বিশ্বকাপ ফুটবল ঝরে যাচ্ছে তারকারা!

বিশ্বকাপ ফুটবলের সব হিসাবই পাল্টে যাচ্ছে। প্রথম ধাপেই গত আসরের বিশ্ব চাম্পিয়ন জার্মানীর বিদায় অবাক করে দেয় সারা বিশ্বে ফুটবল প্রেমিদেরকে। অনেক কষ্টে আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিল উঠে আসে সেরা ষোলোতে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্বে খেলতে নেমেই আর্জেন্টিনা ও পর্তুগালের বিদায় সকলকে আরও অবাক করে দিয়েছে। ধারনা করা হচ্ছে এবার বিশ্বকাপ ফুটবলের জমজমাট এই আসরে তারকা ফুটবলারদের পতন ঘটবে। মেসিকে ঘিরেই আর্জেন্টিনার যতো আশা ভরসা ছিল। সেই মেসি দ্বিতীয় পর্বে ফ্রান্সের সাথে খেলতে নেমে কোনো চমকই দেখাতে পারেননি। উরুগুয়ের সাথে খেলতে নেমেছিল পর্তুগাল। রোনালদোর প্রতিই ভরসা ছিল সবার। সেই রোনালদোও হতাশ করেছেন। মোট কথা বিশ্বকাপ শুরুর আগে বিশ্বখ্যাত যে সকল তারকার ব্যাপারে অনেক ভরসা করা হয়েছিল তাদের কেউই সেভাবে পারফরমেন্স দেখাতে পারেননি। একে একে ঝরে যাচ্ছেন বিশ্বসেরা তারকারা। তার মানে এবারের বিশ্বকাপ ফুটবল নতুন তারকার জন্ম দিবে এমনটাই আশা করা যায়।

আমাদের রাফির বিশ্বকাপ!

নারায়ণগঞ্জের হাজী ইব্রাহীম আলমচান মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ক্লাস সেভেনে পড়ে গোলাম রাফি খান। বিশ্বকাপ ফুটবলের এই মৌসুমে ‘ফুটবল ফর ফ্রেন্ডশিপ’ প্রকল্পের অংশ হিসেবে সে গিয়েছিল রাশিয়ায়, ফুটবল খেলতে। মেসি-নেইমারদের ‘বড়’ বিশ্বকাপে রাফির খেলা হয়নি। তবে রাফি যেই টুর্নামেন্টে খেলেছে, সেটাও কম যায় না! ২১১টি দেশের খুদে ফুটবলারেরা অংশ নিয়েছিল এই ফুটবল উৎসবে। এবারের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচটা মাঠে বসে দেখার সুযোগও পেয়েছিল রাফি। তবে মুখেই শুনুন সেই সাফল্যের গল্প।

চোখ বুজলেই এখনো চোখে ভাসে। হাজার হাজার মানুষ, কত রং, কত রকম ভাষা, কত রকম পোশাক! সবাই এসেছিল একটা ফুটবল ম্যাচ দেখতে। মাঠে খেলবে ২২ জন, তাঁদেরকে দেখতে কত আয়োজন! না দেখলে বিশ্বাস হয় না। আমার এখনো বিশ্বাস হতে চায় না, বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম ম্যাচটা আমি গ্যালারিতে বসে দেখেছি।

এই সুযোগ পেয়েছিলাম ‘ফুটবল ফর ফ্রেন্ডশিপ’ নামের একটা প্রকল্পের মাধ্যমে। সংক্ষেপে বলা হয় এফ ফর এফ। ফিফা (সারা বিশ্বের ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনগুলোর একটা সম্মিলিত সংঘ) আর বেসরকারি প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রম এই নিয়ে ষষ্ঠবার উৎসবটির আয়োজন করল। এর উদ্দেশ্য হলো, সারা বিশ্বে আমার বয়সী যেই ফুটবলাররা আছে; তাদের কয়েকজনকে একসঙ্গে দেখা করার, খেলার, কথা বলার সুযোগ করে দেওয়া। বাংলাদেশে ১২ বছরের কম বয়সী ফুটবলারদের মধ্যে যাচাই-বাছাই শেষে আমাকে নির্বাচিত করে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন। আমার সঙ্গে এ দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছে আরও একজন। নাম রাফাত শামস। সে সুযোগ পেয়েছে কিশোর সাংবাদিক হিসেবে।

জয়, পরাজয় আর ড্র সবগুলো স্বাদই পাওয়া হয়ে গেছে। একটা ম্যাচে ৯-১ গোলে জিতলাম, একটা ২-২ গোলে ড্র, আরেকটা ৩-১ গোলে হার। মোট তিন ম্যাচে হ্যাটট্রিকসহ ৬টা গোল করেছি আমি

এর আগে আমি কখনো প্লেনে চড়িনি। শাঁ করে প্লেনটা যখন আকাশে উঠে যায়, খুব মজা লাগে। ভ্রমণটা অবশ্য অনেক লম্বা ছিল। প্রথমে ঢাকা থেকে তুরস্ক, সেখান থেকে রাশিয়া। হেডফোনে গান শুনতে শুনতে দিব্যি সময়টা কেটে গেছে। ৮ জুন রাশিয়ায় পৌঁছানোর পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় মস্কোর একটা হোটেলে।

২১১টা দেশ থেকে আসা আমার বয়সী খেলোয়াড়দের ভাগ করা হয়েছিল অনেকগুলো দলে। একেক দলে ৭ জন করে খেলোয়াড়। আমার দলের নাম ‘গ্যালাপাগোস সি লায়ন’। চীন, সাইপ্রাস, লাইবেরিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশের খেলোয়াড় ছিল আমার সতীর্থ। আমি ভালো ইংরেজি বলতে পারি না। ওরাও কেউ কেউ পারে না। আমাকে কথা বলতে সাহায্য করেছিল রাফাত।

ভাষা না বুঝলেও, আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল দ্রæত। সবচেয়ে ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে চীনের ইয়াং হুংয়ের সঙ্গে। ও আমার রুমে আসত, আমি ওর রুমে যেতাম। ইয়াং আমাকে চকলেট দিয়েছে। চকলেট পেলে যে বন্ধুত্ব হতে সময় লাগে না, সেটা তো তোমরা জানো!

৯ জুন এফ ফর এফ-এর উদ্বোধন অনুষ্ঠানের পর শুরু হয়ে গেল খেলা। মোট তিনটি ম্যাচ খেলেছি আমরা। জয়, পরাজয় আর ড্র সবগুলো স্বাদই পাওয়া হয়ে গেছে। একটা ম্যাচে ৯-১ গোলে জিতলাম, একটা ২-২ গোলে ড্র, আরেকটা ৩-১ গোলে হার। মোট ৩ ম্যাচে হ্যাটট্রিকসহ ৬টা গোল করেছি আমি।

খেলার চেয়ে ‘খেলা দেখা’টাই অবশ্য বেশি উপভোগ করেছি। আয়োজকেরা আমাদের বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আর প্রথম ম্যাচটা দেখতে স্টেডিয়ামে নিয়ে গিয়েছিল। সৌদি আরব আর রাশিয়ার খেলা। টিভিতে দেখে বোঝা যায় না, কত বড় মাঠ! খেলোয়াড়দের দৌড়ের কী গতি! চোখের পলক পড়ছিল না আমার।

স্টেডিয়াম থেকে হোটেলে ফেরার সময় আমরা দুটো করে দল এক বাসে উঠেছিলাম। আমাদের সবার হাতে হাতে দেওয়া হয়েছিল লাঠির মতো দেখতে এক রকম বেলুন। সেগুলো একটার সঙ্গে আরেকটা বাড়ি দিলে আওয়াজ হয়। বাসের ভেতর লাঠিগুলো হাতে নিয়ে আমরা মিছেমিছি মারামারি করছিলাম। খুব মজা হয়েছে।

দেশে আসার পর সবাই এখন আমার কাছে রাশিয়ার গল্প শুনতে চায়। সব ঘটনা তো আমি গুছিয়ে বলতেও পারি না। এখন আমি মদনগঞ্জ ফুটবল একাডেমিতে খেলি। আমার প্রিয় খেলোয়াড় ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। বড় হয়ে আমি তাঁর মতো বড় খেলোয়াড় হতে চাই।

আর্জেন্টাইনরা চায় মেসিরা খেলুক বাংলাদেশের সঙ্গে

বিশ্বকাপ ফুটবলে আর্জেন্টিনার প্রতি বাংলাদেশিদের লাগামহীন সর্মথন ও আবেগ দেখে আপ্লুত খোদ আর্জেন্টাইনরাই। আর্জেন্টিনার বেশ কিছু সংবাদপত্র এই উন্মাদনা নিয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছে। আর্জেন্টাইনরা এতটাই কৃতজ্ঞ যে তাঁরা এখন চাচ্ছেন মেসিরা যেন ঢাকায় এসে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেন। আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশনের কাছে এ ব্যাপারে পিটিশনও করেছেন তাঁরা। ম্যারাডোনার সাড়া জাগানো আত্মজীবনী ‘এল ডিয়োগ’র শুরুতইে গুরুত্বর্পূণ একটা প্রসঙ্গের সূত্র ধরে এসেছে বাংলাদেশের নাম। মূল স্প্যানিশ থেকে বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক মার্সেলো মোরা আরাউজো। বইটি শুরুই হয়েছে আরাউজোর ভ‚মিকা দিয়ে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ‘মনে আছে, বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসের হয়ে কাজ করার সময় একটা প্রতিবেদন নিয়ে গবেষণা করেছিলাম। সে সময় খুঁজে পেয়েছি, ১৯৯৪ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনাকে যখন নিষিদ্ধ করা হলো, একজন বাংলাদেশি সে ঘটনার জের ধরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। পরে সেটি রীতিমতো গণআত্মহত্যার চেষ্টায় রূপ নেয়।’

আর্জেন্টাইন ফুটবল দলকে বাংলাদেশের মানুষ যে কতটা ভালোবাসে, তার ছোট্ট একটা নমুনা এটি। ব্রাজিল নিয়েও উন্মাদনা আছে যথেষ্ট, কিন্তু আর্জেন্টিনা নিয়ে মাতামাতিই যেন তুলনামূলকভাবে বেশি। আর সেই উন্মাদনার খবর এখন দেশ-মহাদেশ পেরিয়ে পৌঁছে গেছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলেও। কিছুদিন আগেই ব্রাজিলের তিনজন সাংবাদিক এসেছিলেন নেইমার-কুতিনহোদের প্রতি এ দেশের মানুষের ভালোবাসা অনুভব করতে। আর্জেন্টাইনরা আগেই এই ভালোবাসার কথা জানলেও এবার ঘটেছে দারুণ চমকপ্রদ ঘটনা। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা দেখে তারা এতটাই বিহ্বল যে আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশনে তারা একটা পিটিশনই করে ফেলেছে। পিটিশনটির বিষয়, আর্জেন্টিনা যেন মেসিদের নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সঙ্গে একটা প্রীতি ম্যাচ খেলতে ঢাকায় আসে। বাংলাদেশের মানুষের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতেই তারা এটি করতে চায়।

‘মুন্দো আলবিসেলেস্ত’, ‘ক্লারিন’, ‘লা নাসিওনে’র মতো আর্জেন্টিনার বড় বড় সংবাদপত্র মেসিদের নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের মাতামাতির ওপর কয়েকটা প্রতিবেদন করেছে। সেই প্রতিবেদনগুলোর মাধ্যমেই হাজার হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থতি দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশের মানুষ যে মেসিদের কতটা ভালোবাসে, সেটি জেনেছেন আর্জেন্টাইনরা। রীতিমতো মুগ্ধ তারা।

পিটিশনটিতে ২ হাজার ৫০০ মানুষ সই দিলেই আর্জেন্টাইন ফুটবল ফেডারেশনের কাছে তা জমা দেওয়া হবে। ফেডারেশনের প্রধান ক্লদিও তাপিয়াকে অনুরোধ জানানো হবে, বাংলাদেশের সঙ্গে আর্জেন্টিনার একটি প্রীতি ম্যাচ যেনো আয়োজিত হয়। খবরে প্রকাশ, পিটিশনে ১ হাজার ৮০০ জন এরই মধ্যে সই দিয়ে ফেলেছেন।

২০১১ সালের সেপ্টম্বরে বাংলাদেশের মাটিতে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল আর্জেন্টিনা। মেসি, আগুয়েরো, হিগুয়েইন, অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া, রোমেরোরা খেলেছিলেন জন ওবি মিকেলদের নাইজেরিয়ার সঙ্গে। এই পিটিশনের কারণে যদি সত্যি সত্যিই আর্জেন্টিনা আবার বাংলাদেশে খেলতে আসে, তা হবে এ দেশের মানুষের জন্য দারুণ গর্বের ব্যাপার।

  • শীর্ষ কাহিনি