Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ফারহানা রশীদের স্থাপত্য ভুবন

এ দেশের সংস্কৃতি, প্রকৃতি ও মানুষের মমত্ববোধ নিয়ে স্থাপত্যশিল্পে কাজ করে যাচ্ছেন স্থপতি ফারহানা রশীদ তনু। ২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১৬ সালে সুইডেন ইনস্টিটিউট থেকে টেকসই নগর পরিকল্পনা এবং ডিজাইনের ওপর স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর দেশে ফিরে এসে নিজে গড়ে তোলেন ‘ভূমিজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এবং সুস্থ মানুষের জন্য একটি স্বাস্থ্যকর শহর গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন নিয়মিত। এবার শাহ্ সিমেন্ট নিমাণে আমিতে এই স্থপতিকে নিয়ে প্রকাশ হল প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

ফারহানার গ্রামের বাড়ি রাজশাহী জেলায়। জন্ম ও বেড়ে ওঠা দেশের বিভিন্ন জায়গায়। তার বাবার নাম মো: আব্দুর রশীদ। তিনি ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন। মা মুর্শিদা পারভীন গৃহিনী। দুই বোনের মধ্যে ফারহানা বড়। সৃজনশীল কোনো কিছু করার উদ্দেশ্যে আর্কিটেক্ট হওয়া তার। রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল থেকে এসএসসি পাস করেন ২০০১ সালে। ২০০৩ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। তনু ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন ২০১০ সালে। পাস করে বের হওয়ার পর তিনি যোগ দেন খ্যাতিমান স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম আর্কিটেক্টস এ লিমিটেড এ। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর আর্কিটেক্ট তৈমুর ইসলামের আরবান স্ট্যাডি গ্রুপের সাথে প্রজেক্ট ভিত্তিক কাজ শুরু করেন। তারপর ২০১২ সালে যোগ দেন এহসান খান আর্কিটেক্টস লিমিটেড এ।

স্থপতি ফারহানা রশীদ তনু

সেখানে বছর খানেক কাজ করার পর উচ্চ শিক্ষার জন্য ফারহানা রশীদ পাড়ি জমান সুইডেনে। ২০১৬ সালে সুইডেন ইনস্টিটিউট থেকে সাসটেইনেবল আরবান প্ল্যানিং ডিজাইনের ওপর মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশে ফিরে এসে ঢাকা এবং আশপাশের ছোট বসতি গুলোর আঞ্চলিক পরিকল্পনা এবং উন্নয়নের ওপর একটি গবেষণা প্রকল্প সমন্বয়ের জন্য বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অফ আর্কিটেকচার ল্যান্ডস্কেপ এন্ড সেটেলমেন্ট এ যোগ দেন। ২০১৬ সালেই নিজে গড়ে তোলেন ‘ভূমিজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। জনবান্ধব স্থাপত্যচর্চার মাধ্যমে সমাজের সকল স্তরের নাগরিকের কাছে সেবা পৌছে দিতেই ‘ভূমিজ’ এর যাত্রা শুরু। ‘ভূমিজ’ এর কাজ স্থাপত্য, ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন, নগর নকশা, নগর পরিকল্পনা। ভূমিজ ছোট থেকে বড় স্কেল, গবেষণা থেকে ডিজাইন, পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত পরিষেবা প্রদান করে যাচ্ছে।
ভূমিজ প্ল্যানিং ও ডিজাইন এর করা প্রজেক্টের মধ্যে রয়েছে আরবান ডিজাইন ও প্ল্যানিং মিরপুর বাউনিয়াবাদ এ ব্লকে সরকারি মাঠে শিশুবান্ধব গনপরিসর এর নকশা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন, নারায়নগঞ্জে সিটি কর্পোরেশনের ১৬ নং ওয়ার্ডে বেপারীপাড়া পার্কের নকশা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন, মিরপুরে ইউএন হ্যাবিটেট এর সহযোগিতায় জল্লাদখানা সংলগ্ন শিশুবান্ধব গনপরিসর এর নকশা, পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, মিরপুরে উদয়ন স্কুল সংলগ্ন রাস্তার নকশা, মিরপুরে পকেট পার্ক এর ডিজাইন এবং বাস্তবায়নের জন্য পরামর্শ, মিরপুর-৭ এ কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন ফুটপাতের শিশু-বান্ধব গণপরিসরের নকশা, পরিকল্পনা প্রণয়ন, ও বাস্তবায়ন, নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ব্যাপারীপাড়া পুকুর উন্নয়নের জন্য শিশুবান্ধব গণপরিসরের নকশা, পরিকল্পনা প্রণয়ন, নারায়নগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের ১৮ নং ওয়ার্ডে বি কে রোড কমিউনিটি সেন্টার, কমিশনারের কার্যালয় ও অ্যাপার্টমেন্ট, শীতলক্ষ্যার খাল উন্নয়নের জন্য নকশা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন, বরিশালে আবাসিক ভবন দ্য রোশন মমতাজ, রংপুরে নর্থান মেডিকেল কলেজ এর ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন, মতিঝিল বানিজ্যিক এলাকায় রাজউকের নিজস্ব জমিতে শিশুদের খেলার জায়গা এবং বিভিন্ন নাগরিক সুবিধার জন্য সম্ভাব্যতা নকশা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রস্তুত করা। র‌্যাম্পালে ট্রেইনিং সেন্টার, কুমিল্লায় ডি কন ডিজাইন স্টুডিওর সাথে যৌথভাবে বার্ড (ইঅজউ) আধুনিকীকরণ প্রকল্পের অধীনে বিএআরবি ক্যাম্পাসে মাস্টার অ্যান্ড ল্যান্ড স্কেপিং প্ল্যান এর পরিষেবা গুলোর কনসালটেন্সি সেবা, রংপুরে শ্যামা সুন্দরী খাল পুনঃ উন্নয়ন প্রকল্প, রংপুরের জন্য নকশা ও পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি। এছাড়াও স্যানেটেশন প্রজেক্ট রয়েছে মিরপুর কল্যাণপুর, বালুঘাট, গুলশান কাঁচাবাজার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সংলগ্ন। ঢাকার বাইরেও নারায়নগঞ্জ, যশোর ও খুলনায় স্যানিটেশন প্রজেক্ট রয়েছে তাদের।
ভূমিজ স্থাপন করেছেন কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে স্থপতি ফারহানা রশীদ বলেন, নগারয়নের জোয়ারে বাড়ছে নগরের সংখ্যা, নগরের পরিধি, নগরের জন্যসংখ্যা, সেই সাথে বাড়ছে নাগরিক সমস্যা। আধুনিক ও মান সমস্ত নাগরিক সুবিধা নির্ভর স্থাপনার প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। স্থাপত্যচর্চা কেবল মাত্র সমাজের বিশেষ অর্থ সম্পন্ন মানুষের জন্যই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত নয়। জনবান্ধব স্থাপত্যচর্চার মাধ্যৃমে সমাজের সকল স্তরের নাগরিকের কাছে পৌছে দিতেই ভূমিজ এর যাত্রা শুরু। ভূমিজ কাজ করছে সমস্যা বহুল নাগরিক জীবনে সকল শ্রেণীর মানুষের জন্য নাগরিক সুবিধা নির্ভর স্থাপনা ও তার ব্যবস্থাপনা নিয়ে।
বিশেষ ভাবে নারী, শিশু এবং নিম্নআয়ের ব্যক্তিদের সম্মখীন শহরে সেবাগুলোতে চাপের সংকট মোকাবেলা করার জন্য। শহর বাজার আর নাগিরক জীবনকে প্রতিটা সমস্যাই সমাধানযোগ্য। আর স্ব স্ব সমস্যার ভেতর থেকে পরিবেশ ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজে নিতে পারার মাধ্যমেই টেকসই উন্নয়ন সম্ভব। প্রকৃতি আর প্রযুক্তির মেলাবন্ধনে পরিবেশ ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ভূমিজের মূল লক্ষ্য।
অনেক শহরে এলাকায়, পাবলিক টয়লেট এবং নিরাপদ পাবলিক স্পেসের মতো মৌলিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবহার একটি উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ, বিশেষ করে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য। ভূমিজ বিশ^াস করে সঠিক গবেষণা, জনগণের সম্পৃক্ততা, বাস্তবায়ন এবং অবকাঠামো সেবা গুলোর টেকসই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিরাপদ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক নাগরিক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। আমদের প্রকল্প গুলোতে জনগণকে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে আমরা নিশ্চিত করি যে আমাদের নকশা গুলো যেন জনবান্ধব ও কার্যকরী হয়। আমরা কেবল পরিকল্পনা এবং নকশাই করি না। আমরা প্রয়োজনীয় নির্দেশিকা এবং নীতি পরিবর্তনের জন্য সক্রিয়ভাবে আমাে দর কার্যক্রম উত্থাপন করছি।
ভূমিজ বাংলাদেশে স্বাস্থ্যকর অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সাশ্রয়ী মূল্যের পাবলিক স্যানিটেশন সেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। উন্নত ডিজাইন এবং প্রযুক্তি সক্ষম স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট গুনমান নিশ্চিত করে। ভূমিজ বিশেষভাবে নরী শিশুদের এবং বিভিন্নভাবে স্পেশীলদের যত্ন নেয়। ২০১৭ সালে ভূমিজ তার প্রথম সুবিধা, ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা গাওছিয়া নিউমার্কেট এ শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য একটি টয়লেট প্রতিষ্ঠা করে। ভূমিজ এখন ৪২টি টয়লেট পরিচালনা করছে এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত ০.৫ মিলিয়ন মহিলা সহ ২.৫ মিলিয়ন গ্রাহককে সেবা দিয়েছে। এই সুবিধা গুলো নিম্নআয়ের মানুষের সামগ্রিক স্বাস্থ্য এবং মর্যাদার উন্নতিতে প্রভাব ফেলেছে। এই বছরের মধ্যে নারী ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৩% থেকে বাড়িয়ে ২০% করা হয়েছে। ভূমিজ এ ছাড়াও সিটি কর্পোরেশন, মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সম্প্রদায়, এনজিও এবং বেসরকারি খাতের সাথে খুব ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এখন ভূমিজ এর সুপরিকল্পিত এবং প্রযুক্তি সক্ষম করে অপারেশনাল মডেলটি বাংলাদেশে স্যানিটেশনের সবচেয়ে টেকসই মডেল হয়ে উঠেছে।
ভূমিজ এর পাবলিক স্পেস উদ্যোগ : অনিয়ন্ত্রিত নগরায়নের ফলে ঢাকা শহরে মাত্র ৭৯টি পার্ক এবং খেলার মাঠ সহ ঢাকার খুব কম ব্যবহারযোগ্য এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক পাবলিক স্পেস রয়েছে ১৮ মিলিয়নেরও বেশি নাগিরকের জন্য। এছাড়াও দুর্বল ব্যবস্থানার কারণে তাদের মধ্যে কিছু নিরাপত্তার অভাব রয়েছে যা ব্যবহার যোগ্য নয়। তারা শিশুদের খেলার জায়গা, বসার ব্যবস্থা বা পাবলিক টয়লেট ইত্যাদির মতো উপযুক্ত সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সজ্জিত নয়। তবে পাবলিক স্পেস গুলো শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ঢাকার মতো একটি অপরিকল্পিত মেগা সিটিতে বড় জমি পাওয়া কঠিন হতে পারে এবং বড় প্রকল্প শেষ হতে অনেক সময় লাগে। কিন্তু অভিনব পরিকল্পনায় ফুটপাত ও রাস্তাকে পাবলিক স্পেস হিসেবে চালু করা হয়েছে। এছাড়াও শহর জুড়ে অনেক ছোট ছোট পরিত্যক্ত বা অব্যবহৃত স্থান রয়েছে যে গুলোকে একটি ছোট আকারে পাবলিক স্পেসে রূপান্তর করা যেতে পারে। সেই লক্ষে জল্লাদখানা হত্যা ক্ষেত্র সংলগ্ন একটি অব্যবহৃত স্থানকে প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা দিয়ে পুনরুদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাকার মতো একটি শহরে ২০২৩ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সবার জন্য নিরাপদ, ব্যবহারযোগ্য এবং সবুজ পাবলিক স্পেস থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের জন্য, বয়স্ক এবং প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য।