দেখতে দেখতে এক যুগ পার করেছে দেশের টিভি মিডিয়ায় টক শো ভিত্তিক প্রথম এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চ্যানেল আই এর ‘তৃতীয় মাত্রা’। দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক অঙ্গনে এই অনুষ্ঠানটির ভ‚মিকা অনেক। ইতিমধ্যে ৪ হাজার ৩৮৮ টি পর্ব প্রচারিত হয়েছে। ২ হাজার ৭শ জন অতিথি অনুষ্ঠানটিতে কথা বলেছেন। একযুগ পূর্তির শুভক্ষণে মনোরম এক বিকেলে তৃতীয় মাত্রার প্রাণ পুরুষ মিডিয়া ব্যক্তিত্ব জিলুর রহমানের মুখোমুখি হয়েছিল আনন্দ আলো। সাথে ছিলেন সম্পাদক রেজানুর রহমান। লিখেছেন আনন্দ আলোর বিশেষ প্রতিনিধি জাকীর হাসান।
আনন্দ আলো: টিভি মিডিয়ায় সব চেয়ে জনপ্রিয় টক শো চ্যানেল আই এর ‘তৃতীয় মাত্রা’ এক যুগ পার করেছে আপনার অনুভ‚তি কেমন?
জিল্লুর রহমান: সব মিলিয়ে অনুভ‚তি চমৎকার। তৃতীয় মাত্রা এক যুগ পার করেছে এটা দেশের টিভি অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে একটা মাইলস্টোন। অনুষ্ঠানটি নিয়ে আমরা আরও অনেক দূর যেতে চাই। এখনো অনেক কিছু করার বাকী আছে। অনুষ্ঠানটি ১২ বছর অর্থাৎ একযুগ পার করেছে তার মানে তৃতীয় মাত্রা এখনো কৈশরেই আছে।
আনন্দ আলো: কোন ভাবনা থেকে অনুষ্ঠানটি শুরু হয়েছিল। সেই ভাবনার সঙ্গে কী আজকের অনুষ্ঠানের মিল খুঁজে পান?
জিল্লুর রহমান:তৃতীয় মাত্রা মূলত এমন এক সময় শুরু হয়েছিল যখন দেশে নির্বাচিত সংসদ ছিল কিন্তু সেই সংসদ কার্যকর ছিল না। সংসদে বিরোধীদল নিয়মিত অনুপস্থিত থাকতো। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে কোনো ধরনের সম্পর্ক ছিল না। এক দলের সদস্যদের সঙ্গে আরেকদলের সদস্যরা কথা পর্যন্ত বলতেন না। সন্তানের বিয়েতেও কেউ কাউকে দাওয়াত দিতেন না। এমন কী কোনো নেতা নেত্রী মারা গেলে তার বিরোধী পক্ষের নেতা নেত্রীরা জানাজায়ও অংশ নিতেন না। ওই সময় রাজনৈতিক জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রচুর কথা হতো। রাজনীতির ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা এবং জাতীয় সংসদের ঠিক বিকল্প হিসেবে নয় সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সংসদে যে ডিবেট হওয়া উচিত ও করা উচিত সেটাকে সামনে নিয়ে আসা এবং দুই পক্ষকে সামনা সামনি করাই ছিল ‘তৃতীয় মাত্রা’ অনুষ্ঠানের মূল লক্ষ্য। এই অনুষ্ঠানে দেশের প্রায় সকল দলের রাজনৈতিক নেতা নেত্রী আমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন। এমনও দেখা গেছে যারা ২০/২৫ বছর ধরে সংসদে আছেন কিন্তু বিপক্ষ দলের অনেক নেতার সঙ্গে কখনও দেখা হয়নি বা কথা হয়নি কিন্তু তৃতীয় মাত্রায় এসে তাদের মধ্যে আলাপ পরিচয় হয়েছে। সব মিলিয়ে রাজনৈতিক স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের একদম সাধারন মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়া এবং রাজনীতিবিদদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক তৈরী করার ক্ষেত্রে ভ‚মিকা রাখা এ গুলো প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল। এখন সেই লক্ষ্য অনেক খানি অর্জন করেছে তৃতীয় মাত্রা। হয়তো সেই অর্থে সংসদ কার্যকর হয়নি কেননা সেই সময় নির্বাচনী ব্যবস্থা যেমন ছিল এখন তার চেয়ে বেশি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। তৃতীয় মাত্রা অমরা যখন শুরু করি তখন এ ধরনের কোনো টক শো ছিল না। এখন ২৪টি টিভি চ্যানেলে প্রতিদিন ৬০টি টক শো প্রচার হয়। এই সব শো তে নানা বিষয়ে প্রচুর কথাবার্তা হচ্ছে। শুধু রাজনীতিবিদরাই বলছেন না সিভিল সোসাইটি সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষেরা কথা বলছেন এবং সাধারন মানুষ সে সব শুনছে। শুনছে বলেই রাত ৮/৯টার পর থেকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে রাত ১/২টা পর্যন্ত টক শো চলে। টকশোর প্রচুর জনপ্রিয়তা আছে বলেই চ্যানেল কর্তৃপক্ষ এতটা সময় ব্যয় করেন। আনন্দ আলো: বছরে ৩৬৫ দিন আপনাকে তৃতীয় মাত্রার সঞ্চলকের ভ‚মিকা পালন করতে হয়। পুরো অনুষ্ঠানকে সাজাতে হয়, অতিথিদের আমন্ত্রণ জানাতে হয় এই যে একটি দুরুহ কাজ ১২ বছর ধরে করছেন কখনো কী একঘেয়েমী লাগে না?
জিল্লুর রহমান: এক ঘেয়েমী কখনো লাগে না কারণ প্রতিদিন নতুন অতিথির সঙ্গে কথা বলতে হয় নতুন নতুন বিষয় উপস্থাপন করি। আসলে সময়ের সঙ্গে চলতে হয় আমদের। প্রতিদিনই কিছু না কিছু ঘটনা ঘটছে। কখনো উত্তেজনা দেখা দেয় সেটি নিয়ে আমরাও উত্তেজিত হই। অনুষ্ঠানটি আমি যেহেতু পেশাগত ভাবে করি এবং এটি আমার একমাত্র প্রফেশন। সেজন্য একজন পেশাগত উপস্থাপক হিশেবে কাজ করার চেষ্টা করছি। আনন্দ আলো: প্রতিদিন তৃতীয় মাত্রায় আপনি দুইজন বিপরীত মতের মানুষকে মাঝ খানে বসিয়ে উপস্থাপনা করেন। কখনো কী সমস্যা, প্রতিকুলতা বা বিব্রত হয়েছেন। বা এরকম কোনো ঘটনা কী ঘটেছে?
জিল্লুর রহমান: তৃতীয় মাত্রার মূল শক্তি হচ্ছে জনগনের সমর্থন। তৃতীয় মাত্রা স্রোতের মধ্যে গা ভাসায় না। অনুষ্ঠানের মানের ব্যাপারে কোন আপোষ করেনা। দেশের যারা পলিসি মেকার তাদের কাছে তৃতীয় মাত্রার আলাদা গ্রহন যোগ্যতা আছে। সেকারনে অন্য সব চ্যানেলের টক শোর টি আর পি এক সঙ্গে করলেও তৃতীয় মাত্রার সমান হবে না। বাংলাদেশের সবগুলো দূতাবাস না হলেও যারা বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামায় তারা তৃতীয় মাত্রার প্রতিটি পর্ব মনিটর করে। বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশের সব গুলো গোয়েন্দা সংস্থা নিবিড় ভাবে তৃতীয় মাত্রা পর্যবেক্ষন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে তৃতীয় মাত্রা প্রচার হওয়ার পর রাতেই ট্রান্সক্রীপ্ট পৌছে যায়। এই কাজটি বাংলাদেশের তিনজন সাংবাদিক আমেরিকার একটি কমিউনিকেশন এজেন্সির হয়ে করে। তৃতীয় মাত্রার সবচেয়ে বড় শক্তি তার অগনিত দর্শক। আনন্দ আলো: ১২বছরে তৃতীয় মাত্রা অনুষ্ঠানে দুই পক্ষের অনেক লড়াই আমরা দেখেছি। আপনি কোন কোন লড়াইয়ে বিব্রত হয়েছেন দু’একটি ঘটনার কথা বলুন?
