সেকাল আর একালের কত ব্যবধান!

মিজানুর রহমান
সময় কত দ্রুত বদলায়। ঈদ উদযাপনের কথাই যদি বলি, ২০/২৫ বছর আগের ঈদ আর বর্তমান সময়ের ঈদ উৎসবের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য। অতীতকালের ঈদ উৎসবে আনন্দের একমাত্র উৎস ছিল পারস্পারিক ভালোবাসা ও শ্রদ্ধাবোধ। এবাড়ি ওবাড়ি ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করার মধুরতম স্মৃতি পুরনো মানুষের মনে এখনও উজ্জ্বল। ঈদ উপলক্ষে নাড়ীর টানে শহর থেকে গ্রামে যারা বেড়াতে যেতেন তারা গ্রামে অন্য রকম আনন্দ ছড়াতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা করে আসতেন প্রিয়জনদের সঙ্গে। গ্রামে সব বাড়িতে টেলিভিশন ছিল না। তবে শহরে সন্ধ্যার পর টিভি অনুষ্ঠান দেখা ছিল ঈদ উৎসবের অন্যতম আগ্রহের বিষয়। বিটিভি ছিল একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল। বিটিভির নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, গানের অনুষ্ঠান পরিবারের সদস্যরা একজোট হয়ে দেখতেন। বিশেষ করে বিটিভির ঈদের নাটক ছিল সকলের আগ্রহের বিষয়। ঈদের বিশেষ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান দেখার জন্য অনেকে আগে থেকেই সময় বের করে রাখতেন। বিটিভিতে ঈদের নাটক যখন প্রচার হতো তখন রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। নাটক প্রচারের পর তার ভালো-মন্দ নিয়ে চলতো চুলচেরা বিশ্লেষন। বাসা বাড়িতে তো বটেই অফিস আদালতের আড্ডায়ও ঈদের নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা সমালোচনার ঢেউ খেলে যেত। ঈদে অগ্রসরমান পরিবারের বিশেষ আগ্রহ ছিল বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যার ওপর। সেই সময় বিচিত্রার কদর ছিল অনেক বেশী। পরবর্তিতে অন্যদিন, আনন্দ আলো সহ আরও কিছু পত্রিকার ঈদ সংখ্যা ঈদের অন্যতম আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। ‘এক ব্যাগ আনন্দ এক ব্যাগ আলো’ শীর্ষক ঈদ সংখ্যার প্রচলন করেছিল আনন্দ আলো। একটি ব্যাগে ১০/১২টি পত্রিকা এক সঙ্গে প্রকাশ হতো। পাঠকের ব্যাপক আগ্রহ ও ভালোবাসা পেয়েছে আনন্দ আলো। অতীতকালে ঈদ আনন্দের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল সিনেমা। ঈদে নতুন সিনেমা মুক্তির লড়াই শুরু হতো। পারিবারিক ভাবে দল বেঁধে সবাই সিনেমা হলে যেতেন। টিকিট পাওয়া ছিল ভাগ্যের ব্যাপার। সিনেমার টিকিট ব্লাকে বিক্রি হতো। ফলে নতুন সিনেমার টিকিট পাওয়া নিয়ে অনেক দৌড়ঝাপ করতে হতো। সিনেমার পাশাপাশি গান ছিল ঈদের অন্যতম আনন্দ উপভোগের অনুষঙ্গ। নতুন সিনেমার মতো নতুন গানের ক্যাসেট রিলিজ হতো। জনপ্রিয় সঙ্গীত শিল্পীর নতুন গানের ক্যাসেট নিমিষেই বিক্রি হয়ে যেত। ঈদেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতো অনেক গান। ঈদের সিনেমা হিট মানেই সিনেমার পালে নতুন হাওয়া। ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত গল্প উপন্যাসই পরবর্তিতে বইমেলায় নতুন বইয়ের আকার পেত। ফলে ঈদকে কেন্দ্র করে শিল্প, সাহিত্য-সংস্কৃতির অনেক কিছুই পরবর্তি সময়ে বিকাশ লাভ করতো। ঈদের নাটক জনপ্রিয় হলে ওই নাট্যকার পরিচালকের প্রতি আলাদা আগ্রহ সৃষ্টি হতো সবার। ঈদের সিনেমা জনপ্রিয় হলেই ওই সিনেমার পরিচালকের কদর বেড়ে যেতো। ঈদ সংখ্যার কোনো গল্প উপন্যাস আলোচনায় উঠে আসা মানেই সংশ্লিষ্ট লেখকের প্রতি প্রকাশকদের আগ্রহ বেড়ে যাওয়া। মোট কথা ঈদকে কেন্দ্র করে দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, এমনকি ব্যবসার গতিপথও বদলে যেত। নতুন পোশাক ঈদ উৎসবের অন্যতম আকর্ষণ, ঈদে ধনী গরীব নির্বিশেষে ঈদের নতুন পোশাক কেনা চাই-ই চাই। ফলে ঈদের আনন্দে পোশাক হয়ে উঠতো খুবই গুরুত্বপুর্ন। এখনও নতুন পোশাকের গুরুত্ব রয়েই গেছে। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রে একটু যেন পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তনটা এনেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। ফেসবুক, ইউটিউব, টুইটার সহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিভিন্ন শাখা বদলে দিয়েছে ঈদ উৎসবের প্রচলিত ধারনা।
সিনেমার কথাই যদি বলি। ফেসবুকে, ইউটিউবে, ওটিটি চ্যানেলে কোন সিনেমা দেখতে চান আপনি? দেশী-বিদেশী কোন সিনেমা আপনার দরকার? সিনেমা হলে যেতে হবে না। আপনি যেখানেই থাকেন না কেন আপনার হাতে যদি থাকে একটি মোবাইল ফোন, আর যদি ওই ফোনে থাকে ইন্টারনেট কানেকশন তাহলে পৃথিবীতো আপনার হাতের মুঠোয়। শুধু ইচ্ছে প্রকাশ করুন। যাদুর কাঠির স্পর্শে নিমিষেই হাজির হবে কাঙ্খিত সিনেমা, টিভি নাটক, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, প্রিয় কবি লেখকের জনপ্রিয় সেই কবিতা অথবা উপন্যাস। জনপ্রিয় সেই গানটি শুনতে চান? তাও পাবেন নিমিষে। অথচ একটা সময় এই বিষয় গুলো পাওয়ার জন্য দেখার জন্য, পড়ার জন্য আপনাকে বাড়ির বাইরে নানান জায়গায় যেতে হয়েছে। সিনেমা দেখার জন্য যেতে হয়েছে সিনেমা হলে। টিভি নাটক দেখার জন্য যেতে হয়েছে বাসার ড্রয়িং রুমে। গল্প, উপন্যাস পড়ার জন্য সংগ্রহ করতে হয়েছে বিভিন্ন পত্রিকার ঈদ সংখ্যা। নতুন গান শোনার জন্য সংগ্রহ করতে হয়েছে গানের নতুন সিড়ি অথবা ক্যাসেট।
আর এখন সব কিছুই পাওয়া যায় মোবাইল ফোনে। গান, নাটক, সিনেমা, ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান, খাবার দাবার, পোশাক, প্রশাধনী থেকে সব কিছুই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঢুকলেই পাওয়া যায়। এমনকি ঈদে বাড়ি যাবেন রেল, বাস, ট্রেন, লঞ্চ, উড়োজাহাজের টিকিটও পেয়ে যাবেন অনলাইনে। ফলে ঈদের অতীত ও বর্তমানের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। একটা সময় ঈদের নতুন পোশাক কেনার জন্য দর্জি বাড়িতে যেতে হতো। দর্জি শরীরের মাপ নিতেন। সেই মাপ অনুযায়ী পোশাক বানাতেন। এখন আর দর্জি বাড়ি যেতে হয় না। বিভিন্ন ফ্যাশন হাউস ও পোশাক প্রস্তুকারী প্রতিষ্ঠানে ঢু মারলে পাওয়া যায় পছন্দের পোশাক। কাজেই কে যায় আর দর্জি বাড়ি?
