Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

গিটারের যাদুকর আইয়ুব বাচ্চু

মোহাম্মদ তারেক

মন বিষন্ন থাকলে সাহস করেও বলা যায় না-ভালো আছি। সত্যিই ভালো থাকার কথা নয় যদি সারাক্ষণ হৃদয় জুড়ে রক্তক্ষরণ হয়। ভালো থাকার কতা নয় যদি শিল্পী হতে চাওয়াটা কষ্টের হয়। ভালো থাকার কথা নয় শিল্পী হয়ে বেঁচে থাকাটা যদি সম্মানের না হয়। আসলে পৃথিবীতে শিল্পীরা ঝাঁকে ঝাঁকে জন্মায় না। বারবার আসে না। যারাই আসে, মানুষকে ভালোবাসে নিজেকে উজার করে দেয়। সবশেষে যে কটা দিন বেঁচে থাকার বেঁচে থাকে, হঠাৎ করে চলে যায় অভিমান বুক বেধে। একথা গুলো মৃত্যুর দুই দিন আগে ফেসবুকের নিজের ওয়ালে লিখে গিয়েছিলেন কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। সুরের জাদুতে হাজারো মানুষকে আত্মীয়তার বাঁধনে বেধেছিলেন এই গুণী শিল্পী। আইয়ুব বাচ্চু গেয়েছিলেন এই রূপালি গিটার ফেলে একদিন চলে যাব দূরে, বহু দূরে।
আইয়ুব বাচ্চুর ডাক নাম ছিল রবিন। তিনি জন্মগ্রহণ করেন চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার খরা ইউনিয়নে। সেখানেই কেটেছে তার কৈশোর আর তারুণ্যের দিনগুলো। পরিবারের তেমন কেউ গানের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল তার প্রচন্ড ঝোঁক। অনেকটা নিজের চেষ্টাতেই গায়ক হয়ে ওঠা তার। স্কুলে পড়াকালীন চট্টগ্রামের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। আর তখন থেকেই ওয়েস্টার্ন মিউজিক ভালো লাগতে শুরু করে। সঙ্গীতের প্রেমে পড়ে হাতে তুলে নেন গিটার। শুরু করেন গিটার চর্চা। কলেজে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে আইয়ুব বাচ্চু গড়ে তোলেন একটি ব্যান্ড দল। শুরুতে ‘গোল্ডেন বয়েজ’ নাম দিলেও পরে বদলে রাখা হয় আগলি বয়েজ। এই দল নিয়ে পাড়া মহল্লার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে চলত তাদের গানের পরিবেশনা। পেশাদার ব্যান্ড শিল্পী হিসেবে বাচ্চুর ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। যোগ দেন ব্যান্ডদল ফিলিংস এ। এই ব্যান্ড দলের সঙ্গে সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন হোটেলে পারফর্ম করতেন তিনি।
‘ব্যান্ড ৭৭’ এ কুমার বিশ্বজিৎ এর সহযাত্রী ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। ৪১ বছরের পথ চলা তাদের। তারপর ১৯৭৮ সালে কুমার বিশ্বজিৎ বাচ্চুকে নতুন ব্যান্ড ফিলিংস এ নিয়ে আসেন। ১৯৮২ সালে কুমার বিশ্বজিৎ বাচ্চুকে ফেলে ঢাকায় চলে আসেন। সলো ক্যারিয়ার শুরু করেন। একই বছর বাচ্চু যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস এ। ঢাকায় এসে আবার দুই বন্ধু একসঙ্গে। একই বাসায়, একই খাটে তাদের সংগ্রাম মুখর রাত দিন কাটে। দিন রাত তারা দুজন একসঙ্গে প্র্যাকটিস করতেন। মিউজিক নিয়ে নানা পরিকল্পনা তাদের মধ্য ছিল। ঢাকা-চট্টগ্রামের এমন কোনো জায়গা নাই, অলি-গলি নাই যেখানে সুন্নতে খৎনা থেকে শুরু করে গায়ে হলুদের শো করেননি তারা।
দুজনের পরিচয় ১৯৭৫ সালের দিকে। একই এলাকায় থাকতেন। জুবলি রোডে। দুজনের বাসা কাছাকাছি। দুই পরিবারের কেউ চাইতেন না তাদের সন্তান গান বাজনা করুক। কারণ কেউ কখনও তার সন্তানকে সমুদ্রে ভাসিয়ে দিতে চায় না। তারা দুজনই বাবা মায়ের বড় ছেলে। কে চাইবে মিউজিক করে অনিশ্চিত ভবিষ্যতে ঠেলে দিতে তার সন্তানকে? সেই সময়ে যখন রাত্রি বেলায় শো করে ফিরতেন তখন বাসায় ঢোকা ছিল একটা চ্যালেঞ্জ। তখন দিনে মাগরিবের আগেই বাসায় ঢোকার নিয়ম ছিল। অথচ রাতের দুইটা তিনটা বেজে যেত বাড়ি ফিরতে।
তখন তাদের একমাত্র মিউজিক করার ক্ষেত্র ছিল বিয়ে বাড়ি। ২০/৩০টা বাস ভরে মেহমান আসতো বিয়ে বাড়িতে। তাদের ঘুমানোর জায়গা দিতে পারতো না। তাই গান শুনিয়ে অতিথিদের জাগিয়ে রাখা হতো। বাচ্চুরা টানা গান গাইতেন আগের দিন সন্ধ্যা ৮টা থেকে পরের দিন সকাল ৮টা পর্যন্ত। কেউ বলতো মোহাম্মদ রফির গান করতে, আবার কেউ বলতো মান্না দের গান গাওয়ার জন্য। যা বলতো তাই তাদের গাইতে হতো। একবার এমন একটা অনুরোধ রাখেননি তারা। ভুলে গিয়েছেন হয়তো। সকালে ইন্সট্রমেন্টস গুছাতে গুছাতে বাড়ির জামাইকে বাচ্চু বললেন ভাই আমাদের পারিশ্রমিক? জামাই বললো, আপনারাতো আমার আব্বার অনুরোধের গানটা পরিবেশন করেন নাই। স্যরি ভাই, আপনাদের গিটার, কি-বোর্ড, ড্রামস দিতে পারবো না। আপনারা চলে যান। পরে ওসব ফেলে দুই বন্ধু রিক্সা ভাড়া করে গ্রাম থেকে শহরে ফিরে আসেন খালি হাতে। এই ধরনের কত কষ্টই না তাদের করতে হয়েছে।
আরেক দিনের ঘটনা- আইয়ুব বাচ্চু ও কুমার বিশ্ববিজৎ দুই বন্ধু মঞ্চে উঠে অনুষ্ঠান শুরু করে দিলেন। বেশ ফুরফুরে মেজাজ তাদের। হঠাৎ দেখতে পেলেন একজন দা হাতে নিয়ে তাদের দিকে ছুটে আসছে। সব কিছু ফেলে দৌড় দিলেন তারা। দৌড়াতে দৌড়াতে তাকেই বললেন, ভাই কী হয়েছে? পেছন থেকে ঐ লোক বললেন, আব্বা নামাজি মানুষ। উনি বলছেন গান বাজনা হারাম। তোদেরকে আনছে কে? আজকে তোদেরকে জবাই করে ফেলবো…। এই কথা শুনে বাচ্চু একদিকে দৌড়াচ্ছে কুমার বিশ্বজিৎ আরেক দিকে। পায়ে একজনেরও স্যান্ডেল ছিল না। এই দৌড়ের সঙ্গে পেছনে যুক্ত হয় বাড়ির তিনটা কুকুরও। শেষ সম্বল ইন্সট্রুমেন্টও ফেলে এসেছেন তারা। মিউজিকের জন্য ছিল তাদের অনেক কষ্ট…
পেশাদার ব্যান্ড শিল্পী হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৭৮ সালে। যোগ দেন ‘ফিলিংস’এ। এই ব্যান্ড দলের সঙ্গে সে সময় চট্টগ্রামের বিভিন্ন হোটেলে পারফর্ম করতেন তিনি। ১৯৯০ সালে আইয়ুব বাচ্চু যোগ দেন জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘সোলস’-এ। টানা ১০ বছর সোলস ব্যান্ডে লিড গিটারিস্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন। দেশবরেন্য ব্যান্ড তারকা আইয়ুব বাচ্চুর নেতৃত্বে ১৯৯১ সালে ৫ এপ্রিল নতুন ব্যান্ড হিসেবে যাত্রা শুরু করেছিল এলআরবি। শুরুতে এলআরবির পুরো নাম টি ছিল ‘লিটল রিভার ব্যান্ড’। পরে তা বদলে নাম হয় ‘লাভ রানস ব্লাইন্ড’।
