সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত © 2001-2021 - আনন্দ আলো
অজানাকে জানা, অচেনাকে চেনা, অদেখাকে দেখা মানুষের চিরন্তন অভ্যাস। তাইতো কৌতূহলী মন নিয়ে মানুষ পাড়ি জমায় এক দেশ থেকে অন্য দেশে। সাত সাগর তেরো নদী পেরিয়ে মানুষ পান করতে চায় মুগ্ধতার অমৃত সুধা। অবাক হতে চায় প্রকৃতির মোহনীয় সৌন্দর্যের আধারে। পেটে যেমন ক্ষুধা আছে; তেমনি ক্ষুধা আছে মনেরও। কর্মক্লান্ত মন সে ক্ষুধা মেটাতে প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে উদগ্রীব হয়ে ওঠে। কখনও নয়নাভিরাম প্রকৃতিকে অক্ষুণœ রেখে, কখনও প্রকৃতি আর কৃত্রিমতার ছোঁয়া দিয়ে, আবার কখনও সম্পূর্ণ কৃত্রিমভাবে দেশে দেশে দ্রæত সম্প্রসারিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প। এমন অনেক দেশ আছে যার প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী খাত পর্যটন শিল্প।
প্রকৃতির অনন্য লীলাভূমি, অপার সৌন্দর্যের বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পের এক সম্ভাবনাময় দেশ। প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক আর ঐতিহ্যেও বাংলাদেশ পিছিয়ে নেই। এদেশে আছে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। আছে সৌন্দর্যের আধার পতেঙ্গা, পারকি, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন, কুয়াকাটা। পাহাড় ও দ্বীপের মধ্যে আছে রাঙামাটি, কাপ্তাই, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি, মহেশখালি, নিঝুম দ্বীপ, সোনাদিয়াসহ প্রায় অসংখ্য চরাঞ্চল ও দ্বীপ। আরও আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। এই বনেই বাস করে ভয়ঙ্কর সৌন্দর্যের প্রাণী বেঙল টাইগার, চিত্রা হরিণ, কুমির, ঈগল, শকুন, মদনটাক, বানরসহ নানা প্রজাতির প্রাণী। সৌন্দর্যের আধার রাতারগুলও আমাদের এক অমূল্য সম্পদ। আমাদের আছে ঐতিহাসিক স্থান এবং প্রতœতাত্তি¡ক নিদর্শনসমূহ। আছে মাধবকুÐ, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, গড়াই, মধুমতিসহ শত শত নদ-নদী। আছে বাটালী হিল, তামাবিল, হাওর-বাঁওড়সহ আরও অনেক চোখ জুড়ানো স্থান যা যেকোনো দেশের পর্যটকদের বিমোহিত করে, মুগ্ধ করে, উচ্ছ¡সিত করে। একবার কেউ চোখ জুড়ানো সবুজে মোড়ানো বাংলাদেশের প্রেমে পড়লে সহজে এ দেশের কথা ভুলতে পারেন না। ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাঙ -এর মতো পর্যটকদের আগমন সেটাই প্রমাণ করে।
পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য একটি দেশের যা যা থাকার দরকার তার সবই আছে বাংলাদেশে। শুধু আমাদের অজ্ঞানতা, হেঁয়ালিপনা, অবহেলা, অসচেতনতার কারণে দিন দিন বিনষ্ট হচ্ছে অনেক দর্শনীয় স্থানের পরিবেশ। দর্শনীয় স্থানগুলোতে অতিরিক্ত পর্যটকের আগমন আনন্দের সংবাদের না হয়ে দুঃসংবাদে পরিণত হচ্ছে। যেমন দেশের একমাত্র প্রবালসম্বৃদ্ধ দ্বীপ সেন্টমার্টিনের ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত পর্যটক প্রতিদিন জাহাজে করে যাতায়াত