Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

জলার বন রাতারগুল-মুকিত মজুমদার বাবু

জলার বন। পৃথিবীতে মিষ্টি জলের এমন বন আছে মাত্র ২২টি। ভারতীয় উপমহাদেশে আছে দুটি। একটি শ্রীলঙ্কায়। আরেকটি বাংলাদেশের সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুর ইউনিয়নে। নাম রাতারগুল। এ বনে অনেক মূর্তা বা পাটিগাছ জন্মে। সিলেটের স্থানীয় ভাষায় পাটিগাছ ‘রাতাগাছ’ নামে পরিচিত। সেই রাতা গাছের নামানুসারে বনের নাম হয়েছে রাতারগুল। আর এই মূর্তাগাছ থেকে তৈরি হয় বিখ্যাত শীতল পাটি।

উত্তরে গোয়াইন নদী, দক্ষিণে বিশাল হাওর। মাঝখানে জলার বন রাতারগুল।বনটির আয়তন তিন হাজার ৩২৫ দশমিক ৬১ একর। এর মধ্যে ৫০৪ একর বনকে ১৯৭৩ সালে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। অনেকেই বনটিকে আমাজনের সঙ্গে তুলনা করেন। আবার কেউ কেউ ‘সিলেটের সুন্দরবন’ও বলে থাকেন।

জলসহিষ্ণু গাছ নিয়ে রাতারগুল জলার বন। এ বনে মূর্তা, করচ, হিজল, বরুণ, পিটালি, ছাতিম, গুটিজাম, বেতসহ বিভিন্ন গাছ দেখা যায়। বর্ষা মৌসুমে ভারতের মেঘালয়ের জলধারা গোয়াইন নদী হয়ে চেঙ্গীর খাল দিয়ে প্লাবিত করে রাতারগুল জলার বন। এ সময় বনের অপরূপ শোভা উপভোগ করতে ভিড় জমায় পর্যটকরা। বনের ভেতরে ঘন গাছগাছালির সারির কারণে সূর্যের আলো গাছের পাতা ভেদ করে জলের মুখ দেখতে পারে না। বাংলাদেশের সব বন থেকে রাতারগুল একেবারেই আলাদা।

রাতারগুল জলের রাজ্যে পর্যটকরাছোট ছোট ডিঙি নৌকা ভাড়া করে বন ঘুরে দেখেন। বনের শুরুতেই মূর্তাগাছে ঠাসাঠাসি। এরপর গাছের ফাঁক-ফোকর দিয়ে ডালপালা সরিয়ে এগিয়ে চলা। বৈঠা-জলের ছলাৎ ছলাৎ সুর, জেলেদের জাল পাতা, আর সে জালে উঠে আসা টেংরা, খলিশা, রিঠা, পাবদা, মায়া, আইড়, কালাবাউস, রুইসহ বিভিন্ন তাজা মাছের নাচন দেখার মজাই আলাদা। নৌকায় ভাসতে ভাসতে চোখে পড়বে ধ্যানী বক, জোঁকের বেঁকে বেঁকে চলা, সাপের সাঁতার কাটা কিংবা গাছের ডাল জড়িয়ে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে থাকা। মাছরাঙার ঝুপ করে মাছ ধরার দৃশ্য খুব সহজেই চোখে পড়বে। বর্ষার মৌসুমে বনের গাছ মোষের মতো গলা ডুবিয়ে থাকে, আবার কোনো গাছ কোমর ডুবিয়ে অপেক্ষা করে শুকনো মৌসুমের। যতই বনের ভেতর যাওয়া যায় ততই গা ছমছমে আলো-আঁধারি পরিবেশ। ঘুরতে ঘুরতে মনে হবে এ এক আলাদা জগৎ, অন্য পৃথিবী। তবে মনে রাখতে হবে রাতারগুল হলো সাপের আখড়া। বর্ষা মৌসুমে সাপ পাতার ফাঁকে গাছের ডালে ঝুলে থাকে। ডিঙিতে ভাসার সময় অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।

বর্ষা মৌসুম বিদায় নিলেই রাতারগুলের সাজ-সজ্জা বদল হয়। চার থেকে সাত মাস জলে ডুবে থাকার পর শীত মৌসুমে বন শুকিয়ে যায়। জল টান দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জেগে ওঠে মূর্তা ও বেতের বাগান। বনের ছোট ছোট খালগুলো জল শূন্য হয়ে যায়। জলজপ্রাণী আশ্রয় নেয় বড় বড় ডোবায়। উঁচু গাছের জলে ডুবে থাকার দিন শেষ হয়। সাপ, বেজি, ব্যাঙ, পাখি নতুন করে ঠিকানা খুঁজে নেয়। রাতারগুলে বিভিন্ন প্রজাতির বক, মাছরাঙা, টিয়া, বুলবুলি, পানকৌড়ি, ঘুঘু, চিল ও বাজ পাখি দেখা যায়। শীত মৌসুমে বসে পরিযায়ী ও স্থানীয় পাখির মেলা। সাপের মধ্যে দেখা যায় অজগর গোখরাসহ বিভিন্ন প্রজাতির সাপ। গুইসাপেরও দেখা মেলে। বনে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়ায় বানর, কাঠবিড়ালি, মেছোবাঘ, বনবিড়াল, বেজি, শিয়ালসহ আরো অনেক বন্যপ্রাণী। পাখির চোখে রাতারগুল দেখতে হলে ওয়াচ টাওয়ারে উঠতে হবে। ওখান থেকে বনটিকে মনে হবে এক একটি খুঁটির উপর কাপর দিয়ে মোড়ানো সবুজ ছাতার মতো। এ অভিজ্ঞতা হবে খুবই মজার। মুগ্ধ করা জলার বনের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে অবশ্যই রাতারগুল বন বিট অফিসের অনুমতি নিতে হবে।

রাতারগুল আমাদের অমূল্য সম্পদ। বন ঘুরে ঘুরে দেখার সময় অবশ্যই জলের বোতল, পলিব্যাগ, চিপস কিংবা বিস্কুটের প্যাকেটসহ পরিবেশ দূষণকারী কোনো আবর্জনা জলে ফেলা উচিৎ নয়। বনের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ থেকে বিরত থাকতে হবে। মনে রাখতে হবেÑ আমাদের পরিবেশ ও প্রকৃতি আমাদেরই ভালো রাখতে হবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন