Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

স্থপতি রাফী মাহমুদের স্থাপত্য ভুবন

রাফি উদ্দীন মাহমুদ। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য স্থপতি। দীর্ঘ দুই দশক ধরে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পে সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৭ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘ডি ফর্ম’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। বর্তমানে তিনি এই স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে তিনি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার নকশা ও ইন্টেরিয়র ডিজাইন করেছেন। স্থাপত্য চর্চার পাশাপাশি তিনি চিত্রশিল্পচর্চা করে যাচ্ছেন নিয়মিত। আমেরিকাতে একাধিক আন্তর্জাতিক চিত্রকর্ম প্রতিযোগিতায় তাঁর কাজ পুরস্কৃত হয়েছে। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে এই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

আমাদের স্থাপত্য পেশা অনেক উন্নতি করেছে। এই দেশের স্থপতিরা বিরতিহীনভাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এনে দিয়েছেন, দিচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য খুবই উৎসাহ ব্যাঞ্জক। নিজের দেশেও আমাদের স্থপতিরা ধীরে হলেও স্বীকৃতি পাচ্ছেন তার প্রমান বড় বড় সরকারি প্রজেক্টে প্রতিতযশা স্থপতিদের অধিক অংশগ্রহণ, যেটা কিনা কয়েক বছর আগেও ছিল না বললেই চলে। যদিও ড্যাপ সংশোধনের পরে ঢাকার স্থপতিরা একটা স্থবির সময় পার করছেন, কারণ সার্বিক ভাবে ঢাকায় প্রজেক্টের সংখ্যা আগের থেকে অনেক কমে গেছে। তবে ঢাকার অদূরে বাইরে প্রজেক্ট বাড়ছে যা কিনা আশার কথা। কথাগুলো বললেন স্থপতি রাফি উদ্দীন মাহমুদ। তাঁর গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুরে। তবে তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। রাফির বাবার নাম সাইফুল ইসলাম। তিনি সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন। মা মোসাব্বেহা খানম গৃহিণী। চার ভাইয়ের মধ্যে রাফি মাহমুদ তৃতীয়। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকাআঁকির প্রিিত ছিল তার প্রচন্ড ঝোঁক। চট্টগ্রামের চারুকলা কলেজের পাশেই মেহেদিবাগ সরকারি কলোনীতে থাকতেন তারা। চারুকলার শিক্ষার্থীরা মাঠে বসে ছবি আঁকার অনুশীলন করতেন। দূর থেকে তা দেখতেন রাফি। এভাবেই ছবি আঁকার প্রতি তার আগ্রহ জন্মায়। জাতীয় শিশু-কিশোর প্রতিযোগিতায় ছবি আঁকায় প্রথম হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। জাতীয় পর্যায়ে অসংখ্য পুরস্কার পেয়েছেন। জাতিসংঘ থেকে একটি ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। সেই প্রতিযোগিতায় সেরা পাঁচজন শিশু শিল্পীকে পুরস্কৃত করা হয়। তাদের মধ্যে রাফি মাহমুদ একজন।

স্থপতি রাফি উদ্দীন মাহমুদ

চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৫ সালে ইস্পাহানী পাবলিক কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন ২০০৩ সালে। পাস করে বের হওয়ার পর রাফি যোগদেন অফিস এন্ড হোম সলিউশন প্রাইভেট লিমিটেডে। সেখানে দুই বছর কাজ করার পর ২০০৫ সালে ‘মিথ লিমিটেড’ এ যোগ দেন। তারপর ২০০৭ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘ডি ফর্ম’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। ২০১৩ সালে রাফি মাহমুদ সিনিয়র আর্কিটেক্ট হিসেবে যোগ দেন সানমার গ্রুপ এ। তারপর ২০১৫ সালে ইউনাইটেড গ্রুপে সিনিয়র আর্কিটেক্ট হিসেবে যোগ দেন। ২০১৬ সালে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সহকর্মী বন্ধু জাহাঙ্গীর আলমকে সঙ্গে নিয়ে ডি ফর্ম এর কাজ শুরু করেন। বর্তমানে তিনি এই স্থাপত্য প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে কক্সবাজারে ১০ স্টোরিড বিল্ডিং হোটেল প্যাসিফিক সানসেট, বারিধারায় জে ব্লকে ১০ স্টোরিড শপিংমল বারিধারা প্যাভিলিয়ন, ধানমন্ডিতে ফার্স্ট সিকুউরিটি ইসলামিক ব্যাংক এর এক্সটারিয়র ও ইন্টেরিয়র ডিজাইন, গোপালগঞ্জে হলিডে হোম, বাংলামোটরে আজকের কাগজ এর ইন্টেরিয়র ডিজাইন, বনানীর ৭ নম্বর রোডে নাবিল গ্রুপের কর্পোরেট অফিসের ইন্টেরিয়র ডিজাইন, রাজাবাজারে এসআলম গ্রুপের গেস্ট হাউজ এর ইন্টেরিয়র ডিজাইন, গাজীপুর মাওনায় ডুপলেক্স হলিডে হোম ডিজাইন, গুলশান এভিনিউতে ফার্স্ট সিকোরিটি ইসলামি ব্যাংক এর ইন্টেরিয়র ডিজাইন, গাজীপুরে মাওনায় সিক্স স্টোরিড রেসিডেন্সিয়াল প্রজেক্ট, মিরপুর পল্লবীতে ১০ স্টোরিড আবাসিক বিল্ডিং, শ্যামলীতে ১০ স্টোরিড আবাসিক বিল্ডিং সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। এছাড়াও বেশ কিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন।
স্থাপত্যের পাশাপাশি রাফি মাহমুদ পেইন্টিং করে যাচ্ছেন নিয়মিত ভাবে। অবসরে রাফি এক্রিলিক মাধ্যমে ক্যানভাসে ছবি আঁকতে বসে পড়েন। তার প্রথম একক চিত্র প্রদর্শনীটি সুধী সমাজে বিশেষ ভাবে প্রশংসিত হয়েছিল।
তরুণ স্থপতিদের উদ্দেশ্যে স্থপতি রাফি মাহমুদ বলেন, প্রথমত এই পেশায় আসতে হলে অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। স্থাপত্যের সাথে একটা আজীবনের সম্পকর্, যা কিনা পরিবার, বন্ধু-বান্ধব আত্মীয়স্বজন সহ অন্যান্য সব সম্পর্কেই ব্যঘাত ঘটতে পারে। রাত জাগা অভ্যস্ত হতে হবে। রাতের পর রাত জেগে এবং দিনে কাজ করে প্রজেক্ট জমা দেয়ার মত মানসিক এবং শারীরিক সক্ষমতা না থাকলে স্থাপত্য শিক্ষা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। মনে সমালোচনা গ্রহণ করার মতো যথেষ্ট বড় জায়গা থাকতে হবে। কাজের সমালোচনা ছাড়া স্থাপত্য শিক্ষা আর আছেই বা কী? নিজের চারিদিকে শুনো, গ্রহণ করো এবং তার থেকে ভালো কিছু সৃষ্টি করো। শ্রবণ ক্ষমতা উন্নত করাও জরুরি বিষয়। শিক্ষা সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেমিস্টার শেষ হলে ক্লাসমেটরা মিলে কোনো একটা ঐতিহাসিক তাৎপর্যপূর্ণে স্থানে ঘুরতে যাওয়া। শিক্ষকের সাথে সুসম্পর্ক রাখা খুব দরকার। প্রত্যেকটা কাজের শুরুতে শিক্ষকের সাথে আলাপ করা এবং তাঁদের মতামত জানো। দিন শেষে নিজের মতই কাজ করবে কিন্তু তাঁদের মতামত তোমার কাজকে পরিপক্কতা দিবে। সব সময় নিজের সাথে একটা ডায়েরি রাখা প্রয়োজন। মাথায় যা আইডিয়া আসবে সব লিখে রাখবে। এমনকি অন্যের আইডিয়াও যেটা গুরুত্বপূর্ণ মনে হবে। কারণ দিন শেষে ডিজাইন করতে বসে প্রয়োজনীয় কিছু মনে করবে না পারার জন্য যেন অনুশোচন করতে না হয়। এমন কি স্কেচও করে রাখতে পারো। মনে রাখবে যে কোনো নকশার প্রথম ধারনার প্রথম প্রস্তাবটাই পরিত্যাক্ত হয়ে যেতে পারে এবং এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। তাই এতে একেবারেই ভেঙ্গে পড়া চলবেনা। ডিজাইনের অগ্রগতি কখনওই শেষ হবার নয়। এমনকি জমার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত। পাশ করার সাথে সাথেই খুব ভালো একটা চাকরি পেয়ে যাবে। পড়ালেখা শেষ করে বহু বছর কঠোর পরিশ্রম করার পরে হয়তো একটা ভালো জায়গা পৌঁছাতে পারবে। স্থাপত্য পেশা খুব কুসুমাতীর্ণ নয়। সর্বোপরি ছাত্রজীবনে যা কিছু করবে সমস্ত কিছু ডকুমেন্ট আকারে সংরক্ষণ করতে হবে। মডেল, ফোটোগ্রাফ, স্কেচ, ক্যাড ড্রইং সব কিছু রেখে দিবে যা তোমার পোর্টফলিও তৈরিতে কাজে লাগবে, পরবর্তী জীবনে এইটাই হবে অনেক বড় সম্পদ।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি রাফি উদ্দীন মাহমুদ বলেন, এই মুহূর্তে নির্মাণ শিল্পের সাথে সংযোগ আরো বাড়ানোই আমার পরিকল্পনা। ঢাকায় এবং ঢাকার বাইরে ইতোমধ্যেই বেশ কিছু নির্মাণ কাজের সাথে যুক্ত হয়েছি যে গুলো কিনা নিজেরই ডিজাইন করা প্রজক্ট। এই অভিজ্ঞতা আরো কাজে লাগাতে চাই। এছাড়াও আমার জীবনের বড় একটা অংশ জুড়ে রয়েছে চিত্রশিল্পচর্চা। সেই চর্চাকে আরো বৃহৎ পরিসরে আন্তর্জাতক অঙ্গনে নিয়ে যেতে চাই। ইতোমধ্যেই ইটালির ভেনিস শহরে একটি আন্তর্জাতিক চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পেয়েছি এবং আমেরিকায় একাধিক আন্তর্জাতিক চিত্রকর্ম প্রতিযোগিতায় আমার কাজ পুরস্কৃত হয়েছে আর সেখানে আমার চিত্রকর্মের সংগ্রাহকের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। এই বিষয়ে আজকাল বেশি সময় দেয়া হচ্ছে।