১৯৯২ সালে ব্যান্ডের নামেই বাজারে আসে এলআরবির জোড়া অ্যালবাম এলআরবি-১, ২। এই অ্যালবামের শেষ চিঠি, ঘুম ভাঙা শহরে, হকার গান গুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম ‘সুখ’ ও ‘তবুও বের হয়’। ২৭ বছরে মোট ১৪টি একক অ্যালবাম প্রকাশ করেছে এলআরবি। এই দীর্ঘ সময় ধরে এলআরবি বেশ কিছু জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছে শ্রোতাদের। বাচ্চুর কণ্ঠে উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছেÑ সেই তুমি, রুপালি গিটার, ফেরারী মন, এখন অনেক রাত, তারা ভরা রাতে, বাংলাদেশ সহ আরো অনেক গান। এই গান গুলো এখনো শ্রোতাদের অনেক প্রিয়।
একক ক্যারিয়ারেও সফল আইয়ুব বাচ্চু। অনেক জনপ্রিয় গান রয়েছে তার কণ্ঠে। ১৯৮৬ সালে বাজারে আসে তার একক অ্যালবাম ‘রক্ত গোলাপ’। প্রথম অ্যালবাম খুব একটা সাড়া না পেলেও ১৯৮৮ সালে ‘ময়না’ অ্যালবামে গায়ক হিসেবে আইয়ুব বাচ্চু ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত হয় তার তৃতীয় একক অ্যালবাম ‘কষ্ট’। এই অ্যালবামের প্রায় সব গানই বেশ জনপ্রিয়তা পায়। তারপর ২০১৫ সালে বের হয় তার একক অ্যালবাম ‘জীবনের গল্প’। ব্যান্ড সঙ্গীতের কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু শুধু ব্যান্ড জগতেই দাপিয়ে বেড়াননি। চলচ্চিত্রে প্লেব্যাক শিল্পী হিসেবেও তুলেছিলেন ব্যাপক আলোড়ন। বাংলা চরচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারার গান গুলোর মধ্যে তিনি এনে দিয়েছিলেন তারুণ্যের ছোঁয়া। সিনেমার গান তার গিটারের ঝলকে দেখেছে এক নতুন দিগন্ত। সিনেমায় তার গাওয়া গান গুলোর মধ্যে রয়েছে ‘লুটতারাজ’ ছবির অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে। নিজের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘ব্যাচেলর’ ছবির আমি তো প্রেমে পড়িনি, আম্মাজান ছবির আম্মাজান, সাগরিকা ছবির আকাশ ছুঁয়েছে মাটি, লাল বাদশা ছবির আর আগে কেন তুমি ইত্যাদি।
শুধুমাত্র সঙ্গীত নিয়েই জীবন কাটানো এই গুণী শিল্পী সঙ্গীতের মাধ্যমেই দেশ ও দেশের মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। দেশের প্রতি অফুরান মায়া ছড়ানো এই গুণী শিল্পী ছিলেন তরুণদের কাছে সকল সৃষ্টিশীল কর্মে প্রেরণার উৎস। আর তাই আইয়ুব বাচ্চুর কোনো কনসার্ট মানেই ছিল লাখো তরুণ-তরুণীর হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি।
জীবদ্দশায় বাচ্চু একবার বলেছিলেন, তরুণ বয়সটাই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়। তাই আমি তরুণদের অনেক পছন্দ করি। একথা জোড় দিয়েই বলতে পারি যে তরুণ অথবা তরুণী গান পছন্দ করে সে কখনই জীবনে কোনো অন্যায় কাজে জড়ায় না। একজন পরিপূর্ণ শিল্পীর পাশাপাশি একজন আর্দশ মানুষও ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। ব্যান্ড সঙ্গীতের উন্নয়নে সদা তৎপর ছিলেন। প্রতি বছর ১লা ডিসেম্বর চ্যানেল আই এর উদ্যোগে চ্যানেল আই প্রাঙ্গণে দিনব্যাপি যে ব্যান্ডফেস্ট অনুষ্ঠানটির আয়োজন করা হয় তার অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন আইয়ুব বাচ্চু। আইয়ুব বাচ্চু আমাদের সঙ্গীত জগতের উজ্জ্বল নক্ষত্র। বিশেষ করে ব্যান্ড সঙ্গীতের ক্ষেত্রে তার অবদান ইতিহাসে অমর, অক্ষয় হয়ে থাকবে।