Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আত্মহত্যাকে না বলুন-শবনম ফারিয়া

মেয়েটির নাম অরিত্রী। নামকরা স্কুলের ছাত্রী। পরীক্ষার হলে মোবাইলের মাধ্যমে নকল করার অপরাধে তাকে অভিযুক্ত করা হয়। তার বাবা-মাকে ডেকে এনে স্কুল কর্তৃপক্ষ অনেক কটু কথা শোনায়। অরিত্রীকে স্কুল থেকে বহিস্কার করার হুমকিও দেয়। লজ্জা অপমান সহ্য করতে না পেরে অরিত্রী আত্মহত্যা করে। অরিত্রীর আত্মহত্যার ঘটনায় দেশের শিক্ষাঙ্গণ সহ সমাজ জীবনের সর্বস্তরে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার নানা অসঙ্গতি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন ইত্যাদি নানা বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মহলে রীতিমত বাদানুবাদ চলছে। জীবনের কঠিন সমস্যার মুখামুখি হলেই মূলতঃ মানুষ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। কিন্তু আত্মহত্যাই জীবনের সঠিক পথ নয়। জীবন চলার পথে সমস্যা সংকট থাকবেই। সমস্যা সংকট মোকাবেলা করে একটু এগুলেই দেখবেন কত শান্তি। আজ যে আপনাকে দুঃখ দিয়েছে সেই আপনার গুণগান গাইবে। কাছে আসতে চাইবে। যেখানে এতো আনন্দ সুখ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে সেখানে কেন আপনি আত্মহত্যার মতো ঘৃন্য পথ বেছে নিবেন। জীবন সুন্দর। যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে জীবনেক জয় করতে শিখুন। তাহলেই দেখবেন পৃথিবীতে আপনিই সবচেয়ে সুখি মানুষ হয়ে উঠেছেন।
আত্মহত্যা কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়। যদি আত্মহত্যা করতাম তাহলে কি জীবনের বর্তমান সুখ গুলো উপভোগ করতে পারতাম? এমনই প্রশ্ন তুলে জনপ্রিয় অভিনেত্রী শবনম ফারিয়া ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘শুনতে খুব সহজ শোনালেও যে বিষয়টার মধ্য দিয়ে যায় সেই জানে এইটা নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন কতটা কঠিন! আমার প্রথম ডিপ্রেশন (বিষন্নতা) শুরু হয় ২০১৫ সালে, একটা “সামান্য” ব্রেকআপে। যদিও এখন সামান্য বলছি, তখন বিষয়টা মোটেও সামান্য ছিল না। সে সময় আমি কিংবা আমার পরিবার বুঝতে পারেনি যে আমার সেই অস্বাভাবিক আচরণ, রুমের মধ্যে নিজেকে বন্ধ করে রাখা, সারাক্ষণ ঘুমানোর চেষ্টা করা, বন্ধুবান্ধবদের সাথে শেয়ার না করে ফেসবুকে সংবেদনশীল কথাবার্তা লিখে ফেলা, রাতের পর রাত ঘুম না হওয়ায় শুটিংয়ের সেটে খিটখিটে মেজাজে থাকা বিষন্নতার একটা বহি:প্রকাশ! সেই বিষন্নতা প্রায় ছয় মাসের মতো ছিল। আমার বাবা-মার চেষ্টায় অনেকটাই স্বাভাবিক হয়।’
দ্বিতীয়বার আবার বিষন্নতা বুঝি বাবা মারা যাওয়ার পর। যেহেতু ছোটবেলা থেকেই বাবা-মা সবচেয়ে ভাল বন্ধু ছিল, আর আমার বাবাকে যারা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন শুধু তারাই জানে আমার বাবা আর আমার বন্ধুত্বের পরিধি। বাবার মৃত্যুর পর আমার মনে হলো আমার আসলে কেউ নেই। মার কিছু হলে আমার কী হবে! আমার বিষন্নতা কাটাতে মা অনেকটা জোর করেই বাবা না ফেরার দেশে চলে যাওয়ার ১৫ দিনের মধ্যেই কাজে পাঠায়। তখন যেটা হলো কাজে থাকলে আমি সব ভুলে যাই। যেহেতু আমার পেশাটাই অদ্ভুত একটা পেশা। যে সেট এ ঢুকলেই আমরা অন্য কেউ হয়ে যেতে পারি! কিন্তু বাসায় ফিরলে সেই একই অনুভূতি। আমার মা কিন্তু আর সেই রিস্ক নেয়নি। আমাকে “ক্লিনিকেল সাইকোলজিস্ট” এর কাছে পাঠান এবং ২/৩ বার কথা বলার পরেই আমার বিষন্নতা সে বারের মত চলে যায়।