পোশাকের সুরাহা হল। নাড়ীর টানে গ্রামে যাবেন। বাস, লঞ্চ, ট্রেন উড়োজাহাজের টিকিট চাই। একটা সময় বাস, লঞ্চ, ট্রেন ও উড়োজাহাজের কাউন্টারে সরাসরি দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হতো। এখন ঘরে বসে, অফিসে যেতে যেতে সহজেই বাস, লঞ্চ, ট্রেন, উড়োজাহাজের টিকিট কেনার সুযোগ নেওয়া যায়।
পোশাক হল, বাড়ি যাবার টিকিটও হল। এখন দরকার আনন্দ-বিনোদনের অনুষঙ্গ। সিনেমা, নাটক দেখতে চাই। সিনেমা হলে না গেলেও চলবে। মোবাইল ফোনেও সব আছে। নাটক আছে, সিনেমা আছে। কাজেই কে চায় কষ্ট করে সিনেমা হলে যেতে? ঈদের বাজার দরকার। ঘরের বাইরে না গেলেও চলবে। অর্ডার করুন অনলাইনে। কাঙ্খিত সব কিছুই বাসায় হাজির হবে। আর এত সুযোগ সুবিধাই বদলে দিয়েছে ঈদের বর্তমান কালকে।
তবে ঈদে বাড়ি ফেরার সেই ঝক্কি ঝামেলা শেষ হয়নি। ট্রেনে বাসে, লঞ্চে এমনকি উড়োজাহাজেও ভীড় আছে আগের মতোই। তবে বাড়ি ফিরে এখন আর সবাই পাড়া প্রতিবেশির খোঁজ নেয় না আগের মতো। মোবাইল ফোনে ব্যস্ত থাকে সবাই। মোবাইল ফোনই যেন একমাত্র আনন্দের দুনিয়া। মোবাইলে খাই, মোবাইলেই দেখি, মোবাইলেই ঘুমাই… এমন অবস্থা।
ছোট্ট একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। গত ঈদে গ্রামের বাড়িতে হাজির পরিবারের সব সদস্য। কেউ ঢাকা থেকে, কেউ চট্টগ্রাম, কেউ রাজশাহী থেকে রংপুর অঞ্চলের একটি গ্রামে গেছেন ঈদ করতে। বহু বছর পর ভাই-বোনদের দেখা। বাবা-মা এখনও বেঁচে আছেন। তারা বেশ খুশি। গ্রামের লোকজন তাদেরকে দেখতে আসছেন। কিন্তু ভাই-বোনদের সবাইকে এক সঙ্গে করা যাচ্ছে না। বড় ভাই আসে তো ছোট ভাইয়ের দেখা নেই। মেজ ভাইয়ের স্ত্রী এলো তো তার স্বামীর দেখা নেই। তাদের ছেলে-মেয়েরাও কে যে কোথায় তা কেউ জানে না। ঘটনা কী? ঘটনা হল সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যস্ত। কেউ সিনেমা দেখছে। কেউ দেখছে তথাকথিত হাসির নাটক। আবার কেউ পৃথিবীর সব অবাক করা ঘটনা দেখে দেখে সময় কাটাচ্ছে। কাজেই সময় নাই এক সঙ্গে হবার।
অতীতকালে ঈদ উৎসবে প্রিয়জনের সঙ্গে মিলিত হয়ে পরিবারের নানা বিষয় নিয়েই সকলে আনন্দে মেতে থাকত। এখন সেটা হয় না। যানজট, পথের ক্লান্তি ভেঙ্গে বাড়ি গিয়ে অধিকাংশ মানুষ মোবাইলেই ব্যস্ত সময় কাটায়। ফলে ঈদ উৎসবে কার্যত পরিবর্তন ঘটেছে। উৎসব হয় ঠিকই। সেখানে যেন প্রাণের অস্তিত্ব থাকে না। নিজের আনন্দ ছাড়া অন্যের আনন্দ গুরুত্ব পায় না। অথচ ঈদ মানেই মিলে মিশে থাকার আনন্দ উৎসব। ঈদ মানেই প্রিয়জনের মুখে হাসি আর আনন্দ। আসুন না এবার সেই পরিবেশটাই সৃষ্টি করি। প্রিয় পাঠক, পবিত্র ঈদের শুভেচ্ছা নিন। ঈদ মোবারক।

  • শীর্ষ কাহিনি