হুমায়ূনের দুই তারকা!

বৃষ্টিস্নাত সকাল। আকাশের মন খারাপ। এই আকাশ মানবিক কোনো চরিত্র নয়। তামাম দুনিয়ার ছাদ। তার মন খারাপ মানে অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামা অথবা দমকা হাওয়ার খেলা চারদিকে। বজ্রপাতসহ বিদ্যুতের চমক ভয় দেখানো পরিবেশ। তবে সেদিন প্রকৃতি এতটা বিরূপ ছিল না। বৃষ্টি ছিল অল্প। তবে আকাশ জুড়ে কালো মেঘের আনাগোনা ছিল। কালো মানেই অন্ধকার। সে কারণে দিনের আলোতেও অন্ধকার ছিল কিছুটা। এমনি বৃষ্টিমুখর দিনে কাজ না থাকলে কে ঘর থেকে বের হতে চায়? আর যদি থাকে গরম খিচুড়ির সঙ্গে হাঁসের মাংশের রান্না তাহলে তো কথাই নেই। আজ কোনো কাজ নেই। শুধুই বিশ্রাম আর খাওয়া দাওয়া…

এমন বৃষ্টিমুখর দিনেও তারা দুজন আনন্দ আলো কার্যালয়ে হাজির। তাও আবার সকাল সাড়ে ৮টায়। শুক্রবার সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আনন্দ আলোর সব বিভাগ বন্ধ। কিন্তু তারা আসবেন বলে রিপোর্টার, ফটোগ্রাফার সকাল ৮টায় অফিসে উপস্থিত। সকাল ৮টায় আনন্দ আলোয় কর্মমুখর পরিবেশ। সবাইকে অবাক করে দিয়ে কাটায় কাটায় সকাল সাড়ে ৮টায় হাজির নন্দিত অভিনেতা ফারুক আহমেদ। ছুটির দিনেও অবসর নাই। উত্তরায় শ্যুটিং আছে। আনন্দ আলো এক আড্ডায় আহŸান জানিয়েছে। আড্ডায় ফারুকের সঙ্গে থাকবেন আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা ডাঃ এজাজুল ইসলাম। কথা হবে নন্দিত নাট্যকার, পরিচালক, কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে। ১৩ নভেম্বর হুমায়ূন আহমেদের জন্মদিন। প্রসঙ্গ তুলতেই দুজনে আবেগে আপ্লুত হয়ে ওঠেন। একসঙ্গে মুখোমুখি কথা বলবেন বলে সিন্ধান্তও নেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় ‘সময়’ নিয়ে। ডাঃ এজাজ পেশায় একজন জনপ্রিয় চিকিৎসক। সম্প্রতি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিভাগের শীর্ষপদে যোগ দিয়েছেন। অভিনয় পাগল এই মানুষটি পেশাগত ক্ষেত্রে দারুণ সৎ। তাই দিনরাত ২৪ ঘণ্টা অভিনয়ে সময় দিতে পারেন না। আর ফারুক আহমেদের পেশাই তো অভিনয়। ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া প্রায় ২৪ ঘণ্টাই অভিনয়ের প্রতিই তার যত ব্যস্ততা। এমন পরিস্থিতিতে আনন্দ আলোর জন্য বাড়তি সময় বের করা দুজনের পক্ষেই একটু কঠিন হয়ে পড়েছিল বৈকি। ফারুক আহমেদই ছুটির দিনের সকালটাকেই বেছে নিলেন। দু’জনে আসবেন সকাল সাড়ে ৮টায়। তারপর আড্ডা চলবে একঘণ্টা। ফটোসেশনসহ আরো ত্রিশ মিনিট। সব মিলিয়ে দেড় ঘণ্টার মামলা।

কাটায় কাটায় সকাল সাড়ে ৮টার মধ্যেই আনন্দ আলো কার্যালয়ে এলেন তারা। দুজনের মধ্যে কুশল বিনিময় চলল কিছুক্ষণ। তারপর শুরু হলো মুখোমুখি আড্ডা। ফারুক আহমেদ ও ডাঃ এজাজুল ইসলাম দুই তারকা মুখোমুখি। হঠাৎ মনে হলো সবার মধ্যমণি হয়ে বসে আছেন নির্মাণের মহান কারিগর হুমায়ূন আহমেদ। ডাঃ এজাজ বিনীত ভঙ্গিতে খুক খুক শব্দ করে একটু কেশে নিলেন। আর ফারুক আহমেদ বিনীত ভঙ্গিতে হুমায়ূন আহমেদের দিকে চেয়ে আছেন।

হুমায়ূন আহমেদ ডাঃ এজাজের দিকে একটু যেন আশঙ্কার চোখে তাকালেনÑ ডাক্তার এভাবে কাশতেছো কেন? তোমার কি শরীর খারাপ?

ডাঃ এজাজ বিনীত ভঙ্গিতে মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, না স্যার… শরীর ভালোই আছে। তবে কাজের প্রেশার বেশি। গভীর রাত পর্যন্ত রোগী দেখতে হয়…

ডাঃ এজাজের কথা টেনে নিলেন হুমায়ূন আহমেদÑ হ্যাঁ, তোমার তো এখন অনেক ব্যস্ততা… ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে যুক্ত হয়েছো। কিন্তু অভিনয়টা ছাড়বা না।

ডাঃ এজাজ হঠাৎ যেন কেঁদে ফেললেন, স্যার অভিনয় তো আমি ছাড়তে পারব না। মনে করেন… হাসপাতালে পেশাগত ব্যস্ততার কারণে হয়তো ৩/৪ দিন কোনো নাটকে অভিনয় করিনি। হঠাৎ অস্থির হয়ে উঠি। আপনি যে কী ম্যাজিক শিখাইছেন আমাদেরকে…

হুমায়ূন আহমেদ এবার ফারুক আহমেদের দিকে তাকালেন, কী ফারুক সাহেব, আপনার খবর কী?

ফারুক হোসেন মাথা নুয়ে কিছুটা বিব্রত ভঙ্গিতে বললেন, আমাকে ‘আপনি আপনি’ করে বলছেন কেন স্যার? তাই একটু কিঞ্চিৎ পরিমাণ ভয় পাইতেছি…

হুমায়ূন আহমেদ হঠাৎ যেন গভীর হয়ে উঠলেনÑ মিয়া তোমাকে তো শুলে চড়ানো দরকার…

ফারুক আহমেদ চেয়ারে বসে ছিলেন। ভয়ের চোটে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালেনÑ আমাকে শুলে চড়াবেন?

কেন, কেন স্যার…? আমি কী দোষ করেছি?

হুমায়ূন আহমেদ যারপর নাই ক্ষুব্ধ হয়ে প্রশ্ন করলেন, তুমি দোষ করো নাই?

না, মানে… এবার ফারুক আহমেদও খুক খুক করে কেশে উঠলেন।

হুমায়ূন আহমেদ এবার সরাসরি ফারুক আহমেদের চোখের দিকে তাকালেন, অয় মিয়া আমার ঈদের পাঞ্জাবি কোথায়? ভুইল্যা গেছ? প্রতিবছর তোমার দেয়া পাঞ্জাবি আমি ঈদে পরি। এবার দেও নাই কেন? এজন্য তোমার শাস্তি হবে… কঠিন শাস্তি…

আনন্দ আলোর ফটোগ্রাফার তৈরি। দুজনের ছবি তুলতে চায়। সে কথা বলতেই আমাদের সবার মধ্যে যে তন্ময়তাটা ছিল সেটা হঠাৎ করেই কেটে গেল। ফারুক আহমেদ বললেন, সত্যি কথা বলতে কী… আমি প্রতিদিনই হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে হাঁটি, চলাফেলা করি। তার সঙ্গে আনমনে কথা বলি। নাটকে নতুন কোনো চরিত্র পেলেই কল্পনায় হুমায়ূন আহমেদের সামনে হাজির হই। তাকে নানা কথা জিজ্ঞেস করি। মাঝে মাঝে উত্তরও পাই।

ডাঃ এজাজ মনোযোগ দিয়ে ফারুকের কথা শুনছিলেন। হঠাৎ প্রসঙ্গ তুললেন এভাবেÑ হুমায়ূন আহমেদ পরপারে চলে গেছেন। এটাই সত্য। কিন্তু তিনি আমাদের মাঝেই আছেন। আমি আমার প্রতিটি কাজে এখনো হুমায়ূন আহমেদকেই পাশে পাই। হয়তো কোনো সংকটে পড়েছি, সামনে মহাঝামেলা মোকাবিলা করতে হবে। তখন হুমায়ূন আহমেদকে স্মরণ করি। এই অবস্থায় হুমায়ূন স্যার হলে কি করতেন? এসব ভেবে ভেবে নিজেকে প্রস্তুত করি। এমনো হয় কোথাও যাচ্ছি, ভাবনার মধ্যে ডুবে আছি, সংকটের সমাধান পাচ্ছি না… হঠাৎ মনে হয় পাশে বসে আছেন হুমায়ূন আহমেদ। সেই পরিচিত কণ্ঠ, কী ডাক্তার… কোনো সমস্যা? এই দিকে আসো…

বাইরে প্রচÐ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। আনন্দ আলোর স্টুডিওতে কিছুক্ষণ ফটোসেশন চলল। তারপর আনন্দ আলো অফিসের ছাদেও চলল ফটোসেশন। আবার দুই তারকা এসে বসলেন মুখোমুখি। প্রশ্ন উঠলো হুমায়ূন আহমেদের নাটকের বিশাল পরিবারকে নিয়ে। সবার সঙ্গে দেখা হয়? যোগাযোগ আছে?

ডাঃ এজাজ বললেন, হ্যাঁ অনেকের সঙ্গেই দেখা হয়। স্বাধীন খসরু আমাদের অনেক প্রিয় বন্ধু। হুমায়ূন আহমেদের নাটক করার জন্যই খসরু বিদেশ থেকে দেশে এসেছিল। আবার সে বিদেশে চলে গেছে। তবে তার সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ আছে। হুমায়ূন আহমেদের আরেকজন প্রিয় অভিনেত্রী শামীমা নাজনীন তার সঙ্গেতো প্রায়ই কোনো না কোনো নাটকের সেটে দেখা হয়।

বর্তমান সময়ের টিভি নাটক নিয়ে আপনাদের মূল্যায়ন কী? প্রশ্ন তুলতেই ফারুক আহমেদ বললেন, সময়ের বিবেচনায় অনেক ভালো নাটক হচ্ছে। কিন্তু এই নাটকগুলো আলোচনায় আসছে না। হুমায়ূন স্যার তার নাটকের একটা ধারা স্টাবলিশ করেছেন। অনেকে সেই ধারার নাটক বানাতে গিয়ে খেই হারিয়ে ফেলছেন।

ডাঃ এজাজ বললেন, ফারুক ভাইয়ের কথার সঙ্গে আমি একমত। বর্তমান সময়ে অনেক ভালো টিভি নাটক হচ্ছে। অনেক তরুণ নির্মাতা ভালো নাটক বানাচ্ছেন। তবুও কোথায় যেন একধরনের অস্থিরতা রয়ে গেছে। এটা দূর করতে হবে।

তারপর দু’জনের মধ্যে শুরু হলো মুখোমুখি আড্ডা। প্রিয় পাঠক, এই আড্ডার আদ্যোপান্ত পরবর্তি যে কোন সংখ্যায় প্রকাশ হবে। ভালো থাকবেন সকলে।

  • সাক্ষাৎকার