Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আগুন রাঙা ফাগুন দিনে -মুকিত মজুমদার বাবু

‘ফাল্গুনে বিকশিত

কাঞ্চন ফুল,

ডালে ডালে পুঞ্জিত

আম্রমুকুল।

চঞ্চল মৌমাছি

গুঞ্জরি গায়,

বেণুবনে মর্মরে

দক্ষিণবায়…’

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ণনাই বলে দেয় প্রকৃতিতে এখন বসনত্ম। শীতের ‘সোনার কাঠি, রূপার কাঠি’ দিয়ে ঘুম পাড়ানো প্রকৃতি বসনেত্মর দক্ষিণা বাতাসে ফিরে পায় প্রাণের স্পন্দন। বসনত্মকে তাই ঋতুরাজ বলেও আখ্যায়িত করা হয়। শীতের শেষ আর গ্রীষ্মের মাঝমাঝি হওয়ায় এ ঋতুতে বাতাস থাকে নির্মল ও নাতিশীতোষ্ণ। গাছে গাছে কচি পাতায় মন ভোলানো সিগ্ধ সবুজের চাদরে ঢেকে যায় বাংলার প্রকৃতি। আম গাছের মুকুলে মুকুলে মৌমাছিদের গুনগুনানি গানের অনবদ্য সুরের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ হয়ে ওঠে মন। শিমুল-পলাশের সৌন্দর্যের আগুন লাগে বসনেত্মর গায়। বসনত্মকে রূপ, রস, গন্ধ দিয়ে আরো উদ্ভাসিত করে তোলে- রক্তকাঞ্চন, অর্জুন, অপরাজিতা, কাঠচাঁপা, অশোক, অর্জুন, আকন্দ, গুলঞ্চ, তমাল, ভাঁটফুল, নিম, নাগকেশর, নীলমণিলতা, পারুল, পিয়াল, বকুল, শিরীষ, পাখিফুল, পাদাউক, কুড়চি, গামারি, মহুয়া, চাঁপাসহ হরেক প্রজাতির ফুল। কোকিল কুহু… কুহু… রবে চারপাশ উতলা করে তোলে প্রিয়াকে কাছের কাছে পেতে। পাখিদের মধ্যেও বয়ে যায় বসনেত্মর ভালোলাগার স্রোত।

প্রকৃতির রঙ বদলের সাথে সাথে বসনেত্ম মানুষেরও রঙ বদলায়। তাই ফাগুনের প্রথম দিনটিকে বরণ করে নিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানমালার। অসংখ্য মানুষ বাসনত্মী রঙে নিজেদের রাঙিয়ে নাচ, গান, কবিতার পাশাপাশি ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করে নেয় বসনত্মকে।

বসনত্ম প্রকৃতিতে যেমন আধিপত্য বিসত্মার করে তেমনি মানব প্রকৃতিতেও প্রভাব বিসত্মার করে। এ সময়ের আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ থাকার কারণে মানুষের শরীর ও মন উৎফুল্ল থাকে। আগুন রাঙা ফাগুনের মাদকতা ছড়িয়ে যায় সবখানে, সকল মানুষের মনে।

সুদূর অতীত থেকে বসনেত্মর মোহনীয় রূপ আলোড়িত করেছে কবি লেখকদের। রচিত হয়েছে হাজারো গান, কবিতা, উপন্যাস। নানা রূপ-মাধুর্যে বসনত্মকে মানুষের কাছে চিত্রিত করেছেন চিত্র শিল্পীরা। বাংলা সাহিত্যের সাথে বসনত্ম বাঁধা পড়েছে প্রাণের বাঁধনে।

“আহা আজি এ বসনেত্ম

এত ফুল ফুটে

এত বাঁশি বাজে

এত পাখি গায়…”

বসনত্মকে মনেপ্রাণে ধারণ করতে এ ঋতু উৎসব-পালা-পার্বণে থাকে জমজমাট। ফাল্গুনী পূর্ণিমা, অষ্টমী স্নান, চড়কপূজা, দোলযাত্রা, গাজন উৎসব, মাতুয়া মেলা ইত্যাদি। রাজধানীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায় বসনেত্মর প্রথম দিনটিতে আয়োজন করা হয় বসনত্ম উৎসব।

রঙে রাঙা বসনত্মই মনে করিয়ে দেয় ভাষা আন্দোলনের কথা। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলার দামাল ছেলেরা মায়ের ভাষার মান রেখেছিল। আজ তাই একুশে ফেব্রুয়ারি আনত্মর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনাও হয়েছিল এই বসনেত্ম।

ষড়ঋতুর শেষ ঋতু বসনত্ম। বার মাসের ফাল্গুন-চৈত্র। বঙ্গাব্দের বারো মাসের নামকরণ করা হয়েছে নক্ষত্রমণ্ডলে চন্দ্রের আবর্তনে বিশেষ তারার অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে। এ নামসমূহ গৃহীত হয়েছে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক প্রাচীন গ্রন্থ ‘সূর্যসিদ্ধানত্ম’ থেকে। সে অনুসারে ফাল্গুন মাসের নামকরণ করা হয়েছে পূর্বফাল্গুনী বা ফাল্গুন নক্ষত্রের নামানুসারে এবং চৈত্র মাসের নামকরণ করা হয়েছে চিত্রা নক্ষত্রের নামানুসারে।

বসনত্ম আগে যেভাবে প্রকৃতিকে সাজিয়ে তুলতো আজ তার অনেকটাই বিবর্ণ হয়ে গেছে। শুধু যে মানবসৃষ্ট কারণে এমনটি হয়েছে তা কিন্তু নয়, বিরূপ জলবায়ুও এর নেপথ্যের কারণ। তারপরও কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই-

“ফুল ফুটুক না ফুটুক

আজ বসনত্ম…

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন