মিথিলা ফারজানা। সাংবাদিকতা, সংবাদ উপস্থাপনা এবং টক-শো সঞ্চালক। মিডিয়ার বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। বর্তমানে একাত্তর টেলিভিশনে সিনিয়র প্রেজেন্টার হিসেবে কর্মরত আছেন। ‘একাত্তর জার্নাল’ এর সঞ্চালনা করে থাকেন তিনি। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষকতা করছেন মিথিলা ফারজানা। পেশাগত জীবনের নানান দিক নিয়ে কথা বলেছেন আনন্দ আলোর সঙ্গে। লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল।
আনন্দ আলো: প্রায় প্রতিদিন টেলিভিশনের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করেন। চ্যালেঞ্জটা কেমন থাকে?
মিথিলা ফারজানা: চ্যালেঞ্জ তো অবশ্যই থাকে। এজন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয় প্রতিনিয়ত। প্রতিদিন কোন বিষয়ে নিয়ে আলোচনা হবে অতিথি থাকবেন কে? পাশাপাশি সারাদিনের ঘটনা কিংবা আলোচিত ঘটনা সবকিছুতে নিজেকে আপডেট রাখতে হয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে অভিজ্ঞতা। একটা কথা না বললেই নয় তা হলো আমি সকলের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি- অনেক সময় অনেক টক-শো সঞ্চালককে দেখেছি- সুন্দর, হ্যান্ডসাম, স্মার্ট, বাচনভঙ্গি ভালো, ক্যামেরা ফেস ভালো- কিন্তু অভিজ্ঞতা কিংবা তার তথ্যভাণ্ডার একদমই ফাঁকা থাকায় আলোচনাটা জমাতে পারেন না। ফলে দর্শক তার প্রোগ্রাম দেখে মজা পায় না। অনুষ্ঠানে তথ্য ঠিকমতো সরবরাহ করা না গেলে দর্শক বিভ্রানত্ম হয়। তাই এই বিষয়গুলোর দিকে নজর দেই।
আনন্দ আলো: একজন টক-শো সঞ্চালক বা উপস্থাপক তৈরি হওয়ার জন্য তো নিজেকে ছাত্রজীবন থেকেই প্রস্তুত হতে হয়…
মিথিলা ফারজানা: অবশ্যই। অনেক মজার টপিক এটা। আমি এ নিয়ে কথা বলতে চাই। আমি স্কুল জীবন থেকে প্রতিযোগিতা মূলক এমন কোনো কাজ নেই যে করিনি। আবৃত্তি, বক্তৃতা, রচনা প্রতিযোগিতা, দেয়াল পত্রিকা প্রকাশ, প্রভাত ফেরিতে যাওয়া, বই পড়া সবই করেছি। আমার কাছে এখনো মনে হয়- আমি বড়ই হয়েছি বইমেলায়। বাবার সাথে বইমেলায় যাওয়া, বন্ধুদের সাথে বৈশাখের প্রথম দিন রমনার বটমূলে যাওয়া, ছায়ানটে যাওয়া সবই করেছি। ফলে আমার গ্রুমিংটা কিন্তু ঐখানেই হয়েছে। আমি তখন জানতাম না ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা কিংবা সংবাদ উপস্থাপনা কিংবা টক-শো সঞ্চালনার কাজ করবো।
স্কুল-কলেজে পড়ার সময় লেখালেখির প্রতি সখ্যতা ছিলো। নিজের সংস্কৃতির সঙ্গেই হেঁটেছি। এসব এখন অনেক কাজে লাগছে। অনেক কিছু শিখেছি যেটা পরবর্তীতে নিজেকে তৈরি করতে সহায়তা করেছে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে নিজেকে প্রগতিশীল মানুষ হিসেবে তৈরি করাটা জরুরি। এটা অবশ্য এমনি এমনিভাবেই হয়ে যায় না। পরিবার, বন্ধু-বান্ধব এবং বেড়ে উঠার সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেমন আমি যে প্রোগ্রামটা করি সেটা ঠিকমতো করার জন্য ২৪ ঘণ্টাই কিন্তু খবর নিয়ে পড়ে থাকলে হবে না। এক্ষেত্রে চর্চার ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিনিয়ত আপডেট হওয়াটা জরুরি। আমি জার্নালিজমে পড়েছি বলে ভালো সাংবাদিক বা ভালো উপস্থাপক হতে পারবো বিষয়টা তা নয়। জার্নালিজম না পড়েও ভালো সাংবাদিক হওয়া যায়। আমাদের দেশেই অনেক সাংবাদিক আছেন যারা জার্নালিজমে পড়েননি। তাই বলে কী তাঁরা ভালো সাংবাদিক নন? কথা হচ্ছে অরিয়েন্টেশন, নিজেকে তৈরি করা, প্রতিনিয়ত নিজেকে আপডেট রাখা। আমি নিজেও যে খুব ভালো উপস্থাপক, সঞ্চালক সেটা বলবোনা। আমাদের দেশে ভালো উপস্থাপক আছেন দেখা যায় তাদের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা নেই। আবার ভালো সাংবাদিক আছেন ঠিকই কিন্তু ভালো উপস্থাপনা করতে পারছেন না। এটা বেশ জটিল একটা কম্বিনেশন। উপস্থাপনা এবং সাংবাদিকতা দু’টো মিলেই কিন্তু ভালো টক-শো উপস্থাপক হওয়া যায়। টক-শো উপস্থাপনা করার সময় পলিটিক্স জানতে হয়। যেমন- রাজনীতিতে ঐতিহাসিকভাবে কে কোন দলে ছিলেন, কে কয়বার দল পরিবর্তন করেছেন, কে কোন মতাদর্শে বিশ্বাসী এমন অনেক বিষয় জানতে হয়। এতে করে টক-শোতে একজন অতিথিকে প্রশ্ন করে এবং কথা বলে মজা পাওয়া যায় এবং দর্শকও অনুষ্ঠানটি দেখে আনন্দ পান।
আনন্দ আলো: আপনার এই পেশায় আসার গল্পটা জানতে চাই-
মিথিলা ফারজানা: হ্যা আমি এই ব্যাপারে বলতে চাই। অনেকবার চেয়েছি লিখবো। নিজের প্যাশনের জায়গাটায় কিভাবে এলাম জানাতে চাই মানুষকে। অনত্মত যারা এই প্রফেশনে আসছেন তাদের জানা উচিত। একজন মানুষের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে তাঁর রাজনৈতিক-সামাজিক এবং পারিবারিক প্রেক্ষাপটটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যখন বড় হয়েছি তখন সামাজিক প্রেক্ষাপট একরকম ছিলো। আর এখন সামাজিক প্রেক্ষাপটটা সম্পুর্ণই আলাদা। আগেই বলেছি আমার স্কুল জীবনে গান-গাওয়া, বিতর্ক করাসহ নানান সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কথা। মুক্তভাবে ভাববার জন্য মানুষের চিনত্মার যে উম্মেষ ঘটানো সেটা আমি স্কুল জীবনেই পেয়েছি। প্রচুর বই পড়েছি। কলেজেও তাই। আমার তো এমন মনে হয় যে, আমি বড় হলাম বোধ হয় বই পড়তে পড়তে, গান শুনতে শুনতে এবং কবিতার ছন্দে খেলা করতে করতে। এমনকি আমার আব্বু এবং তার বন্ধু-বান্ধব যারা ছিলেন তাদের সবাইকে বইপত্র নিয়ে আলোচনা করতে দেখেছি শুনেছি। অমুক সাহিত্যিকের সেই গল্পটা ভালো, তমুক কবির নতুন কবিতাটি সুন্দর হয়েছে এমন কথা আমি আমার আশপাশের মানুষের কাছে প্রায়ই শুনতাম। তাই আমার সবসময় মনে হতো আমিও সেই মানুষটির মতো হবো। আমার আইডলজির জায়গায় স্বপ্নের মানুষগুলো চলে এলো। আমিও তাদের মতো করে কথা বলতে ও লিখতে চাইতাম। একবার ছোটবেলায় সংবাদ পত্রিকায় অরিয়াফে লাইসির সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। তখন আমার ইচ্ছা জাগে সাংবাদিক হবার। কলেজে পড়ার সময় আমাকে শিক্ষক জিজ্ঞাসা করেছিলেন- বড় হয়ে কী হতে চাই? আমি বলেছিলাম অরিয়াফে লাইসির মতো সাংবাদিক হতে চাই। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে আমার বড় ভাই আর্কিটেক্ট, মেজো ভাই ডাক্তার এবং এর পরেই আমি সাংবাদিক। যখন আমি ইন্টারমিডিয়েট পাস করি তখন আমি বলেছিলাম সাংবাদিকতায় পড়বো। কিন্তু ভাইয়েরা কিছুতেই দিবে না আমাকে এই লাইনে। তারা ভেবেছিল আমিও তাদের মতো হয় ডাক্তার না হয় ইঞ্জিনিয়ার হবো। সাংবাদিক হবো এটা তারা চিনত্মাই করেনি। এরপর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভর্তি ফরম এনে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে পাসও করে ফেলি। ভাইভাতে সাংবাদিকতা বিষয় পছন্দ করে বাড়ি চলে এলাম। পেয়ে গেলাম সাংবাদিকতা সাবজেক্ট। আমার কাছে মনে হয় যে যেটা পছন্দ করে তাকে সেই সাবজেক্টেই পড়তে দেয়া উচিত। সেটাই নিজের জায়গা বলে মনে হয়। ছাত্র জীবনেই লেখালেখি শুরু করি। চলতিপত্র- পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করি। তখন আমি ইন্টারে পড়ি। একুশে টেলিভিশনে যখন কাজ শুরু করি তখন পড়ি অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে। বিবিসিতেও কাজ করেছি। সংবাদে কাজ করেছি। আর এখন তো একাত্তর টিভিতে কাজ করছি।
আনন্দ আলো: এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই। লাইভে অনেক সময় দু’জন অতিথির মধ্যে দেখা যায় বেশ ঝগড়া হয়। তখন অনুষ্ঠান সামলানোর জন্য অনেক ক্ষেত্রে বিজ্ঞাপন বিরতির আশ্রয় নেন। বিরতির সময় ঐ অতিথিরা আসলে কী করেন?
আনন্দ আলো: এতো ব্যসত্মতায় আপনার পরিবারকে সামাল দেন কিভাবে?
মিথিলা ফারজানা: আমার কাছে পরিবার ও সনত্মান আগে। তাই আমি সবসময় রাতের শিফটের কাজ ভাগ করে নেই। এতো ব্যসত্মতার মাঝেও আমি আমার দুই ছেলেকে নিজে পড়াই। তাঁদের কোনো গৃহশিক্ষক নেই। আমিই তাঁদের শিক্ষক। আমি বিবিসির চাকরিটা ছেড়েছি শুধু পরিবারকে সময় দেবার জন্য। এমনও হয়েছে অফিসে বসে ছেলেদের পরীক্ষার সময় অফএয়ারে ফোনে পড়া বুঝিয়ে এবং বলে দেই। তবে চেষ্টা করি বাচ্চাদের পরীক্ষার সময় আমার কাজ কম রাখতে। নিয়মতান্ত্রিকভাবে আমি বাচ্চাদের নিজেই পড়াই। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে বাসায় সবাই যখন ঘুমোতে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয় তখন আমি বের হই টিভিতে প্রোগ্রামের উদ্দেশ্যে। যেনো কারো কোনো সমস্যা না হয়। বাচ্চাদের পড়া বুঝিয়ে, সংসার সামলিয়ে তারপরই আমি কাজে যাই। আর হাজবেন্ড আমার চাইতেও বেশি ব্যসত্ম। কারণ ও সিমেন্স বাংলাদেশ লিমিটেড-এর হেড অব ফাইন্যান্স। সেও খুব সকালে বের হয়ে রাত ৮টা ৯ টা ছাড়া বাসায় আসতে পারে না। আরেকটা কথা না বললেই নয়। আমাদের কেউ দাওয়াত দিলে দু’জনেই একসাথে যাই। বিশেষ করে সন্ধ্যার পরের দাওয়াত। ওর দিক থেকে কেউ দাওয়াত দিলে সেটাতেও আমি যাই আর আমার দিক থেকে কেউ দাওয়াত দিলে সেটাতেও ও যায়। আমরা একা কোনো দাওয়াতে যাই না। কারণ এমনিতেই দেখা সাক্ষাৎ হয় কম। তাই প্রোগ্রামে এক সাথে যাওয়া চাই-ই চাই। পরিবারটাও তো দেখতে হয়।
আনন্দ আলো: নিজের কোনো স্বপ্নের কথা-
মিথিলা ফারজানা: স্বপ্ন তো অবশ্যই দেখি। স্বপ্ন দেখি বাংলাদেশে একদিন সত্যিকার অর্থে নিউজ এনভায়রনমেন্ট টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠবে। এখন আমাদের ২৫/২৬টা টিভি চ্যানেল তাই বলে ইন্ডাস্ট্রি কিন্তু তৈরি হয়নি। প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবকটি টিভি যে জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সেটা মোটেও শক্ত কোনো অবস্থান নয়। তাই আমি স্বপ্ন দেখি সত্যিকারের প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ নিয়ে একেকটি টিভি চ্যানেল গড়ে উঠবে। ২৫/২৬টা চ্যানেল আমাদের দরকার নেই। প্রাতিষ্ঠানিক রূপরেখায় তা সংখ্যায় দু’চারটি হলেও ক্ষতি নেই। তারপরও চাই বিবিসি, সিএনএন, এনডিটিভি’র মতো টিভি ইন্ডাস্ট্রি আমাদেরও হোক। দল যেই ক্ষমতায় থাকুক সেটা বিষয় নয়। চ্যানেল চ্যানেলের মতো চলবে- সেটাই কাম্য।