Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

বাবার লেখা পড়লেই হাহাকার লাগে- শীলা আহমেদ

হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমনি’ ছবিটিতে যারা শীলা আহমেদের অভিনয় দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই একবাক্যে স্বীকার করবেন কী দুর্দান্ত অভিনয়ই না করেছিলেন তিনি। নিস্পাপ মুখ, আদুরে চেহারা। বাংলাদেশের সিনেমা দর্শক নতুন এক অভিনেত্রীকে খুঁজে পেয়েছিল। অনেকেই ধরে নিয়েছিল এই মেয়ে একদিন আমাদের টিভি নাটক ও সিনেমা জগতে সম্ভাবনার অনেক আলো ফেলবেন। সেই পথেই হাঁটছিলেন শীলা আহমেদ। কিন্তু পারিবারিক কারণে মাঝপথে হঠাৎ অভিনয় জগৎ থেকে দূরে সরে যান। প্রচার মাধ্যম থেকে দীর্ঘদিন নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। সম্প্রতি আড়াল ভেঙ্গেছেন। বাবা হুমায়ূন আহমেদের লেখালেখি নিয়ে অনেক কথা বলেছেন।
হুমায়ূন আহমেদের ব্যক্তিগত অনেক কিছুই পাঠকের জানা। যেমন তিনি সাধারনত কখন লিখতেন। তার লেখার পদ্ধতিটা কেমন ছিল? জানা ব্যাপারটি সুন্দর ভাবে তুলে ধরেছেন শীলা আহমেদ। তার বলার ভঙ্গি অনেকটাই বাবা হুমায়ূন আহমেদের মতোই। বাবা লেখার আগে পায়চারি করতেন। প্রচুর সিগারেট খেতেন। হয়তো লিখছেন। হঠাৎ লেখা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘরের ভিতরই হাঁটতে শুরু করে দিতেন। পাঁচ মিনিট পর-পর চা চাইতেন। অনেকে লেখালেখি করার সময় নিরিবিলি পরিবেশ চান। কিন্তু বাবা হইচই পরিবেশ ছাড়া লিখতে পারতেন না। হইচই আর আনন্দের মাঝেই তিনি লিখতে স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন। এমনও হয়েছে সারারাত জেগে তিনি পুরো একটা উপন্যাস লিখে ফেলেছেন। লেখা শেষ হলেই নিজে কখনই পড়তেন না। তবে আমাদেরকে পড়তে দিতেন। সাধারনত সমালোচনা সহ্য করতে পারতেন না। রেগে যেতেন। তবে পরিবারের সদস্যদের সমালোচনা শোনার পর প্রায়শই লেখার ক্ষেত্রে ছোটোখাটো কিছু পরিবর্তন করতেন। আমরা তো তখন বাচ্চা মানুষ। সাধারন পাঠক। আমাদেরকে লেখা পড়তে দিয়ে বাবা সাধারন পাঠকের মনোভাব বুঝতে চাইতেন। হয়তো দেখা গেল একটি লেখা শেষ হয়ে গেছে। আমাদেরকে পড়তে দিয়েছেন। আমরা তার লেখা পড়ছি। তিনি আমাদের সামনে দিয়ে গম্ভীর মুখে পায়চারি করতেন। বার-বার আমাদের মুখের দিকে তাকাতেন। আমাদের রিয়াকশন বোঝার চেষ্টা করতেন। হয়তো উপন্যাসটা অনেক দুঃখের। কাজেই উপন্যাস পড়ে কাঁদছি কিনা তাও খেয়াল করতেন। এমনও হয়েছে, দুঃখের কাহিনী পড়ে আমরা কাঁদছি না। দারুণ রেগে যেতেন। দুঃখের কাহিনী পড়ে না কাঁদাটা যেন একটা অপরাধ… কোনো উপন্যাস লিখতে শুরু করে কোনো কারণে আটকে গেলে প্রচন্ড রাগী মানুষ হয়ে উঠতেন। যাকে কাছে পেতেন তাকেই ধমকাতেন। জোছনা ও জননীর গল্প লেখার সময় দেখেছি তিনি চেষ্টা করেও যেনো পারছিলেন না। খুব ছটফট করতেন। কিন্তু পরে লেখা শুরু করার পর একটানেই লিখে গেছেন।
