখে চোখ রেখে লড়তে হয়। আর ইনজুরিকে বশ করা শিখিয়েছেন পুরো ক্রিকেট বিশ্বকে। তার গোটা ক্রিকেট ক্যারিয়ারই একটি লড়াইয়ের গল্প। নড়াইলের চিত্রা নদীর পাড়ে জন্ম তার। জাতীয় ক্রিকেট দলে আসার গল্পটা রীতিমত রুপকথার মতো। ২০০০ সালে অনুর্ধ ১৯ দল। আর তার ঠিক ১ বছর পরে ২০০১ সালে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে অন্তর্ভূক্তি। কোটি হৃদয় জুড়ে তার বসবাস। রাজনীতিতেও নাম লিখিয়েছেন। এখন বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সংসদ সদস্য। বিশ্বের সেরা দশ অধিনায়কের একজন তিনি। কিন্তু মি: ক্যাপ্টেন কুলের এই এগিয়ে চলার পথটা মোটেই মসৃণ ছিলো না সব সময়। তার ক্যারিয়ারকে অসংখ্যবার চোখ রাঙিয়েছে ক্রিকেটের ভিলেন ইনজুরি। ক্রিকেটের এই বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে মাশরাফি বিন মোর্ত্তজার শরীরে অস্ত্রপাচার হয়েছে আটবার। প্রতিবারই তিনি চিকিৎসকদের ভুল প্রমান করে আবারও এগিয়ে গেছেন। ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপের কিছুদিন আগের কথা। বিকেএসপিতে প্রাকটিস করছিলেন তিনি। বিকেএসপির সেন্টার উইকেটে ব্যাটিং করছিলেন। রানিং শুরু করতেই পড়ে যান তিনি। হাঁটুতে ইনজুরি দেখা দেয় সেদিনই প্রথম। সতীর্থরা মাশরাফির পড়ে যাওয়া দেখে দ্রুত দৌড়ে আসেন। মাঠের বাইরে মাশরাফি। চিকিৎসক মাশরাফিকে জানালেন হাটুর লিগামেন্ট নাজুক পরিস্থিতিতে রয়েছে। লম্বা সময়ের বিশ্রাম প্রয়োজন। ক্রিকেট মহলে ছড়িয়ে পড়লো চিকিৎসকের পরামর্শ। বাংলাদেশের মাটিতে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। অথচও দলে থাকলেন না তিনিই যিনি পুরো দলটাকে এক হয়ে খেলতে শিখিয়েছেন। লড়তে শিখিয়েছেন। ২০১১ বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের কদিন আগে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে সেদিন কেঁদেই ফেলেছিলেন আমাদের ক্রিকেটের এই বরপুত্র। তবে মাশরাফি দেশবাসীকে এটুকু বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি ফিট রয়েছেন।
খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বল করাটা মাশরাফির বিশেষ এক স্টাইল। একই ভাবে খেলে যাচ্ছেন আজও। ২০০১ সালের ৮ নভেম্বর টেস্ট খেলতে শুরু করেন তিনি। ইনজুরির কারনেই সেই সাদা পোশাক তুলে রাখতে হয়েছে আলমারিতে। জীবনের ৩৬ টেস্টের শেষটা খেলেছেন ১২ বছর আগে ২০০৯ সালে। উইকেট পেয়েছেন ৭৮। একদিনের ক্রিকেটেও শুরু করেছেন সেই জিম্বাবুয়ে দলের সাথেই। ২০০১ সালের সেই প্রথম ম্যাচে উইকেট শিকার করেন ২। ২১৯ ম্যাচের ওয়ানডে ক্যারিয়ারে উইকেট শিকার ২৬৯। রান করেছেন ১৭৮৭। কেনিয়ার বিপক্ষে ২৬ রানে ৬ উইকেট মাশরাফির ক্যারিয়ার সেরা বোলিং ফিগার। ক্রিকেটের আরেক ফর্মেট টি২০ তে মাশরাফি খেলেছেন ৫৪ টি ম্যাচ। উইকেট পেয়েছেন ৪২টি। তিন ফর্মেট মিলিয়ে মাশলাফির মোট উইকেট সংখ্যা ৭০০ আর অধিনায়ক হিসেবে ১০০ উইকেট ধারী ক্লাবে তিনি চতুর্থ জন। ক্যারিয়ারের বিদায় বেলায় এই দুটি বিশেষ রেকর্ড তাকে তুলে এনেছে অন্য এক উচ্চতায়। সবারই এক সময় থামতে হয়। মাশরাফিও থেমেছেন। তবে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে জিততে শেখানো নায়ক তিনি। ক্রিকেটকে নতুন জায়গায় নিয়ে যাওয়ার নায়ক তিনি।২০১৪ থেকে ২০১৯ ক্রিকেট বিশ্বের গর্জে ওঠা একটি দলের নাম বাংলাদেশ। বদলে যাওয়া একটি দলের নাম বাংলাদেশ। ভাঙা হাত নিয়ে তামিম মাঠে নেমে যান তার এক কথায়। তামিমের গ্লাভস কেটে গার্ড পড়িয়ে দেন তিনি। ইনজুরি জর্জড়িত দলে সাকিবের অভাব কাটিয়ে উঠতে নিজেই হয়ে যান ভরসার কেন্দ্রবিন্দু।


ম্যাচ জেতানো ইনিংস খেলে মুশফিকুর রহিম ড্রেসিং রুমে ফিরে বলেন মাশরাফি ভাই বলেছিল ম্যাচের আগে হারা যাবে না। মুস্তাফিজের ক্রাম্প, শেষ ওভার বল করা বাকি। তবুও ম্যাশ বল তুলে দেন ফিজের হাতে। ক্রাম্প ভুলে বোলিং মার্কে দ্য ফিজ। ম্যাচ শেষে ফিজও বলেছিলেন, ভাই বলেছে বল করতেই হবে। এশিয়া কাপের উদ্বোধনী ম্যাচ। লিটন দাস ততক্ষণে নিজের পঞ্চাশ করে ফেলেছেন। উইকেট থেকে ব্যাট উচিয়ে প্রিয় ক্যাপ্টেনের দিকে তাকান। পাল্টা জবাবে ম্যাশ বুকে হাত দিয়ে ইনিংসটা বড় করতে বলেন আর বার বার বাংলাদেশ দলের লোগো দেখিয়ে বেষ্ট অব লাক জানান। কোন দলের অধিনায়ক যখন তাঁর দলের খেলোয়াড়কে এভাবে সাপোর্ট করে সে খোলোয়াড়ের আর কিইবা পাওয়ার বাকি থাকে।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে সব বড় অর্জনের সাথে জড়িয়ে আছে মাশরাফির নাম। নিজের সমস্ত অর্জনকে অবলীলায় দেশের জন্য সামান্য করতে পেরেছি বলে প্রেস কনফারেন্স শেষ করতেন তিনি। ক্রিকেটারদের ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে রীতিমত লড়াকু মনোভাব ছিলো তার। ভরসা করতে জানেন। সে কারনেই বাংলাদেশের ক্রিকেট এগিয়েছে। তামিম, সাকিব, মাহমুদুল্লাহ, মুশফিক, মুস্তাফিজ এই নাম গুলো তৈরিই হতো না যদি মাশরাফি তাদের ধারাবাহিকতা ধরে না রাখতেন। নিজে যেমন ভরসা রাখতেন খেলোয়াড়দের প্রতি বোর্ডকেও ভরসা রাখতে শিখিয়েছেন তিনি। এক দল হয়ে জয় ছিনিয়ে আনতে শিখিয়েছেন তিনি। দেশের জন্য লড়াই করতে করতে ম্যাশ মাঝে মধ্যেই ভুলে যান ডা: ইয়াং এর কথা। তিনি বলেছিলেন ক্রিকেট থেকে সরে না গেলে পা হারাতে পারেন তিনি। মাশরাফির লিগামেন্ট গুলো আর প্রেসার নিতে নারাজ।
নড়াইলের শরীফ মোহাম্মদ হোসেনের হাত ধরে ক্রিকেটের ভুবনে আসেন মাশরাফি। বয়স তখন আট হবে। প্রচন্ড জোরে বল করতে পারতেন তখন থেকেই। টেনিস বলের পর ক্রিকেট বলে যাত্রা শুরু হয় সেখানেই। ক্লাবের নাম নড়াইল ক্রিকেট ক্লাব। অনুর্ধ্ব ষোল খুলনা বিভাগের জন্য দল তৈরি হবে। খুলনার দশ জেলা থেকে খেলোয়াড় বাছাই করা হয়। সে সময় কংক্রিকেটর ওপর ব্যাটিং এবং বোলিং করিয়ে খেলোয়াড় বাছাই করা হয়। ম্যাশ বল করছিলেন আর ব্যাটসম্যানরা ব্যাট উঠিয়ে শুধু দাঁড়িয়েই থেকেছেন বল জাজ করে সামনের পায়ে এসে খেলা তো দূরের কথা, অনেকেই ম্যাশ এর সামনে দাঁড়াতেই পারেননি।
এরপর বিকেএসপির প্রতিভা অন্বেষন ক্যাম্প। পরের বছর নড়াইলে অনুষ্ঠিত ন্যাশনাল ক্যাম্পে ওসমান খানের কাছ থেকে ডাক পান মাশরাফি। সুযোগ হয় খুলনায় খেলার। তার গতি আর অসাধারন সুইং তুমুল হৈ চৈ ফেলে দেয়। সেই সুত্র ধরে অনুর্ধ্ব ১৭ দলের জন্য ঢাকায় আগমন ঘটে মাশরাফি বিন মোর্ত্তজার। অনুর্ধ্ব ১৯ দলে সুযোগ আসে ১৭ দলে ভালো করার জন্য। কোচ এন্ডি রাবর্টস এর সান্নিধ্যে নতুন ভাবে বদলে যান মাশরাফি। তারপরের ইতিহাস তো সকলের জানা। সুযোগ আসে লাল সবুজের প্রতিনিধিত্বের। বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলে মাশরাফি শুধু একজন সফল ক্রিকেটার নন। তিনি ক্রিকেটারদের আস্থার জায়গা, বিশ্বাসের জায়গা।
একরকম হঠাৎ করেই ক্যাপ্টেনসি থেকে সরে দাঁড়ালেন তিনি। বিদায়ের এই ম্যাচটিকে স্মরনীয় করে রাখতে জিম্বাবুয়ে দলের সাথে তিন ম্যাচ সিরিজের আয়োজন করে বোর্ড। বেশ জমকালো ফেয়ারওয়েল দেয়া হয় তাঁকে। তবে দেশবাসীকে মাশরাফির বিদায় কিছুটা অন্যরকম ঠেকেছিল। এখনো গুঞ্জন শোনা যায় কোন বিশেষ মহলের চাপেই এমন সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলেন মাশরাফি বিন মোর্ত্তজা। সেদিন বিদায় বেলায় সবাই চিৎকার করে বলেছিল থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন। সে সুযোগটি আজ আমরাও নিতে চাই। বলতে চাই থ্যাংক ইউ ক্যাপ্টেন।