আত্মহত্যার মতো একটা বাজে বিষয় নিয়ে কেন লিখছি তার একটি ব্যাখ্যা আছে আমার কাছে। সেই প্রথমবারের ছয়মাস বিষন্নতায় থাকা অবস্থায় কম করে হলেও ১২ বার আমি সুইসাইডের কথা ভেবেছি! ঘুমের ওষুধের পাতা হাতে নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে নিজের সাথে নিজে যুদ্ধ করেছি। সেসময় আমি যদি চলে যেতাম, তাহলে কি আজকে আমি শবনম ফারিয়া হতে পারতাম? আপনার আমাকে চিনতেন? অচেনা-অজানা এতো মানুষের ভালবাসা পেতাম? একজন মানুষের ভালবাসা পাইনি বলে এতো এতো ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হতাম? আর এখন যে মানুষটি আমার হাতটা ধরেছে, আমার সব স্বপ্নের সঙ্গী, তাকেই বা পেতাম কোথায়? অন্তত তার সাথে অকারণেই ঝগড়াগুলো কিভাবে করতাম? জীবনকে সুযোগ দিতে হয়, ভুল করতে হয়, ধাক্কা খেতে হয়, নয়তো তুমি যখন অনেক বড় কেউ হবে, তোমার বায়োপিকে কী লিখবা?’
জীবনটা চ্যালেঞ্জিং ও বিভিন্ন কিছু মোকাবেলা করতে হয়। এসব ঘটনা না থাকলে তো বোরিং হয়ে যাবে। বলিউডের সঞ্জয় দত্তের এমন অঘটন না ঘটালে আমরা সাঞ্জু’র মত অসাধারণ সিনেমা কোথায় পেতাম! কিংবা বাবার চলে যাওয়ার পর যদি কিছু করতাম তাহলে আমার মা’র কী হতো একবার ভাবতে পারেন, আমার মার পৃথিবী আমাকে ঘিরে, আমার কিছু হলে তার কী হতো! প্রত্যেকটা বাবা মার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস তার সন্তান। তবে একেকজনের প্রকাশ ভঙ্গি একেক রকম! কেউ আদর করে কপালে চুমু দিয়ে বলে, বাবা হোমওয়ার্কটা করতে যাও। আবার কেউ চিৎকার দিয়ে বলে এখনো পড়তে বসলি না? কিন্তু দুজনের উদ্দেশ্য কিন্তু একই।’
আমার মা যেমন নামাজ নিয়ে কিঞ্চিত যন্ত্রনা দেয়। যখন মুড ভাল থাকে “বাবা নামাজটা পড়ো, সব সমস্যার সমাধান এইটা, বাবার কথা মনে পড়লে নামাজে বলো, আল্লাহ্ বাবার কাছে তোমার মনের কথা পৌঁছে দেবে। আর মেজাজ খারাপ থাকলে পশ্চিম দিকে তো আছাড়ও খাও না, তোমার সমস্যা হবে না কে তো কার হবে। কিন্তু ভেবে দেখেন সে আমার ভাল চায় বলেই এমনটা বলে! এই অত্যাচারের মধ্যে লুকিয়ে আছে অনেক ভালবাসা।’
মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে বাঁচতে হলে অনেক কিছুর মুখোমুখি হতে হয়। যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে পালানো খুব সহজ, কিন্তু যুদ্ধে জয়ী হওয়া কঠিন। কিন্তু যদি কষ্ট করে একবার তুমি জিতে যাও, সারা পৃথিবী তোমাকে মনে রাখবে, কিন্তু যদি পালাও, মানুষ ৪০ দিন মনে রাখবে তাও কাপুরুষ হিসাবে! অরিত্রী নামের মেয়েটা কে যদি টিসি দেয়া হতো, তাহলে কি এমন হতো? বাবা-মা একটু বকা দিত! পাশের বাসার আন্টি দুই চারটা কথা বলতো! কিন্তু অরিত্রী যদি অন্য স্কুল থেকে পরিক্ষা দিয়ে ভাল রেজাল্ট করতো, কেউ কোনদিন এই ঘটনা মনেও রাখতো না! এই যে ওর ক্লাস টিচারকে এরেস্ট করা হয়েছে, উনি কি কারো মেয়ে না? কারো মা না? তাদের অসম্মান হচ্ছে না? এইযে প্রিন্সিপালকে গালি দিচ্ছে, শাড়ি ধরে টানছে, সে কি কারো মেয়ে না? তার অসম্মান হচ্ছে না?’
‘কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য এইটা একটা শিক্ষাও বটে! লেবু বেশি কচলালে তিতা হয়ে যায়! শিক্ষা জীবনের খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু এইটাই সব না! সবার এ+ পাওয়াটা ফরয কিছু না! কিছু হলে বাবা-মা ডেকে এনে অপমান এই কালচার এই উপমহাদেশ ছাড়া আর কোথাও নেই। একটা ক্লাস নাইনের বাচ্চা যদি নকল করে (ধরে নিলাম করেছে) সেইটার দ্বায়ভার তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেই নিতে হবে! তারা শেষ ১০ বছরে কি মোরাল শিক্ষা দিয়েছে? বরং বাবা-মা উল্টো বেøইম করবে আপনাদের মতো স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আমার বাচ্চাকে কী শিখালো যে সে নকল করার মতো একটা অন্যায় করতে পারলো!

পরিসংখ্যান
বিশ্ব
য় পৃথিবীতে বছরে ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যা করে
য় প্রতিদিন আত্মহত্যার চেষ্টা করে ৬০ হাজার জন্য
য় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা ২০২০ সাল নাগাদ পৃথিবীতে আত্মহত্যার সংখ্যা হবে বছরে সাড়ে ১৫ লাখ।
য় পৃথিবীতে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের মৃত্যুর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ কারণ হচ্ছে আত্মহত্যা।
য় দক্ষিণ এশিয়ায় দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলঙ্কায় আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি (বছরে প্রতি লাখে ২৯ জন)।
য় ২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন অব মেন্টাল হেলথের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সব মানসিক রোগের ৫০ শতাংশ শুরু হয় ১৪ বছর বয়সের আগে আর ৭৫ শতাংশই শুরু হয় ২৫ বছর বয়সের আগে! অর্থাৎ বিষণœতা থেকে শুরু করে আত্মহত্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ রোগগুলো এই বয়সেই বেশি হয়ে থাকে।

বাংলাদেশ
য় বাংলাদেশে প্রতিবছর ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যার শিকার।
য় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রতি লাখে ৭ দশমিক ৮ জন আত্মহত্যা করে।
য় গবেষণারয় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট আত্মহত্যাকারীদের দুই-তৃতীয়াংশই নারী, তাদের বেশির ভাগের বয়স ১১ থেকে ২৫ বছর।
য় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৭ সালে প্রকাশিত মেন্টাল হেলথ স্ট্যাটাস অব অ্যাডলসেনস ইন সাউথ-ইষ্ট এশিয়া : এভিডেন্স ফর অ্যাকশন শীর্ষক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, বাংলাদেশেল ৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী এক বা একাধিকবার আত্মহত্যার চেষ্টা করছে। এর মধ্যে ৭ শতাংশ ছেলে ও ৬ শতাংশ মেয়ে।
য় বাংলাদেশে আগে থেকে আত্মহত্যার কল্পনা। করে ৮ শতাংশ কিশোর-কিশোরী। কল্পনায় আত্মহত্যার বিষয়টি ঘুরপাক খায় ৫ শতাংশ কিশোর-কিশোরীর মধ্যে।

আত্মহত্যা বিষয়ে সংবাদকর্মীদের জন্য
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন
য় আত্মহত্যার খারাপ দিক সম্পর্কে জনগণকে জানান।
য় আত্মহত্যা কোনো সমাধান নয়Ñ লেখার সময় তা মাথায় রাখুন। একই সঙ্গে আত্মহত্যাকে স্বাভাবিক হিসেবে উপস্থাপন করে, এমন ভাষা পরিহার করুন।
য় পত্রিকার গুরুত্বপূর্ণ অংশে আত্মহত্যার খবর ছাপাবেন না। আবার ঘটনার অযৌক্তিক পুনরাবৃত্তি অনাবশ্যক।
য় লেখায় আত্মহত্যা কিংবা আত্মহত্যার চেষ্টার রগরগে বর্ণনা দেবেন না। যে স্থানে আত্মহত্যা সংঘটিত হয়েছে, তার বর্ণনা দেওয়া থেকেও বিরত থাকুন।
য় বুঝেশুনে শিরোনাম দিন।
য় স্থির বা ভিডিওচিত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করুন।
য় তারকাদের আত্মহত্যার খবর উপস্থাপনার ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দিন।
য় আত্মহত্যার মৃতের স্বজনদের প্রতি শ্রদ্ধা রাখুন।
য় কোথায় ও কীভবে সাহায্য চাইতে হবে, সে তথ্য দিন।
য় খোদ সংবাদকর্মীরা আত্মহত্যার খবর থেকে প্রভাবিত হতে পারেন। তা-ও মাথায় রাখুন।