মানুষ হিসেবে মর্যাদা চাই

আজমেরী হক বাঁধন

বাংলাদেশে তখন রাতের শেষ লগ্ন। প্যারিসে দিনের শেষ ভাগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই বাঁধনের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলাম। সহজেই পাওয়া গেল বাঁধনকে। ভেবেছিলাম কান উৎসবের আবহ হয়তো তাকে বদলে দিয়েছে। যতই পরিচয় থাকুক বাঁধন তো এখন অনেক ব্যস্ত, জনপ্রিয় তারকা। দেশের প্রচার মাধ্যম তো বটেই আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমেও আজমেরী হক বাঁধনকে নিয়ে ব্যাপক হইচই শুরু হয়েছে। কতজনের সাথেই না তাকে কথা বলতে হচ্ছে। এমন ব্যস্ত পরিস্থিতিতে বাঁধন কি আমার ফোন ধরবে? কিন্তু অবাক হলাম বাঁধনের আন্তরিকতার ছোঁয়া পেয়ে। এতটুকু অহংকার নেই। ব্যস্ততাও দেখাল না। বরং খুশি হয়ে জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া কেমন আছেন? আবেগ ধরে রাখতে পারলাম না। কুশল বিনিময় হলো। বাঁধনকে জিজ্ঞেস করলামÑ অভিনয়ের ক্ষেত্রে তোমার নতুন জীবন শুরু হলো। ফিল্ম দুনিয়ায় হইচই ফেলে দিয়েছো। কেমন লাগছে? কেমন এনজয় করছো? একটু ভাবলো বাঁধন। তারপর বলতে শুরু করলো তার মনের কথা। ‘এটা তো এনজয় করারই কথা। কিন্তু সত্যি বলতে কী, আমি আসলে ওই ভাবে আনন্দ উপভোগ করতে এখন আর পারি না। প্রথমত এতো আনন্দ আসলে কিভাবে উপভোগ করতে হয় সেটা আমি জানি না। এটা হয়তো বলে বোঝাতে পারব না যে, আমার ওই মুমেন্টে অর্থাৎ আমাদের ছবিটা যখন কান ফেস্টিভ্যালের আঁ সাত্রে রিগা বিভাগে প্রদর্শনের পর আমার কেমন লেগেছে। আমরা যখনই এই কাজটা করি, বিশেষ করে গত বছরই আমরা জানতাম কান অথবা ভেনিসে আমাদের ছবি যাবে। ভেনিস উৎসবে আমরা সিনেমাটা জমা দেইনি। আমরা কান নাকি ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে ফিল্মটা জমা দিব এ নিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্ব ছিল। কারণ দুই জায়গা থেকেই অফার ছিল অফিশিয়াল সিলেকশনের এবং দুই জায়গা থেকেই বলা হচ্ছিল আমরা যেন ফিল্মটা জমা দেই। কাজেই গত বছর থেকেই আমি জানি বা বুঝতে পারছিলাম যে আমাদের সিনেমটা ফিল্ম দুনিয়ায় একটা আলোড়ন তুলবে। কারণ বাংলাদেশে এর আগে এমন কাজ আর হয়নি।

বাঁধন কথা বলেই যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম রেহানা মরিয়ম নূর এর পরিচালক সাদ এর ব্যাপারে। সাদ এর সাথে পরিচয়ের গল্পটা কেমন? বাঁধন এবার একটুও সময় নিল না। বলল, গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং। রেহানা মরিয়ম নূর এর জন্য আমাকে যখন ‘নক’ করা হয় তখন আমি পরিচালক সাদকে চিনতাম না। আমাদের কাস্টিং ডিরেক্টর ইয়াসির আমার সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। ছবিতে ও আমার ভাইয়ের চরিত্রে অভিনয়ও করেছে। ও যখন আমাকে ‘নক’ করে তখন আমি ওদের সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতাম না। এর আগে সাদের সাথে আমি একটা কাজ করেছিলাম। তখন ওর সাথে তেমন ইন্টার‌্যাকশন হয়নি। কারণ সাদ এতই আড়ালে থাকতে পছন্দ করে যে কাজের বাইরে তার সাথে কোনো ইন্টারঅ্যাকশনই হতো না। আমি যে সময়ের কথা বলছি তখন জীবিকার প্রশ্নে আমি মাসে ২০/২২ দিন কাজ করেছি। অনেক ডিরেক্টরের নামও জানতাম না। অনেকের চেহারাও মনে রাখতে পারতাম না। সময়ও ছিল না এত কিছু ভেবে কাজ করার। জীবিকা নির্বাহের জন্যই কাজটা করতাম। ফলে সাদ এর সাথে আগে কোন স্ক্রীপ্টে কাজ করেছি তা মনে করতে পারছিরাম না। ওর ‘লাইফ ফ্রম ঢাকায়’ কাজ করেছি। আমি যখন ইয়াসিরের সাথে দেখা করতে গেলাম তখন ও আমাকে লাইফ ফ্রম ঢাকার ট্রেলারটা দেখাল। দেখে আমি বুঝলাম নতুন পরিচালক সাদ ডিফারেন্ট একটা কাজ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সাদের সাথে তো আমার সেভাবে যোগাযোগ নাই। ওরা নতুন প্রজেক্ট সম্পর্কে আমাকে অবগত করল। আমি ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজে ওরা যে কাহিনীকে বেছে নিয়েছে সেটা কি আদৌ নির্মাণ করা সম্ভব? মেয়েদের দৃষ্টিতে আমরা তো আমাদের সমাজকে দেখি না। দেখতেও চাই না। ওই সাহসটা আমাদের এখানে ছেলেরা কখনই করে না। আর মেয়েরাতো করেই না। সবাই আসলে সেইফ সাইডে থাকতে চায়। মেয়েদের চোখে সমাজ তো হলো আসলে কুৎসিত। ওই কুৎসিত সমাজ অথবা ওই সাপোকেশন, ওই নিপীড়ন সিনেমার পর্দায় দেখানোর সাহস অনেকেই করতে চায় না। এই বাস্তবতায় আমি আসলে রেহানা মরিয়ম নূর এর মতো সাহসী স্ক্রীপ্ট পাব তা আশা করিনি। কিন্তু কোথায় থেকে যেন একটা সাহস এসে ভর করলো আমার মাঝে। যেহেতু নতুন ভাবে কাজ করতে যাচ্ছি।, এর আগে বলেছিলাম যে আমার জীবনের ৩৪ বছর অন্যের জীবন যাপন করেছি। আমি এখন আমার মতো করে জীবন যাপন করতে চাই। আমি আমার মতো করে কাজ করতে চাই। এমন কিছু চরিত্রে অভিনয় করতে চাই যে চরিত্রের মাধ্যমে আমি বেঁচে থাকবো মানুষের মনের মধ্যে। এই ভাবনার কথা গুলো আমি বলেই যাচ্ছিলাম। আল্লাহর কী রহমত, আমি যা চেয়েছিলাম তাই পেলাম। আমাদের মাথার ওপর একজন আছেন। তিনিই কিন্তু আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করেন। আমার নিয়ত সৎ ছিল।

রেহানা মরিয়ম নূর এর জন্য আমার ‘লুক’ টেস্ট করা হলো। মনে হলো পরিচালক সহ পুরো টিম আমার গ্লামারের ভেতরে, আমার সৌন্দর্য্যরে ভিতরে একটা ব্রোকেন সোল দেখতে পায়। এটা কিন্তু অনেক গুরুত্বপুর্ণ একটা পয়েন্ট। চরিত্রটা নিয়ে অনেক আলোচনা হয় আমাদের মধ্যে। আমি শুরুর দিকে একটু দ্বিধাগ্রস্থ ছিলাম। আমাদের প্রিয় পরিচালক সাদ তখন একটা কথাই বলেছিল, শোনো তুমি যদি এই চরিত্রটা না করো তাহলে এটা আর কেউই করতে পারবে না। এই চরিত্রটা তোমার জন্যই… সাদ এর বিশ্বাস ছিল যে রেহানার চরিত্রটা একমাত্র আমিই করতে পারব। এটা ও বিশ্বাস করলেও আমি করতাম না। কারণ আমার ব্যক্তিগত জীবন এতটাই বিপদগ্রস্থ, বিপর্যস্ত ছিল যে আমি ত্রুনিক ডিপ্রেশনের পেশেন্ট হয়ে গিয়েছিলাম। তবুও সাদ আমার ওপর বিশ্বাস রেখেছিল।

কান ফেস্টিভ্যালে আমাদের ছবি প্রদর্শনের পর থেকে যে ধরনের প্রশংসা পাচ্ছি তাও আমি ঠিকমতো নিতে পারছি না। নতুন করে ডিপ্রেশনের অ্যাটকে হয়েছে। আমি আবার মেডিটেশন শুরু করেছি। থেরাপিও নিচ্ছি। মেডিসিনও খেতে হচ্ছে।

বাঁধনকে থামিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তার মানে সিনেমার গল্পের সাথে আরও একটি গল্প শুরু হয়ে গেছে। তাই নয় কী? বাঁধন বলল, রেহানা মরিয়ম নূর এর গল্পে আমি যেন নিজেকেই খুঁজে পাচ্ছিলাম। সে কারণে স্যুটিং এর সময়ও আমি অনেক ডিপ্রেশনের মধ্যে ছিলাম। রেহানা চরিত্রের সাথে আমার মিলেমিশে যাওয়ার ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপুর্ণ। আমি আসলে রেহানার মতো নই বাহ্যিক ভাবে। কিন্তু রেহানা চরিত্রটা প্রতিটা সংগ্রামী মেয়ের জীবনের স্পন্দন। প্রতিটা মেয়ের সাপোকেশন। রেহানা প্রত্যেকটা মেয়ের জীবনের ভেতরের সাপোকেশন। এই ছবিতে অনেক গুলো নারী চরিত্র আছে। যে চরিত্রগুলোকে প্রত্যেকটা মানুষ চিনে। এটা অন্য লেবেলের একটা সার্বজনীন গল্প।

কান’এর আ সাত্রে রিগা বিভাগে যখন আমাদের ছবির প্রদর্শনী শেষ হলো তখন দর্শকের হাত তালি থামছিলোই না। আনন্দে আমি কেঁদে চলেছি। সাদ সহ অন্যান্যরা আমাকে সান্ত¦না দিচ্ছে। দর্শক হাততালি দিয়ে আমাকে অভিবাদন জানাচ্ছে। এমন সময় দেখলাম একজন ফরাসী ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে সেও কাঁদতে শুরু করল। তিনি আমাদের ভাষা বোঝেন না। আমাদের সংস্কৃতি সম্পর্কে তার কোনো ধারনা নাই। কিন্তু তিনি রেহানার চরিত্রের মাঝে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন। তিনি রেহানার জীবনের পেইনটা আমার অভিনয়ের মাঝে দেখতে পেয়েছেন। এই পেইনটা আমারও। আমার বলছি এই জন্য যে, রেহানার জীবনের লড়াই আর আমার জীবনের লড়াই অনেকটা একই রকম। সব চেয়ে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হলো ছবি শেষ হবার পরও আমার ডিরেক্টর দেশে আমাকে ছবিটা দেখতে দেয়নি। বার-বার বলেছে কান-এ গিয়ে দর্শক সারীতে সবার সাথে বসে তুমি ছবিটা দেখবে। উৎসব আয়োজনে ছবিটা যতক্ষণ চলেছে ততক্ষনই আমি কেঁদেছি। ছবির যে সব দৃশ্যে অভিনয় করতে কষ্ট হয়েছে, যে সব জায়গায় আমার সাপোকেশন হয়েছে সে গুলো দেখে আমি নিজেকে সংবরণ করতে পারছিলাম না। ছবির স্যুটিং চলাকালে এমনও দিন গেছে যে আমরা সারাদিনে একটা মাত্র দৃশ্য স্যুট করেছি। কারণ অভিনয়ের সময় যে যন্ত্রনা অনুভব করেছি তখন আমাকে সামলানোই মুশকিল হয়ে পড়েছিল। এমনও অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে একটি দৃশ্যে অভিনয় করার পর যন্ত্রনাটাকে রিকভার করতে ২ দিনও সময় লেগেছে। এজন্য আমার পরিচালক সহ পুরো টিমের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে তারা আমাকে অভিনয় করার সকল পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছিলেন। যে কারনে বোধকরি আমি রেহানা হতে পেরেছি। কান উৎসবে ছবিটা প্রদর্শনের পর আমাদের পুরোটিম সাথে সাথে বাংলাদেশের নাম সবার মুখে মুখে ছড়িয়ে যায়। এরপর থেকেই যখনই কারও সাথে দেখা হচ্ছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করছে তুমি আজমেরি হক বাঁধন না? তুমি রেহানা? তোমার অভিনয় অনেক ভালো হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো আমি তো এখানে রেহানার লুক’এ বের হচ্ছি না। তবুও লোকজন আমাকে সহজেই চিনে ফেলছে। এগিয়ে এসে আমার সাথে ছবি তুলছে। নানা কথা জিজ্ঞেস করছে। রাস্তায় আমি হাটছিলাম। হঠাৎ একজন মহিলার সাথে আমার ধাক্কা লেগে যায়। আমি তাকে স্যরি বলতে থাকি। আমার দিকে তাকিয়ে সে তো অবাক। খুশি হয়ে বলে, নো স্যরি। ইউ আর রেহানা… ওহ মাই গড… রেহানা চরিত্রের সাথে সবাই এতটাই মিশে গিয়েছে যে আমাকে চিনতে তাদের মোটেই কষ্ট হচ্ছে না। এজন্য আমি আমাদের ডিরেক্টর সাদকে আরেকবার ধন্যবাদ জানাতে চাই।

বাঁধনকে আবার থামিয়ে দিলাম। বললাম ডিরেক্টরের প্রসঙ্গ যখন উঠলো তখন তার সম্পর্কে একটু জানতে চাই। তোমাদের ডিরেক্টর আসলে ফোকাস হতে চান না কেন?

বাঁধন একটু ভেবে নিয়ে বলল, আমি তাকে যতটুকু দেখেছি, রেহানা চরিত্রের জন্য যখন সে আমার ‘লুক’ টেস্ট করেছে তারপর দুই মাস কিন্তু আমার সাথে কোনো কথা বলে নাই। আমি তার অফিসে যেতাম। কিন্তু তার সাথে দেখা হতো না। অন্যদের সাথে দেখা হতো। তাদের সাথেই কথা বলতাম। আমাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর সহ অন্যান্যরা আমার সাথে গল্প করতো। আমাকে নানা কথা জিজ্ঞেস করতো। ওই সিচুয়েশনে কি করেছেন? কিভাবে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন। জীবনের এ ধরনের আর কোনো অভিজ্ঞতা আছে কিনা জানতে চাইত। সাদ মাঝে মাঝে আমাদের আলোচনায় থাকতো। কিন্তু কিছু বলতো না। চুপ করে শুনতো। এভাবেই আমি তাকে জানার চেষ্টা করলাম। আমি ওর ‘লাইফ ফ্রম ঢাকা’ সিনেমাটা দেখলাম। ছবিটা দেখে আমি অভিভূত। সেদিনই সিদ্ধান্ত নেই আর কোনো কাজ করব না। রেহানার জন্যই নিজেকে তৈরি করব। গত ৩ বছরে যে পরিমান কাজের অফার আমি পেয়েছি সে ধরনের কাজের অফার বাকী জীবনেও পাইনি। অনেক কাজের অফার পাওয়ার পরও আমি লোভটা সংবরণ করেছি। আমি যেদিন সাদ এর প্রথম সিনেমাটা দেখি তখনই বুঝে নিয়েছিলাম যে রেহানা আমাকে হতেই হবে। এই সুযোগ আমি আর জীবনে পাব না। বাংলাদেশে এই সুযোগ আমাকে আর কেউ দিবে না। বাংলাদেশে মেয়েদের জীবন নিয়ে গল্প কেউ লিখতে চায় না। নির্মাণ করতেও চায় না। আমরা কি করি? সব সময় সমাজকে পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে দেখি। এটাই নর্মাল আমাদের সোসাইটিতে। পৃথিবীতেও তাই হচ্ছে। এটাকে নিয়েই ফাইট হচ্ছে। একটা নারীর দৃষ্টিতে সমাজকে দেখা খুবই কঠিন। কারণ ব্যাপারটাতো কুৎসতি। সেই কুৎসিত জিনিসটাকে আমরা তো ফিল করতে চাই না। গুরুত্ব দিতে চাই না। যত দোষ নারীর বেলায়। নারীর জন্য সমাজ খুব ভালো রোল প্লে করে না। এই যে ‘না’ এই যে দ্বন্দ্ব, এই যে সাপোকেশন এটা দেখানোর সাহস থাকতে হবে তো। এটা কিন্তু বুঝতেও হবে।

বাঁধনকে এবার প্রশ্ন করলামÑ কান ফেস্টিভ্যালে রেহানার প্রদর্শনীর পর সাদ কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে?

বাঁধন আগের প্রসঙ্গটাই শেষ করতে চাইল। বলল, সাদ নারীর এই অস্থিরতাটাকে ভালো ভাবে বুঝতে চেষ্টা করেছে। ওর প্রথম ছবি লাইফ ফ্রম ঢাকা মুক্তির ৩ দিন পর সিনেমা হল থেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল। কারণ সিনেমাটি কেউ দেখতে চায়নি অথবা সিনেমাটির ব্যাপারে দর্শকের সাড়া মেলেনি। ওই সময় আমি খুব কষ্ট পেয়েছি। সাদ সহ ওর টীমের সবাইকে জিজ্ঞেস করেছিলামÑ এটা আসলে কি হল? একটি ভালো সিনেমা এভাবে হল থেকে নেমে যাবে? সেদিন সাদ আমাকে একটা কথা বলেছিল যা আজও আমার মনের ভেতর গেথে আছে। ও বলেছিল, আমার জন্য এটা গুরুত্বপুর্ণ নয় যে আমার সিনেমা কত মানুষ দেখেছে। তবে আমার জন্য এটা গুরুত্বপুর্ণ যে, যে মানুষটা দেখেছে সে কত বছর আমার সিনেমার কথা মনে রাখবে। সাদ এর এই কথার মর্মার্থ বোঝার ক্ষমতা সবার হবে কি না জানি না। আমিও তখন বুঝি নাই। ভেবেছিলাম যে ও কি বলে? কিন্তু আমি যখন ওর সাথে আস্তে আস্তে মিশতে শুরু করলাম, আস্তে আস্তে রেহানাকে জানতে চেষ্টা করলাম, ইনডেপথ আমি যখন ওদের কাজের সাথে যুক্ত হলাম তখন আমি বুঝলাম ওদের অনেস্টও কাজের প্রতি ভালোবাসাটা কেমন। ওরা চাকচিক্যে বিশ্বাসী না। ওরা কোনো প্রচারে বিশ্বাসী না। আমি দেড় বছর কোনো কাজ করি নাই। আমাকে বলতে দেয় নাই যে আমি আসলে কি করছি। সাদ শুধু আমাকে একটা একটা কথা বরেছে, বাঁধন কেউ জানবে না তুমি আসলে কি করছ? তখন আমি একটু অবাক হয়েছিলাম। কিন্তু ‘রেহানা’ শেষ করার পর বুঝতে পারি সাদ কেন আমাকে একথা বলেছে।