লেখক হিসেবে হুমায়ূন আহমেদ কেমন ছিলেন? তার চমৎকার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন শীলা আহমেদ। আমি তো সাধারন পাঠক। গুরুগম্ভীর মন্তব্য করতে পারব না। তবে সাধারন পাঠক হিসাবেই বলি বাবার লেখালেখি অন্যদের চেয়ে একেবারেই আলাদা। বাবার প্রতিটি উপন্যাসে একটা মায়া আছে। পড়ার পর হাহাকার লাগে। চরিত্রগুলোর প্রতি মায়া তৈরি হয়। এক সময় মনে হতো আমি লেখকের মেয়ে বলেই হয়তো এমন চিন্তা করি। কিন্তু বিষয়টাতো এমন ছিল না। সব পাঠকই আমার মতো ভাবতো। এখনও ভাবে… লেখক বাবার একটু সমালোচনাও করেছেন শীলা আহমেদ। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন আমার ধারনা লেখক জীবনের একটা সময় বাবার মাঝে অহমিকা এসেছিল। তবে সেটা তার বন্ধু মহল পরিবর্তন হওয়ার পর। জ্ঞান হওয়ার পর থেকেই দেখতাম, বাবা খুবই জনপ্রিয় লেখক। তবে তাঁর জীবনযাত্রা ছিল খুবই সাদামাটা। তিনি সব সময়ই বলতেন জীবনে কখনই অহংকারকে প্রশ্রয় দিবে না। আমার মেয়ে হিসেবে কখনই কোনো বাড়তি সুবিধা নিবে না। শুটিং এর সময় আমার জন্য বাড়তি কোনো আয়োজন থাকতো না। সবাই যা খাচ্ছে আমিও তাই খাচ্ছি। সব সময় বলতেন, শোনো তোমার প্রধান পরিচয় যেন হুমায়ূন আহমেদের মেয়ে না হয়।
তবে হ্যা, শেষের সময়ে বাবা এমনটা ছিলেন না। বাবার প্রথম দিকের বন্ধুরা যারা ছিলেন তারা বাবার লেখালেখির সমালোচনা করতেন। নানা বিষয়ে তর্কও হতো। বাবা তাঁর বন্ধুদের গঠনমূলক সমালোচনা মেনে নিতেন। কিন্তু পরের দিকে বাবার বন্ধু হয়ে যারা এসেছিলেন তারা তাঁর গঠনমূলক সমালোচনা করতে বোধকরি ভয় পেতেন। তাদের বেশির ভাগেরই এমন মনোভাব ছিল, স্যার আপনি যা করবেন এটাই ঠিক। আমার ধারনা বাবা এভাবেই মিস গাইডেড হন।
সন্তানের কাছে বাবা-মায়ের চেয়ে বড় স্মৃতি বোধকরি আর হয়না। শীলাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলÑ বাবার কোন স্মৃতি বেশী মনে পড়ে আপনার? মর্মস্পর্শী অনুভব প্রকাশ করেছেন শীলা আহমেদ। সত্যি বলতে কী বাবার মুখ আমার বেশী মনে পড়ে না। তবে মনে পড়ে বিদেশ থেকে আসা তার কফিনটা। বিমান থেকে তার কফিনটা নামানো হচ্ছিলো। আমাদের ঘিরে তখন অসংখ্য লোক। শত শত ক্যামেরার চোখ আমাদের দিকে। কফিন বহন করার জন্য গাদা ফুল দিয়ে সাজানো লাশের গাড়ি। চারপাশ থেকে ছবি তোলা হচ্ছে। বাবার মৃতদেহ যে ফ্লাইটে এসেছে একই ফ্লাইটে আরেকটা কফিন এসেছিল।
একটি মেয়ে হয়তো তার মায়ের হাত ধরে কফিনের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। মনে হচ্ছিলো মেয়েটি ঘৃনার চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। তার হয়তো মনে হচ্ছিলো, আমার বাবা মারা গেছে বলে চারদিকে এতো আয়োজন। অথচ সেও তো তার বাবাকে হারিয়েছে। কিন্তু তার বাবার জন্য কোনো আয়োজন নাই। আমার তখন কেবলই মনে হচ্ছিলো তাকে গিয়ে বলি, এই গাদা ফুল, ক্যামেরা, হাজার-হাজার মানুষের ভীড়Ñ এসবের কোনো মূল্য নাই আমার কাছে। প্রিয়জন হারানোর বেদনা তোমার আর আমার ভেতর একই রকম…
কী সহজ সরল স্বীকারোক্তি। যেন হুমায়ূন আহমেদেরই কোনো চরিত্রের সংলাপ। শীলা আহমেদের পক্ষেই একথা বলা সম্ভব। কারণ তিনিই তো গুণী বাবার গুণী মেয়ে…