জিল্লুর রহমান: অনেক লড়াই হয়েছে। অনেকে লড়াই করেছেন। লড়াই করতে করতে অনেকে বলেছেন আমরা নাকি নিজেদের টি আর পি বাড়ানোর জন্য অনুষ্ঠানটি করি। এমনও হয়েছে জাতীয় পর্যায়ের একজন নেতা বলেছেন আমরা একটি অশুভ শক্তির হয়ে কাজ করছি। শেষ পর্যন্ত প্রমাণ হয়েছে আমরা আসলে কারো হয়ে কোন কাজ করি না জনগনের হয়ে কথা বলি। এগুলো একধরনের বিড়ম্বনা ও বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে আমাদের। তবে বর্তমানে আমাদের অনুষ্ঠানে এসে যদি কেউ ঝগড়া বিবাদ করে তাহলে আগের চাইতে বেশি বিব্রত হই। কারন তৃতীয় মাত্রা এখন একটি পরিনত অনুষ্ঠান আমি নিজেও বয়সে পরিনত। তাছাড়া দর্শকদেরও রুচি বদল হচ্ছে। অন্য টিভি চ্যানেলে টকশোগুলোতে ঝগড়া বেশি হয়। এমন কি হাতাহাতি মারামারি পর্যন্ত হয়। আবার তৃতীয় মাত্রায় ঐ অতিথিরা এলে কখনোই এগুলো করেন না। সংযত থাকেন এবং মোটামুটি ভালো প্রস্তুতি নিয়ে আসেন। তৃতীয় মাত্রার আরো একটি বড় দিক হচ্ছে অন্যান্য টকশো করার পর যারা তৃতীয় মাত্রায় অতিথি হয়ে আসেন তারা বলেন, যেদিন তৃতীয় মাত্রায় যাই তার পরের দিন অনেকেই বলেন আপনাকে তৃতীয় মাত্রায় দেখলাম। অন্যসব টকশোতে গেলে এভাবে নাম ধরে কেউ কিছু বলে না। এজন্য অনেকেই বলেন তৃতীয় মাত্রা এখন একটা ব্রান্ডিং। আনন্দ আলো: অনেক সময় দেখা যায় দুই পক্ষ উচ্চস্বরে অথবা উত্তেজিত হয়ে কথা বলছেন। আপনি মাঝখানে চুপ করে বসে শুনছেন। এটা কেন করেন?
জিল্লুর রহমান: আমাদের রাজনীতিবিদরা ভাবগম্ভীর ও সিরিয়াস এরকম একটা ধারণা আছে। তবে নিজেদের গন্ডির মধ্যে তারা খোলামেলা। প্রতিটি প্রফেশনের মানুষদের আলাদা গুণ থাকে। হয়তো তাদের কেউ কেউ গান করেন না কিন্তু গান ভালোবাসেন, অনেকে পেশাদার অভিনেতা নন কিন্তু একসময় অভিনয় করেছেন। অনেকে আবার নাটক লিখেছেন, কবিতার বই প্রকাশ করেছেন। এই গণগুলো তুলে ধরা আমাদের লক্ষ্য ছিল। বোধকরি ভালোবাসার বাংলাদেশ এক্ষেত্রে সফল। আনন্দ আলো: কতদূর যেতে চান?
জিল্লুর রহমান: তৃতীয় মাত্রার একটি পর্বে বলেছিলাম (যেখানে চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরিদুর রেজা সাগর ও পরিচালক, বার্তা প্রধান শাইখ সিরাজ উপস্থিত ছিলেন) যতদিন তৃতীয় মাত্রা বাংলাদেশের নাম্বার ওয়ান টকশো থাকবে ততদিন আমি এ অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাই। আমি নিজেও বিশ্বাস করি আরো অনেককাল তৃতীয় মাত্রা টিকে থাকবে। এটা যেহেতু একটি কারেন্ট অ্যাফেয়ার শো প্রতিদিন একটি বিষয় নিয়ে বির্তক করা হয় এই জায়গায় বড় পরিবর্তন আনা দরকার। বিষয়ভিত্তিক যেকোনো একটি বিষয় নিয়ে সিরিজ আলোচনা করা যেতে পারে। যেমন এর আগে সংবিধান নিয়ে একটি পর্ব করেছিলাম। বাংলাদেশে যত সংবিধান বিশেষজ্ঞ আছেন তারা এসেছিলেন অনুষ্ঠানে। সেখানে সংবিধানের আদ্যোপান্ত আলোচনা হয়েছিল। শিক্ষা নিয়েও এ ধরনের অনুষ্ঠান হতে পারে। টিভি মিডিয়াকে আমরা বলি একটি ইরেজ মিডিয়া। আমি চাই না তৃতীয় মাত্রা এতো বছর পরে হারিয়ে যাক। তৃতীয় মাত্রার একটি ওয়েব পোর্টাল রয়েছে। আমি মনে করি খুবই সমৃদ্ধ একটি ওয়েব সাইট। তৃতীয় মাত্রার সবগুলো পর্বের ভিডিও পাওয়া যাবে এই সাইটে। ট্রান্সক্রীপ্ট পাওয়া যাবে বাংলা ও ইংরেজিতে (সংক্ষিপ্ত ভার্ষন)। তৃতীয় মাত্রায় যারা অতিথি হয়ে এসেছেন তাদের প্রোফাইল ও ছবি ও পাওয়া যাবে। এখনো এই সাইটের কাজ চলছে। আমার একটি পরিকল্পনা আছে তাহলো- তৃতীয় মাত্রার প্রথম থেকে এ পর্যন্ত যতপর্ব প্রচার হয়েছে তা মুদ্রিত আকারে উপস্থাপন করা অর্থাৎ বই আকারে প্রকাশ করা। সেই সঙ্গে ডিভিডি আকারে প্রকাশ করারও পরিকল্পনা আছে। আনন্দ আলো: তৃতীয় মাত্রাকে অনুসরণ করে দেশের প্রায় প্রতিটি টিভি চ্যানেলে টকশো প্রচার হচ্ছে প্রতিদিন। আপনি কী সেই সব অনুষ্ঠান দেখেন?
জিল্লুর রহমান: একটা সময় তৃতীয় মাত্রা দুইবার দেখতাম এখন নিজের করা অনুষ্ঠানও দেখা হয় না মূলত কাজের ধরণ ও এর পরিধির কারনে। অন্যান্য টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান যতটা শোনার জন্য দেখি তারচেয়ে বেশি আগ্রহ নিয়ে দেখি কারা ঐ শোতে অতিথি হয়ে এসেছেন। বর্তমানে টিভি চ্যানেলের টকশো হয়ে গেছে ২০/২৫ জন অতিথির মধ্যে সীমাবদ্ধ। ব্যতিক্রম শুধু তৃতীয় মাত্রা। আমরা চেষ্টা করি যত রকম ভেরিয়েশন আনা যায়। আমি রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেছি। একসময় রাজনীতিও করেছি। কিন্তু গত এক যুগে তৃতীয় মাত্রা অনুষ্ঠানে ভুলেও কখনো নিজের রাজনৈতিক মতামত দিতে যাইনি। আনন্দ আলো: বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে একসঙ্গে তৃতীয় মাত্রায় অতিথি হিসেবে আনার চিন্তা কখনও করেছিলেন কী?
জিল্লুর রহমান: চিন্তা যে করিনি তা নয়। তবে এই নিয়ে কোনো ওয়ার্ক করিনি। কর্তৃপক্ষও অনেকবার বলেছেন কিন্তু আমি মনে করেছি এটা সম্ভব নয়। যেহেতু সম্ভব নয় সেহেতু চেষ্টাটা করতে চাই না। ষেটা হবে না সেটা আমি চেষ্টা করি না এটা আমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
একযুগ পেরিয়ে তৃতীয় মাত্রা আমার কাজ কথা বলা নয়, কথা বলানো: জিল্লুর রহমান
- এক্সক্লুসিভ