এবার সাদ এর কথায় আসি। অনেকের প্রশ্ন সাদ কেন মিডিয়ার সাথে কথা বলতে চায় না। সাদ আসলে এমনই। কাজের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করে। ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় নয়। ও কাজের মধ্যেই থাকতে পছন্দ করে। সাদ এর সম্পর্কে আপনি যদি সবটা জানেন তাহলে আকাশ থেকে পড়বেন। এরকম একটা প্রতিভাধর ছেলে যে ধরনের লাইফ লিড করে শুনলে অবাক হবেন। ও যে রকম বাসায় থাকে… একটা মজার কথা বলি। আমি যখন ওর সাথে একটু একটু করে কানেকটেড হতে শুরু করি দেখতাম ছেলেটা একই রঙের টিশার্ট পড়ে প্রতিদিন। পরে জানলাম ও একই রঙের টিশার্ট পড়ে প্রতিদিন। কালো টিশার্ট ৪/৫টা হয়তো আছে। ধুয়ে ধুয়ে ওই পাঁচটাই ব্যবহার করে। এটা কিন্তু কাউকে দেখানোর জন্য নয়। ওকে আমি গত ৩ বছর যাবৎ দেখছি। ২০১৯ সালে আমি ওকে একটা মেইল করেছিলাম। মেইল এর লাস্ট লাইন ছিল “আমি সারা জীবন তোমার কাছে কৃতজ্ঞ থাকব আমাকে ইতিহাসের অংশ বানানোর জন্য। কারণ আমি জানতাম ‘রেহানা মরিয়ম নূর’ একটা ইতিহাস হতে যাচ্ছে। তবে এত বড় হিস্ট্রি হবে সেটা বুঝতে পারিনি। সত্যি কথা বলতে কী সাদ ও তার টীমের লোকজন খুবই অনেস্ট। ওদের মধ্যে কোনো চাকচিক্য নাই। ভনিতা নাই। খুবই সিম্পলভাবে ওরা কান ফেস্টিভ্যালে এসেছে। এত প্রশংসার পরও কারও চেহারায় অহংকার নাই।

কথায় কথায় বাঁধনকে তার মেয়ের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলাম। তোমার এই যে অর্জন, তোমার আদরের মেয়ের অনুভূতি কি? বাঁধন এবার একটু সময় নিল। একটু যেন আবেগ প্রবণ হয়ে উঠেছিল। পরক্ষনেই কলকলিয়ে হেসে ফেলল। বলল, সে খুব প্রাউড। আমার বাবা-মা বলেছে তুমি তো আমাদের মেয়ে নও। তুমি শুধু সায়রার মা! সায়রা তো প্রাউড হয়ে শেষ… যে আমার মা এত বড় সাফল্য অর্জন করেছে। সত্যি কথা বলতে কী আমার জীবন সংগ্রামে, আমার এই চরিত্র ধারন করার পিছনে আমার সন্তানের ভূমিকা অপরিসীম। আমার সন্তানের সাথে আমার সম্পর্ক, সন্তানকে নিয়ে আমার জীবনের লড়াই যদি না থাকতো তাহলে আমি বোধকরি সিনেমায় রেহানাকে যথার্থ ভাবে পোট্রেট করতে পারতাম না। রেহানায় আমি আসলে অ্যাক্ট করি নাই। রিঅ্যাক্ট করেছি। আমি আমার ক্ষতগুলোকে ওপেন করেছি। আমার মেয়ে এব্যাপারে আমাকে অনেক সহযোগিতা করেছে। কান-এ আমাদের ছবির প্রদর্শনীর পর প্রচার মাধ্যমের হইচই দেখে ও আমাকে শুধু একটা কথা বলেছে, আই অ্যাম সো প্রাউড অব ইউ মা। ইউ রক… বলেই প্রাণ খুলে হেসে ফেলেন বাঁধন।

এবার তাকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে একটা প্রশ্ন করলাম। এত সাফল্য। এবার সামনে কিভাবে এগুতে চাও?

বাঁধন বলল, ২০১৯ সালেই আমি আমার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিলাম। সেই সিদ্ধান্ত হচ্ছে যে, আমি এত বছর অন্যের জীবন যাপন করেছি। ৩৪ বছর অন্যের জীবন যাপন করতে হয়েছে। আমি শুধু নারী হতে চেয়েছি। সমাজের বুকে আদর্শ নারীর হতে চেয়েছি। এবং এই চেষ্টায় আমি পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছি। তবে এই ব্যর্থতা আমার জীবনের আশির্বাদ বয়ে এনেছে। কারণ আমি যদি এই নারী হতে ব্যর্থ না হতাম, সমাজের ছকে বাঁধা আদর্শ নারী হতে ব্যর্থ না হতাম তাহলে আমার এই চেষ্টা করতে করতেই মৃত্যু হতো। যে মৃত্যুটা আসলে শুধু বাংলাদেশের নয়। পৃথিবীর বেশীর ভাগ নারীর ক্ষেত্রেই হয়। নারী নয় আমি আসলে মানুষ হতে চাই। এবং মানুষ হিসেবে আমার সম্পুর্ন অধিকার চাই। আমি স্বাধীন ভাবে বাঁচতে চাই। আমি আমার জীবন আমার মতো করে যাপন করতে চাই। সেই চাওয়ার একটা অংশ হচ্ছে আমি আমার মতো কাজ করতে চাই। আমি কি করব, কি করব না সেটা কেউ নির্ধারণ করে দিবে না। এখন আমার কথা হয়তো মানুষের কাছে মূল্যবান মনে হচ্ছে। কিন্তু এতদিন আমার কথা গুলোকে পাগলের প্রলাপ হিসেবে দেখা হয়েছে। বলা হয়েছে,. দেড় বছর ধরে কি এমন কাজ করতেছ? কি এমন ঢং এর কাজ? কি এমন কাজ? এগুলা কি কাজ? এতো গ্ল্যামার দিয়ে কি হবে? বয়স চইল্যা যাইতেছে…

আমি আমার বয়স লুকাতে চাই না। বয়স আমার সৌন্দর্য। কেন বয়স লুকাবো? আমার বয়স এখন ৩৭ বছর। আমার বয়স অনুযায়ী চরিত্র লেখা হবে। আমার বয়স অনুযায়ী চরিত্র লিখতে না পারাটা রাইটার ও ডিরেক্টরের ব্যর্থতা। এটা আমার ব্যর্থতা নয়। কাজেই এর দায়ভার আমার নয়। দৃঢ় গলায় আবারও বলি আমার বয়স অনুযায়ী চরিত্র লিখতে হবে। আমি যদি সেটা করতে পারি তাহলে করব। না হলে অন্যকেউ করবে। আমি আসলে নারী নয় মানুষ হতে চাই। এবং সম্পুর্ন মানুষ হিসেবে সমাজ আমার ন্যায্য অধিকার চাই। আমি আমার স্বাধীনতা চাই।

বাঁধনের কাছে এবার প্রশ্ন ছিল, তুমি এর আগে একাধিখ সিনেমায় অভিনয় করেছ। কিন্তু কোনো কোনো সাক্ষাৎকারে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। এটা কেন?

উত্তরে বাঁধন বলল, না এটা সত্য নয়। এর আগে একাধিক সিনেমায় আমি কাজ করেছি। একথা বলেছি। এও বলেছি যে, আমি মাসে ২২ থেকে ২৫ দিন শ্যুটিং করার মানুষ। তবে আমি বলেছি রেহানার মতো এই রকম উল্লেকযোগ্য কোনো কাজ আমি করিনি। আমি কলকাতার সৃজিত মুখার্জির কাজের কথাও কিèতু কোথাও বলিনি। কারণ ওইটাও আমার কমার্শিয়াল কাজ। ওই কাজ আমার প্রাণৈর কাজ নয়। পিপলু আর খানের একটি কাজ করেছি। হ্যা ওইটা আমার প্রাণের কাজ। কেন এটাকে প্রাণৈর কাজ বললাম দেখলেই বুঝবেন। সব কাজ তো আর প্রাণের কাজ নয়। টাকার জন্য আমাকে অনেক কাজ করতে হয়েছে। কেউ যদি মনে করেন আমার অন্যান্য কাজের সাথে রেহানা মরিয়ম নূরকে মিলিয়ে ফেলব। ওই বোকামিটা আমি করব না। আমি সৃজিতের কাজকেও এর সাথে মিলাতে চাই না। আমি যখন সৃজিতের কাজটা করে দেশে ফিরি তখনও অনেকে আমাকে প্রশ্ন করেছে এটাই আমার সেরা কাজ কি না। আমি রেসপন্স করিনি। খেয়াল করলেই দেখবেন আমি আমার প্রতিটা ইন্টারভিউতে বলেছি আমার অভিনয় জীবনের সেরা কাজ হলো আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ সাদ এর ‘রেহানা মরিয়ম নূর’।

বাঁধনের কাছে শেষ প্রশ্ন ছিল এমনÑ আজকের এই আনন্দময় দিনে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতার কথা কি মনে পড়ে?’

বাঁধন একটুও ভাবল না। সাথে সাথে উত্তর দিল এভাবেÑ রেহানা মরিয়ম নূর’ এর সাফল্য সংবাদ আমি প্রথম দিয়েছিলাম চ্যানেল আই এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর আংকেলকে। একই সাথে আমি নওশাদ করিম চৌধুরীকেও ফোন করেছি। আমি সেবার লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছিলাম তখন নওশাদ ভাই ইউনিলিভারের কান্ট্রি হেড ছিলেন। আমার ফোন পেয়ে নওশাদ ভাই ও সাগর আংকেল আমাকে বলেছেন, আমরা সব চেয়ে খুশি হয়েছি যে, তুমি তোমার রুটটাকে ভোলো নাই। আমি কিন্তু তাদেরকে ফোন করে আমার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছি। একটা কথা আবারও স্পষ্ট করে বলতে চাই আজকে আমি এই যে বাঁধন সাফল্যের যে জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি সেজন্য সব চেয়ে বেশী অবদান যে প্লাটফর্মটার সেটা হচ্ছে লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার ২০০৬। ওই মুহূর্তে তারা যদি আমাকে সাপোর্ট না দিত তাহলে আজ আমি কোথায় থাকতাম জানি না। আজ অনেকের কথা মনে পড়ছে যারা আমার দুঃসময়ে পাশে দাঁড়িয়ে হাত ধরে সাহস ও প্রেরনা দিয়েছে। তাদের অনেকের সাথে আমার যোগাযোগও নাই। নওশাদ ভাই আমার ফোন পেয়ে অবাক। জিজ্ঞেস করলেন, বাঁধন তুমি আমার নাম্বার পেলে কোথায়? আমি তখন তাকে বলেছিলাম ভাইয়া আমি তো আপনাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সাগর আংকেলকেও খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে কনা রেজা আমার কনা আন্টিকে ফোন করি। এরাই তো আমার প্রেরনার মানুষ। কান ফেস্টিভ্যালে রেহানা মরিয়ম নূর আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। এই আনন্দ সংবাদ প্রিয়জনকে জানাব না তা কি করে হয়?

  • সাক্ষাৎকার