তাকে কতো নামেই না ডাকা যায়। আঙ্গুরলতা, বিলকিস, রুবিনা, নবনী, চারু, রেনুসহ আরো কতো নাম! এতো নামের পরিচিতিগুলো অবশ্য তার অভিনীত চরিত্রের কারণেই। একেকটি চলচ্চিত্রে একেক গেটআপে তাকে দর্শকরা দেখে আর তার অভিনীত নতুন চরিত্রের অপেক্ষায় থাকে। একটি চলচ্চিত্রের পর আরেকটি চলচ্চিত্রে তিনি হাজির হন সম্পূর্ণ নতুন চরিত্র হয়ে। আর তাই তো দর্শকও তার অভিনীত চরিত্রটি নিয়েই মেতে থাকেন নতুন আরেকটি চরিত্র আসার আগ পর্যন্ত। হ্যাঁ, পাঠক তিনি আমাদের জয়া আহসান। যেনো নিজেই নিজের নামের প্রতিদ্বন্দি। ঠিক তাই। ডুবসাঁতারের রেনু, গেরিলার বিলকিস, চোরাবালির নবনী, ওপার বাংলার রাজকাহিনীর রুবিনা, আবর্তের চারু কিংবা সেই আঙ্গুরলতা ও নন্দুর ভালোবাসার আঙ্গুরি তিনি একজনই। এমনি দর্শক নন্দিত সব চরিত্রে অভিনয় করে জয়া আহসান স্হান করে নিয়েছেন দর্শকের মণিকোঠায়। বিষয়টা এমন যে জয়া আহসান মানে নতুন কোনো চরিত্র, নতুন কোনো গল্প কিংবা সমাজের অত্যাচারিত-নিপীড়িত সংগ্রামী কোনো নারীর জীবনচিত্র। শুধু কী তাই? জয়া আহসান মানে বাণিজ্যিক ঘরানার সফল ছবির গল্পও বটে। জিরো ডিগ্রি, পূর্ণদৈর্ঘ্য প্রেমকাহিনীর মতো ছবিতে একেবারেই ভিন্ন গেটাপের জয়াকে দেখতে পেয়েছেন তার ভক্তরা। আর ওপার বাংলায় তো বর্তমানে জয়ার জয়জয়কার বলা যায়। সৃজিত মুখাজীর্র্র ‘রাজকাহিনী’, অরিন্দম শীলের ‘আবর্ত’, ইন্দ্রনীল রায় চৌধুরীর ‘একটি বাঙালি ভূতের গপ্পো’ ইত্যাদি ছবিগুলোতে জয়ার নান্দনিক অভিনয়ে কলকাতার সমালোচকরা পর্যন্ত মুগ্ধ। আর তাই তো ইন্ডিয়া টাইমসসহ নামিদামি পত্রিকায় জয়ার প্রশংসা করে কলাম প্রকাশিত হয়েছে। সম্প্রতি জয়া কলকাতা থেকে দেশে ফিরেছেন। কলকাতার আরো দুটি নতুন চলচ্চিত্রে চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন তিনি। তবে বর্তমানে দেশের কয়েকটি চলচ্চিত্রে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন বলে জানান জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত এই গুণী অভিনেত্রী। দেশে এসেই জয়া তথ্য মন্ত্রণালয় প্রযোজিত ও ইমপ্রেস টেলিফিল্ম এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে নির্মিত ‘পুত্র’ সিনেমার শুটিং নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন। জয়া কলকাতা আর বাংলাদেশ দুই জায়গায়ই সমানতালে অভিনয় করে যাচ্ছেন। ক্যারিয়ারের ঠিক এই সময়ে এসে জয়া নিজেকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন? অভিনয়ের কোন শিখরে নিজেকে নিতে চান? কিংবা দুই দেশের কাজের অভিজ্ঞতাটাই বা কেমন- এমন নানান বিষয়ে কথা বলেছেন আনন্দ আলোর সঙ্গে। লিখেছেন সৈয়দ ইকবাল
আনন্দ আলো: কলকাতা থেকে দেশে ফিরে ‘পুত্র’ সিনেমায় কাজ করছেন। এই চলচ্চিত্রে আপনার অভিনীত চরিত্রটি নিয়ে বলবেন?
জয়া আহসান: স্পেশাল চাইল্ড কিংবা অটিজম শিশুদের নিয়ে সচেতনতামূলক চলচ্চিত্র ‘পুত্র’। ছবিটির কাহিনী, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন হারুন রশীদ। পরিচালনা করছেন সাইফুল ইসলাম মাননু। তথ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে নির্মিতব্য এ ছবির সার্বিক তত্ত্বাবধানে রয়েছে ইমপ্রেস টেলিফিল্ম। আমি ছবিটিতে একজন স্কুল শিক্ষিকার চরিত্রে অভিনয় করছি। এই ছবিতে দেশের প্রায় বড় বড় অভিনয়শিল্পীরাই কাজ করছেন। ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা নাকি চাচ্ছিলেন, আমিই যেন এ ছবিতে অভিনয় করি। একজন অভিনয়শিল্পীর জন্য এটা অনেক সম্মানের। পুত্র ছবির গল্প অটিস্টিক অর্থাৎ ‘স্পেশাল চাইল্ড’দের নিয়েই। আমাদের দেশে সচরাচর এমন গল্প নিয়ে ছবি তৈরি হয় না। তাই গল্পটা শুনে বেশ ভালো লেগেছে। আমি ছাড়াও ছবিতে আরো অভিনয় করছেন ডলি জহুর, ফেরদৌস, শাকিব, শামস সুমন, আহসান হাবিব নাসিম, রিচি সোলায়মান ও সাবেরী আলম প্রমুখ।
আনন্দ আলো: আপনার অভিনীত কলকাতায় আবর্ত, একটি বাঙালি ভূতের গপ্পো এবং সর্বশেষ রাজকাহিনী ছবিটি মুক্তি পায়। তাদের কাজ আর আমাদের কাজের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়?
জয়া আহসান: দারুণ একটা টপিক এটা। এই বিষয়টা নিয়ে আমিও কথা বলতে চাই। আগে কিছু বিষয় পরিষ্কার হওয়া দরকার। কলকাতায় কোনো অভিনয় শিল্পী কখনোই একটা চলচ্চিত্রে শুটিং-এর সময় আরেকটা চলচ্চিত্রে অভিনয় কিংবা নাটকও করেন না। এমনকি তারা মূল শুটিং-এ যাওয়ার আগে মহড়া করে। আর যার যার চরিত্রটা বুঝিয়ে নেয়ার পর তার কাজ হচ্ছে সেই চরিত্রের মধ্যে থাকা। কারো কোনো গেটআপ নেয়া লাগলে তা নিয়ে বসে থাকে। আর ঐতিহাসিক কোনো কাজ করলে সেই বিষয়ে পুরোপুরি ধারণা নিয়ে নেয়। এই কাজটা রাজকাহিনীতে অভিনয়ের আগে আমাকেও করতে হয়েছিল। ওখানে সবাই চরিত্রটাকে ফুটিয়ে তোলার জন্য সবসময় চেষ্টা করে থাকেন। কখনোই একশত ভাগ হওয়া ছাড়া টেক ওকে করেন না পরিচালক। আর সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে একজন নির্মাতা যে চরিত্রটা তার কল্পনায় এনেছে সেটা ঐ অভিনয়শিল্পীকে বুঝিয়ে তারপর টেক-এ যান। চরিত্রের বাইরেও অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে তারা চরিত্রের প্রেক্ষাপট নিয়ে আলোচনা করেন। ব্যাকগ্রাউন্ডে প্রচুর কাজ করেন তারা। সময়টাকে বোঝানোর জন্য অনেক পরিশ্রম করেন। সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা অ্যাসিস্ট্যান্ট রয়েছে। সবমিলিয়ে ফাইনালি যখন চরিত্রটা পর্দায় আসে তখন সেটা প্রাণবন্ত মনে হয়।
আনন্দ আলো: তারমানে কী আমাদের এখানে এমনভাবে কাজ হয় না?
আনন্দ আলো: কলকাতা এবং বাংলাদেশ দুই জায়গার সিনেমার কোন পার্থক্যগুলো চোখে পড়েছে?
জয়া আহসান: নিজ দেশের ব্যাপারে আমি বেশ আবেগী। তাই এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ মতামত দিতে পারব না। তবে এটা বলতেই হয়, ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে টালিউড অনেক বেশি পেশাদার। হয়তো ভারতের সিনেমার বড় বাজার এবং কাঠামোর কারণে এই পেশাদারিত্ব ঐখানে গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশে সিনেমা হলগুলো বড় ধরনের সমস্যায় রয়েছে। প্রজেকশন ব্যবস্হা এবং পোস্ট প্রডাকশন সুবিধা দেশে খুবই অপ্রতুল। আবার একই সঙ্গে সিনেমার প্রতি আমাদের প্রবল ভালোবাসা রয়েছে। এই ভালোবাসার কারণেই আমাদের সব ত্রুটি আড়াল হয়ে যায়। প্রতিবছর দেশে বেশ ভালো কিছু ছবি নির্মিত হয়। সরকারও সিনেমার উন্নয়নে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। পরিচালক এবং শিল্পীদের একটা নতুন প্রজন্ম কাজ করছে। যাদের গল্প বলার ধরন অসাধারণ এবং সিনেমার প্রতি প্রচ ভালোবাসা রয়েছে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রির নানান বিষয়ে অনেক তরুণই হতাশ। পাশাপাশি অনেক তরুণ পরিচালক নিজের যোগ্যতা ঠিকমতো প্রমাণ করতে পারেননি এটাও আমি মানছি।
আনন্দ আলো: কলকাতায় আপনার কাজের মধ্যে বোধকরি সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছে সৃজিত মুখাজর্ীর রাজকাহিনী। দুই বাংলায় ছবিটি নিয়ে বেশ আলোচনা হলেও সোশ্যাল মিডিয়ায় বেশকিছু নেতিবাচক কথাও শোনা যায়। কেউ কেউ বলেছেন ছবিটিতে জয়া ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করেছেন, আপনাকে সাইড চরিত্রে দেখা গেছে। এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?
আনন্দ আলো: আপনি রাজকাহিনী ছবির প্রচারণায় ভারতের একটি টিভি অনুষ্ঠানে গেলে সেখানে প্রসঙ্গক্রমে দুর্গাপূজা নিয়ে আলোচনায় বাংলাদেশ ও ভারতের পূজা উদযাপন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করেছেন বলে কেউ কেউ উল্লেখ করেন…
আনন্দ আলো: ‘আবর্ত’, ‘রাজকাহিনী’ বা ‘একটি বাঙালি ভূতের গপ্পো’- এগুলো একটু অফট্র্যাকের ছবি। কলকাতায় কী বাণিজ্যিক ধারার ছবিতে অভিনয় করবেন?
জয়া আহসান: প্রথমত আমি এতো ধারায় বিশ্বাসী না। বিশ্বের আর কোথাও চলচ্চিত্রের এতো ভাগ বা ধারা নেই। সবই কিন্তু ফিল্ম। আর আমি আসলে জীবনবোধ কিংবা চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে কাজ করতে ভালোবাসি। দেখা গেছে, যে চরিত্রটা কখনোই কেউ করেননি, কাউকে কখনো এমন চরিত্রে দেখা যায়নি তেমন চরিত্র আমি খুঁজে বেড়াই। আর এ ধরনের গল্পের প্রতি আমি বরাবরই দুর্বল। আমি আসলে নিজেকে প্রতিনিয়ত ভিন্নভাবে উপস্হাপন করতে চাই। সেইদিক থেকে যদি এখানে বিকল্পধারার ছবির কথাই বলা হয় তাহলে বলবো হ্যাঁ, আমি এ ধরনের ছবির প্রতি দুর্বল। কিন্তু সেই সঙ্গে ভালো গল্পের কমার্শিয়াল ছবিতেও আমি কাজ করতে চাই। বাণিজ্যিক ছবি হলেও গল্প এবং আমার চরিত্রে চমক থাকতে হবে। এখন সেটা কলকাতা কিংবা বাংলাদেশ দুই জায়গায়ই হতে পারে।
আনন্দ আলো: এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। অভিনয়ে এই যে ছুঁটেই চলেছেন। ক্লান্তি লাগে না?
আনন্দ আলো: দুই বাংলায় এখন ব্যস্ততা কোন কোন ছবি নিয়ে?
আনন্দ আলো: টিভি পর্দায় কাজের ব্যাপারে কী বলবেন?
জয়া আহসান: টিভিতে আমি কাজ করতে চাই। কিন্তু সময়-সুযোগ হয়ে উঠছে না। আমি কখনোই বলিনি টিভিতে কাজ করবো না। তাছাড়া বর্তমানে টিভি মিডিয়ায় কোনো নির্মাতা মানে আমি যাদের সাথে কাজ করেছি তারা কেউই তেমন কোনো নাটক নির্মাণ করছেন না। টিভি মিডিয়ায় খুব যে আহামরি কাজ হচ্ছে- এটা বলা যাবে না। তবে আমি অবশ্যই টিভি নাটকে কাজ করবো। পর্দা বিভাজনে আমি বিশ্বাসী নই। আমি একজন অভিনেত্রী। অভিনয়টাই আমি করতে চাই। তবে সেটা অবশ্যই আমার পছন্দ অনুযায়ী হতে হবে।
আনন্দ আলো: এবার একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন, জয়ার ব্যক্তিগত জীবনে কী ঘটছে?
জয়া আহসান: (হাসি) তেমন কিছুই না আসলে। আমার জীবনটা আমি চলচ্চিত্রের জন্য উৎসর্গ করেছি। আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বপ্ন নেই, কারণ আমি চলচ্চিত্রের স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে আছি এবং বেঁচে থাকতে চাই।
শুধু বুক খুলে দিলেই অভিনয় হয়, তাই না।