করছে। অবাধে গড়ে উঠছে হোটেল-মোটেলসহ দোকান-পাট। সেন্টমার্টিন প্রবালসম্বৃদ্ধ দ্বীপ হওয়ার কারণে ইট-পাথরের বহুতল ভবন নির্মাণ দ্বীপের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। প্রবাল তোলা ও বিক্রি নিষেধ থাকলেও অবাধে তা বিক্রি হচ্ছে। মাছ ধরার নৌকার নোঙর প্রবালের ওপরে ফেলায় ভেঙে যাচ্ছে প্রবাল কলোনী এবং ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পুরো পরিবেশ। প্রতিবছর সেন্টমার্টিন থেকে অবৈধভাবে প্রায় ৩০ হাজার প্রবাল তোলা হচ্ছে। ঘরের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দ্বীপটির সৌন্দর্য এবং স্বকীয়তা দুটোই আমরা ধ্বংস করছি প্রতিনিয়ত। আবার অসচেতন পর্যটকরা চিপসের প্যাকেট, পানির বোতল, কোমলপানীয়র ক্যান ইত্যাদি যথেচ্ছ ফেলে বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত করছেন সৈকত ও সাগরের পানিকে। রাতে উচ্চৈস্বরে গান বাজনা আর হৈ-হুল্লোড়ের কারণে ভয়ে অনেক প্রাণী দ্বীপের কাছ ঘেঁষছে না। বিশেষ করে বিশ্বের দুর্লভ প্রজাতির অলিভ রিডলে টার্টল (জলপাইরঙা কাছিম) ভয়ে ডিম না পেড়ে চলে যাচ্ছে অন্য জায়গায়। ব্যাহত হচ্ছে তাদের বংশবিস্তার। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশের মানচিত্র থেকে একদিন দ্বীপটি হারিয়ে যাবে দক্ষিণ তালপট্টির মতো।
পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজারে পানি ও পরিবেশ বর্তমানে বর্জ্যরে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। দেশের অন্যান্য সৈকতেরও একই অবস্থা।
আবার অজ্ঞানতার কারণে পর্যটকরা বনের ভেতরে গিয়ে গাছ উপড়ে, পাতা ছিঁড়ে, ফুল তুলে নানাভাবে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। অনেকেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে বনে ঘুরতে গিয়ে বন্যপ্রাণী শিকার করছে। বনের ভেতর মাইক বাজিয়ে আনন্দ-উল্লাস করছে। এতে পশুপাখির প্রজননে বাধা পাওয়াসহ ভয় পেয়ে তারা সে স্থান ত্যাগ করছে।
সুন্দরবনও রক্ষা পায়নি অবিবেচক পর্যটকদের অত্যাচার থেকে। সমুদ্রের পানিতে খাবারের বোতল, প্যাকেট ভাসাসহ কটকা সৈকতের বর্তমান বেহাল দশা দেখলে বিদেশি পর্যটকরা সুন্দরবনের অপার সৌন্দর্যের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে।
দেশের পরিচিতি ও অর্থনৈতিক সম্বৃদ্ধি আনে পর্যটন শিল্প। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী রেসপন্সিবল ট্যুরিজম বা দায়িত্বশীল ভ্রমণ এবং ইকোট্যুরিজম বা পরিবেশবান্ধব ভ্রমণ এর কোনও বিকল্প নেই। উন্নত বিশ্বে যেকোনও পর্যটকদের নির্ধারিত নিয়ম নীতি বা বিধিমালার ভেতরেই ভ্রমণ সম্পন্ন করতে হয়। আমাদের দেশে সেসব নীতিমালা অনুসরণ করা হয় না বললেই চলে। এ ক্ষেত্রে সবার সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। পর্যটন শিল্পের বিকাশে অগ্রণী ভূমিকাসহ দর্শনীয় স্থানগুলোর পরিষ্কার-পরিচ্ছনতাই পারে পরিবেশবান্ধব পর্যটন শিল্প গড়তে।
লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন