Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আবার ফিরে দেখা-২

সিনেমা পত্রিকার একটা কর্নার পাবলিকেশন ছিল। সেখান থেকে প্রথম বই বেরুলো কবি আহসান হাবিবের কবিতার বই। তারপর জহির রায়হানের ছোট গল্পের সংকলন। পরেরটা ছিল আমার ছোট গল্পের সংকলন ডায়মন্ড কাটা কাকন।

ছাপার কাজ যখন একেবারে শেষ, ফরমাগুলো আর আনা যাচ্ছিল না। বলাবাহুল্য টাকার জন্য ব্যাপারটা ঘটলো। যখন আনতে যাওয়া হলো বাইন্ডার জানালো পুরো ফরমা সে বিক্রি করে দিয়েছে সের দরে। এজন্য দায়ী আমাদের অর্থ সংকট।

সম্পর্কিত

যাই হোক, মনতো খারাপ হলোই, সেই সঙ্গে মনে হলো আমার বোধহয় আর বই বের হবে না।

প্রথম পুরস্কার এবং প্রথম বইয়ের এই অঘটনে বেশ ভেঙে পড়েছিলাম। তারপর হঠাৎ একদিন গুলিস্তানে সিনেমা দেখতে গিয়ে লবিতে দেখলাম অপরিচিত এক ভদ্রলোক হকের সঙ্গে কথা বলছে। শো শুরু হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি ফিরে শুনলাম সেই ভদ্রলোক একজন পাবলিশার। কথাবিতান এর মালিক। তিনি হককে একটি বইয়ের কথা বলছেন। হক তাকে বাড়িতে আসতে বলল।

কথাবিতানের মালিক মোস্তফা কামাল বাসায় এলো এবং আমাকে একটি উপন্যাস ছাপতে দিতে অনুরোধ করলো এবং আমি কিছু সময় চেয়ে নিয়ে পুরো বই আবার পড়ে নিলাম। এখানেও আবার সেই প্রহসন। এর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে হকের শিশুতোষ চলচ্চিত্র প্রেসিডেন্ট-এর কাজ শুরু হয়ে গেছে। ছবির শুটিং ডেট পড়লো ঠিক ঐ সময়। আমি শুধু বইয়ের পাÐুলিপি প্রকাশককে দিয়ে অপেক্ষা করতে বললাম। কিন্তু মনের মধ্যে একটা বাধা রয়েই গেল। কি জানি শুটিং-এর দেরির জন্য প্রকাশক বই আবার বের করে কি না। পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের থাকার কথা ছিল একমাস। কিন্তু কাজে দেখা গেল রয়ে গেলাম এক বছর। আমি ভ্রমণ করতে ভালোবাসি। করাচী, রাওয়ালপিন্ডি, ইসলামাবাদ, পেশোয়ার প্রভৃতি নামি শহরগুলোতে শুটিং করে একবছর পর ঢাকায় ফিরে এলাম।

মনে মনে খুশি ছিলাম এতগুলো নতুন শহর দেখা হলো। সেই মনই আবার খুতখুত করতে থাকলো এবং অচেনা এক ভয় থেকে মাথা চারা দিতে লাগল।

কিন্তু প্রকাশকের মাধ্যমে চিঠি আদানপ্রদান ছিল। তিনি যথাসময়ে বই প্রেসে দিলেন এবং যথাসময়ে বই বেরিয়ে গেল, বইয়ের নাম মধুমতি।

মধুমতি লেখার সময় আমি বার তিনেক গ্রামে গিয়েছি। উপকরণ ঠিকঠাক গেছে কি না। দেখার জন্য সেই সময় সরকারের সঙ্গে সুতা, তাত এবং নানাবিধ জিনিস নিয়ে তাঁতীদের সঙ্গে কলহ চলছিল। আমি যখন গ্রামে যেতাম গ্রামের লোক ঠাট্টা করতো। বলতো পুরুষরাই কিছু করতে পারে না আর উনি এলেন তার স্বরূপ সন্ধান দিতে। আমি দ্বিতীয়বার সঙ্গে ৪/৫ বছরের সাগরকে নিলাম। এতে পেছন থেকে বিদ্রƒপ করা কিছুটা থামল।

পরে অন্যান্য বইগুলো বেরুতে লাগল। সঙ্গে ছোটগল্প। একটা সময় দেখলাম পাঁচশর কাছাকাছি চলে গেছে। উপন্যাস, শিশুসাহিত্য, ভ্রমণকথার সংখ্যা অনেক।

এখানে একটি কথা বলতে হয় আমার অধিকাংশ গল্পের চরিত্রদের আমি কাছে থেকে দূরে থেকে এবং অন্যান্য সামগ্রীকভাবে সংগ্রহ করতাম।

কোনো কোনো বই যেমন অনন্ত অন্বেষা। পাত্রপাত্রীরা এয়ারলাইনের লোক। তাদের সম্পর্কে কোনোদিন লিখব ভাবতে পারিনি। শুটিং-এর জন্য হঠাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে ছেলেমেয়ে নিয়ে একা যাচ্ছিলাম। প্লেনে পরিচয় বাঙালি একজন স্টুয়ার্টের সঙ্গে। তিনি ঢাকা থেকে লাহোর যেতে যতক্ষণ সময় লাগে তার বেশকিছু সময় আমাকে দিলেন। মোটামুটি তার কাহিনীটুকু আমাকে গল্পের মতো বললেন। এইটুকু নিয়ে লাহোরে থাকাকালীন আমাদের এক অভিনেতার বাড়িতে লিখলাম একটা গল্প । পরিবারটি কাশ্মিরী পরিবার। গল্পটি বাড়ির বড় ছেলের। অতি সুদর্শন। কিন্তু শুনলাম সে জীবিত নয় মৃত। তাকে নিয়ে বাড়িতে তখনো কান্নাকাটি। এই গল্পে বাস্তবের ছেলেটিকে আমি জীবনে দেখিনি। কথা বলার সুযোগও পাইনি। কিন্তু তাকে ঘিরে বাড়িতে যে অশান্তি এবং মনে পড়া সবকিছু মিলে একটা দুঃখবোধ আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। পরবর্তী সময়ে দেখলাম আমি থেকে থেকে ঐ বাড়ির ঘটনাই ভাবছি। ঢাকায় ফিরে এসে ঢাকা এয়ারপোর্টে শুধু শুধুই যেতাম। লোকজনকে দেখতাম এবং হকের সহযোগিতায় কিছু পাইলটদের সঙ্গে আলাপ হলো। তাদের সঙ্গে এবং স্টুয়ার্টদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলে নোট নিতাম। পরবর্তী সময়ে দেখলাম এই পথেই জন্মনিল আমার অতি পাঠকপ্রিয় বই অনন্ত অন্বেষা।

এই উপন্যাস যখন একটি ঈদসংখ্যায় বের হলো সেটা নিয়ে তুমুল আলাপ আলোচনা হলো। নায়ক প্রধান বই। তবুও পাঠকরা মনে করতো নায়িকার সঙ্গে আমার মিল রয়েছে। পাঠকেরা যখন কল্পিত চরিত্রকে বাস্তবে দেখে তখন বুঝতে হয় রচনাটি সার্থক।

যেমন পরবর্তী সময়ে ৫২ গলির এক গলি, নীল নিশিথ, এরকম কয়েকটি বই ভীষণ জনপ্রিয়তা পায়।

আমি বিশ^াস করতাম কিছু লিখতে হলে তার জন্য অভিজ্ঞতা চাই। অভিজ্ঞতা শুধু নয় একটি বইয়ের জন্য বাস্তব কল্পনা, প্রচুর পড়াশোনার প্রয়োজন।

অনন্ত অন্বেষা যে পত্রিকায় বের হয়েছিল তারা ঘোষণা দিয়েছিল সেই ঈদে যতগুলো উপন্যাস বেরুবে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ একটি পুরস্কৃত হবে। অনন্ত অন্বেষা আমার জীবনে প্রথম পুরস্কার এনে দিল।

আটানব্বয়ের দশকে আমি খুব বেশি লিখি। এর প্রায় সবগুলোই কল্পিত নয়। কল্পনা এবং বাস্তবের সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে চরিত্র ও সময়।

আমার বন্ধুরা বলতো এত সময় পাই কোথায়? লিখি কেমন করে? সত্যি ঘর সংসার করে আবার লেখালেখি অতি কঠিন কাজ। বিশেষ করে মেয়েদের বেলায়। সমমানের দুজন লেখক যাদের একজন নারী অপরজন পুরুষ লেখার জন্য প্রচুর সময় চাই। কারণ লেখাতো শুধু লেখা নয়, একটা পরিপূর্ণ রূপের রূপায়ণ। আমি চিরকাল সংসারী মানুষ। সময়কে ভাগ করে নিলাম। সকাল ১১টা পর্যন্ত রান্নাবান্না করতাম। ছেলেমেয়ে দেখাশোনা করতাম। বাইরে খুব কম বের হতাম। রান্নার শেষে ১১টা থেকে তিনটা পর্যন্ত শুধুই লেখালেখি। আমার স্বামী এবং সন্তানেরা এ ব্যাপারে অত্যন্ত সহযোগিতা করতো। পরিবারের সাহস না থাকলে কোনো শিল্পীর শিল্পই পরিপূর্ণতা পেতে পারে না বলে আমার বিশ^াস। মেয়েদের লিখতে হলে অনেকগুলো ক্ষেত্র একসঙ্গে সামাল দিতে হয়। পুরুষের বেলা তেমন ঝামেলা নেই। তারা টাকা রোজগার করেই দায়িত্ব শেষ। মেয়েদের শুধু সমাজ সংসার দেখাশোনা ছাড়াও নিজেকেও দেখতে হয়।

দিনের পর দিন লিখেছি। কতরাত শুধু কাগজ কলম নিয়েই থেকেছি। কিন্তু কখনো বিরক্ত হইনি। কিন্তু পরিশ্রমের ধাক্কা খেতে হয়েছে। যখন কোনো লেখা মনের মতো হয় না তখন কি যে অপার যন্ত্রণা তা শুধুই ভুক্তভোগী মাত্রই জানে। কিন্তু মজার কথা হচ্ছে যখন মন ডুবে যায় একেবারে লেখার ভিতরে তখন ক্লান্তি বলে কিছু থাকে না। মাথা একটু ভারি হয়ে থাকে। মনে হয় মাথার মধ্যে কেউ কাজ করছে। গ্রামদেশে যাকে বলা হয় ‘ভর’। কে জানে এটা সেটা কি না।

আমি আমাদের লেখকদের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি তাদেরও এমনই হয়। এবং অনেক জায়গায় এখানে স্ত্রী-পুরুষ বলে কোনো ব্যক্তি নেই। থাকে শুধু দুটি চোখ। যে সব দেখে, বিচার করে তারপর কলম ধরে।