Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

মুক্তিযুদ্ধের নাটক সিনেমা পঞ্চাশে পঞ্চাশ

রেজানুর রহমান
এই প্রশ্নটাই বার বার ওঠে। দেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্ণ হয়ে গেল। ১৯৭১ থেকে ২০২২। ৫০ বছরে আমাদের সাংস্কৃতিক অর্জন কী? নাটক, সিনেমা, গান, আবৃত্তি, চিত্রকলা কতটুকু এগুলো? বিশেষ করে নাটক, সিনেমার অবস্থান এখন কোথায়? ৫০ বছরে ৫০টা ভালো সিনেমার, ৫০টা ভালো টিভি নাটক, মঞ্চ নাটক, ৫০ টা গানের তালিকা করতে বলা হলে চটজলদি তা কি করা যাবে? অনেকেই হয়তো বলবেন এই তথ্য চটজলদি দেওয়ার মতো নয়। ভাবতে হবে, খুঁজতে হবে! ভালো কথা। খুঁজেও কি বলে দেওয়া যাবে ৫০টি নাম? শিরোনাম যদি হয় পঞ্চাশে পঞ্চাশ। নাটকের ৫০, সিনেমার ৫০, গানের পঞ্চাশ… কিন্তু তালিকা তৈরি করতে বেশ খাটতে হবে।
অথচ পঞ্চাশে পঞ্চাশ খুঁজতে যাওয়ার সরল পথ থাকা উচিত। সিনেমা এই দেশে বিনোদনের প্রধান মাধ্যম ছিল। সপ্তাহে একদিন পারিবারিক ভাবে সিনেমার দেখার রেওয়াজ ছিল। নতুন সিনেমার টিকেট পাওয়া ছিল দুষ্কর। হল মালিকের সাথে বন্ধুত্ব করতে চাইতেন অনেকে। পরিবারের সবাই দল বেঁধে সিনেমা হলে যেতেন। সিনেমা দেখে এসে খাবার টেবিলে, ড্রয়িং রুমে, শোবার ঘরে, অফিসের আড্ডায় সুযোগ পেলেই সেই সিনেমা নিয়ে আলোচনা করতেন। তর্ক জুড়ে দিতেন। মুখে মুখে ছড়িয়ে যেত নতুন সিনেমার নাম। সিনেমার বড় বিজ্ঞাপন করে দিতেন দর্শকরাই।
আজকের বাংলাদেশে সিনেমার অবস্থা বড়ই করুণ। সিনেমা বলতে তেমন কিছু নাই। দর্শক সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে চায় না। এজন্য অবশ্য দর্শককে দোষারোপ করে লাভ নেই। আমরা সিনেমা নিয়ে যে সময়ের কথা বলে অহংকার করি সেই সময় আর এই সময়ের মধ্যে অনেক ফারাক। আকাশ পাতাল পার্থক্য। সেই সময়ের এফডিসি আর এই সময়ের এফডিসির তুলনা করলেই পার্থক্যটা বুঝতে সহজ হবে। এফডিসি এখন খাঁ খাঁ মরুভূমি। অবকাঠামোগত উন্নয়ন চলছে। কয়েক বছরের মধ্যে হয়তো এফডিসির চেহারা বদলে যাবে। সুদৃশ্য ভবন হবে এফডিসিতে, কিন্তু সুদৃশ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ হবে কী? সিনেমার সাথে সুদৃশ্য কথাটি বোধকরি বেমানান। বলা উচিত সুন্দর সিনেমা। দেশে এক সময় সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ১৩শ’। কমতে কমতে ওই সংখ্যা এখন একশ’র নিচে এসে দাঁড়িয়েছে। অনেক বিভাগীয় শহরেও এখন সিনেমা হল নাই। এ নিয়ে কারো টেনশন, দুশ্চিন্তাও নাই। ‘এখানে একটি সিমেনা হল ছিল’ এই কথা বলারও কেউ নাই। সিনেমা হলেই সিনেমা দেখার মজা আলাদা। অথচ সেই সিনেমা হলই নাই দেশে। যারা সিনেমা হল ভেঙে রাজকীয় মার্কেট বানালেন তাদের বক্তব্য হল রেখে কি করব? নতুন সিনেমা কোথায়? আবার পরিচালক, প্রযোজকরা বলেন, ভালো সিনেমা বানিয়ে দেখাব কোথার্য়? সিনেমা হল তো নেই। অবস্থাটা অনেকটা মুরগি আগে না ডিম আগের মতো। খামাকা বিতর্ক। নিজেদের দায় এড়াতে অহেতুক বিতর্ক। এতদিন করোনার দোহাই দেওয়া হয়েছে। করোনার আতংকজনক সময়ে পাশের দেশে কোলকাতায় সিনেমার মানুষজন থেমে থাকেনি। তারা পরিকল্পনা সাজিয়েছে। আগামীর পরিকল্পনা। করোনা থামলেই যেন যুদ্ধে নেমে পড়া যায়। আর আমাদের দেশে, সত্যিকার অর্থে সিনেমার উন্নয়নে বাস্তবভিত্তিক কোনো পরিকল্পনা নাই। ঘর পুড়ে যাওয়া সেই অলস ব্যক্তির মতো অবস্থা। ঘর পুড়ে যাচ্ছে। চেষ্টা করলেই আগুনে পানি ঢেলে ঘর রক্ষা করা যায়। গেরস্থকে বলা হচ্ছে আপনি উঠে পড়ুন। অলস গেরস্থর উক্তিÑ উঠে কি হবে? ঘর তো পুড়ে যাচ্ছে…

অথচ গেরস্থ একটু সতর্ক হলেই তার ঘর রক্ষা করতে পারতেন। তিনি দাঁড়ালেই অন্যরাও তার পাশে এসে দাঁড়াতেন। এই দাঁড়ানোর মানুষ কই আমাদের চলচ্চিত্রাঙ্গনে? মানুষ যে নেই তা কিন্তু নয়, অনেক মানুষ আছে। এফডিসিতে গেলেই দেখা যায় ছোট ছোট জায়গায় খোপে খোপে মানুষজন বসে আড্ডা দিচ্ছেন। এর সমালোচনা করছেন ওর সমালোচনা করছেন, রাজা-উজির মারছেন। একসময় কীভাবে ভালো ছবি বানিয়েছেন তার গল্প শোনান কেউ কেউ। কিন্তু বর্তমান সময়ে কীভাবে ভালো ছবি নির্মাণ করা সম্ভব সেই আলোচনা কোথাও গুরুত্ব পায় না। বরং দলাদলি স্পট। শিল্পী সমিতির একটি চেয়ার নিয়ে দলাদলিটা দিনে দিনে ব্যাপক আকার নিচ্ছে। ফলে দেশের সিনেমার সার্বিক অবস্থা নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেতিবাচক ধারণা পোক্ত হচ্ছে।
আশার কথা, সিনেমা অঙ্গনে অচলাবস্থা দূর করতে ১৯ সংগঠনের একটি ঐক্যবদ্ধ প্লাটফরম তৈরি হয়েছে। জীবন্ত কিংবদন্তি নায়ক আলমগীর এই উদ্যোগের নেতৃত্বে দিবেন। কথা হলো তাঁর সাথে। সম্ভাবনার অনেক কথা শোনালেন। এখন অপেক্ষার পালা। আমাদের সিনেমা একদিন নিশ্চয়ই ঘুরে দাঁড়াবে। আমরা চট করেই ৫০টি সিনেমার নাম বলে দিতে পারব।
এবার আসি টিভি নাটকের কথায়। টিভি নাটক বলতেই একটা সময় বাংলাদেশ টেলিভিশনের নাটক বোঝাত। এ সপ্তাহের নাটক ছিল সবার প্রিয় অনুষ্ঠান। যে যেখানেই থাকুক সপ্তাহের নাটক মিস করতেন না। একটা সময় প্যাকেজ নাটকের প্রচলন শুরু হলো। অর্থাৎ বেসরকারিভাবে নির্মাতারা টিভিনাটক বানাতে তৎপর হলেন। বেসরকারি একাধিক টেলিভিশনের জন্ম হলো। টিভি নাটকের কদর বেড়ে গেল। একসময় বিটিভিতে সপ্তাহে একটা নাটক দেখা যেত আর এখন দিনে দেশের সব টিভি চ্যানেল মিলিয়ে ধারাবাহিকসহ ২৫/৩০টি নাটক দেখার সুযোগ পাচ্ছে দর্শক। এটা তো একটা বিরাট পরিবর্তন। কিন্তু প্রশ্ন হলো বিটিভি আমলের ওই এক সপ্তাহের নাটকটি দর্শক যে পরিমাণ আগ্রহ নিয়ে দেখত বর্তমান সময়ে দিনের ২৫/৩০টি নাটকটি কী সেভাবে দেখে? সহজ উত্তরÑ দেখে না। কিন্তু সমালোচনা করে। সমালোচনাটা হলো আমাদের দেশে কিছুই হয় না। ভালো সিনেমা হয় না। ভালো নাটক হয় না। ভালো গান হয় না। অথচ এটা ভুল তথ্য। সিনেমার কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না। আমাদের টিভি নাটক মঞ্চনাটক সকল সংকট ও অস্থিরতা মোকাবিলা করে ঠিকই সম্ভাবনার পথ খুঁজে নিয়েছে। এফডিসি ঘরানার বাইরে অনেক তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক ভালো সিনেমা বানাচ্ছেন। টিভি নাটকে অনেক সম্ভাবনাময় তরুণ নাট্যকার ও পরিচালকের আবির্ভাব ঘটেছে। শুধুমাত্র কার্যকর সহযোগিতার অভাবে তাদের অনেকেই আলোচনায় আসছেন না। টিভি নাটকের ক্ষেত্রে ৫০ বছরে ৫০টি ভালো নাটকের নাম হয়তো বলতে কষ্টকর হবে না। তবে এই কাজটা করবে কে?
তবে হ্যাঁ, আমাদের মঞ্চ নাটক ঠিকই তার জায়গা ধরে রেখেছে। করোনার সংকটেও দেশের মঞ্চ চর্চা থেমে থাকেনি। অনলাইনে মহড়া করেও মঞ্চে নতুন নাটক এনেছে একাধিক নাট্যদল। বিনে ভাড়ায় নাটক মঞ্চায়নের সুযোগ করে দিয়েছে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। মঞ্চ নাটকের ক্ষেত্রে পঞ্চাশে পঞ্চাশ বলে দেওয়া সহজ। কিন্তু এ ব্যাপারেও যথার্থ উদ্যোগ জরুরি।
একথা সত্য, আমাদের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের গান ছিল অযুত প্রেরণার উৎস। দেশের গানের শক্তি মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক অনুপ্রাণিত করেছে। ‘তীর হারা সেই ঢেউয়ের সাগর’ অথবা ‘আবার জমবে মেলা বটতলা হাটখোলা’, এই গানগুলো রণাঙ্গনে, আশ্রয় শিবিরে অনেক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। সেই গানও এখন কোণঠাসা। দেশের গান শুনতেও চান না অনেকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলামÑ একটি নামকরা কলেজের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। একজন শিল্পী নজরুল সঙ্গীত গাইছেন। অডিয়েন্স বেশ বিরক্ত। অনেকে শিল্পীর কণ্ঠের সাথে বেসুরো কণ্ঠ তুলে অবজ্ঞার ভঙ্গি করছে। বিব্রত ওই শিল্পী মঞ্চ থেকে নেমে গেলেন। খোলামেলা পোশাকে মঞ্চে উঠে এলেন একজন তরুণী। শুরু করলেন চটুল হিন্দি গান। ব্যস, পরিস্থিতি পাল্টে গেল। দর্শক নাচতে শুরু করল। এটাই বাংলাদেশের সঙ্গীতের বাস্তব অবস্থা। সেখানে ৫০টি ভালো গান খুঁজে কাকে উপহার দিবেন?
তবুও কি আমরা থেমে থাকব? না থেমে থাকার কোনো যৌক্তিক কারণ নাই। সুন্দর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতেই এগিয়ে যেতে হবে। আনন্দ আলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে অচিরেই সাংস্কৃতিক অঙ্গনের পঞ্চাশে পঞ্চাশ একটি তালিকা প্রকাশ করবে। এজন্য প্রিয় পাঠক, আপনাদের সহযোগিতা চাই। পরের সংখ্যায় বিস্তারিত ঘোষণা আসবে। সবার জন্য রইল শুভ কামনা।