শরীফের স্থাপত্যভাবনা ও কাজের জগৎ

মো: শরীফ উদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য স্থপতি। দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে স্থাপত্য অঙ্গনে দৃপ্ত পদচারনা তার। ২০০৫ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ২০০৭ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘স্থাপতিক’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বনামধন্য এই আর্কিটেক্ট বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন করেছেন। স্থাপত্যচর্চার পাশাপাশি তিনি খন্ডকালীন শিক্ষকতা করছেন আহসান উল্লাহ ইউনিভার্সিটির স্থাপত্য বিভাগে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নিয়ে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে স্বনামধন্য এই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

ইউরোপীয়ান বা আমেরিকান স্থাপত্যের অনুকরণনয়, লোকজ উপাদান, জলবায়ু ও মাটির বৈশিষ্ট্যকে প্রাধান্য দিয়ে স্থাপনা সৃষ্টিই আমার স্থাপত্য ভাবনার মূল উপজীব্য। কথা গুলো বললেন স্থপতি মো: শরীফ উদ্দিন আহমেদ। তার গ্রামের বাড়ি যশোর জেলায়। সেখানেই তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। শরীফের বাবা মো: সিরাজ উদ্দিন আহমেদ ছিলেন একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। মা মনোয়ারা বেগম গৃহিনী। তিন ভাইবোনের মধ্যে স্থপতি শরীফ সবার ছোট। স্কুলে পড়ার সময় থেকেই সংস্কৃতির বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। ছবি আঁকাআঁকি ছিল তার পছন্দের বিষয়। ফুটবল ভালো খেলতেন। সেই ছোটবেলা থেকেই কবিতা লিখতেন। কাজের ফাঁকে এখনো লিখে যাচ্ছেন কবিতা। ছোটবেলায় ফুটবলার হতে চেয়েছিলেন। মা চাইতেন তার সন্তান যেন সৃজনশীল কোনো কাজের সাথে জড়িত থাকে। মায়ের অনুপ্রেরণায় ক্রিয়েটিভ কোনো কিছু করার উদ্দেশ্যে আর্কিটেক্ট হওয়া তার। যশোর জেলা স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৯৩ সালে। ১৯৯৫ সালে এমএম যশোর কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে। ২০০৫ সালে তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করার পর শরীফ উদ্দিন আহমেদ যোগ দেন খ্যাতিমান স্থপতি

স্থপতি মো: শরীফ উদ্দিন আহমেদ

এনামুল করিম নির্ঝর এর সিস্টেম আর্কিটেক্টস-এ। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর প্রতিষ্ঠা করেন নিজের স্থাপতিক ফার্ম। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে তিনি দেশের নামকরা ফ্যাক্টরি বিল্ডিং, মসজিদ, স্কুল, রেস্ট হাউজ, অফিস বিল্ডিং, অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে গাজীপুর কাশিমপুরে অ্যাপটেক ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক, মানিকগঞ্জের শিব বাড়িতে শাহ মুহাম্মদ মহসীন খান দরগাহ, বেইলী রোডের সার্কিট হাউজে দ্যা কারনেশন, কুস্টিয়ার ত্রিমোহনীতে কিরন রেস্ট হাউস, উত্তরায় লিটল ওয়ান্ডার স্কুল, নারায়গঞ্জে বাংলাদেশ হোন্ডা প্রাইভেট লিমিটেডের ফ্যাক্টরী বিল্ডিং, সাইক্লোন সেন্টার, বসুন্ধরার আবাসিক এলাকার জি ব্লকে সাউথ ভেলী অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, গুলশান ৫৩ নম্বর রোডে ট্রান্সকম লিমিটেডের হেড অফিস, বাড্ডায় ওরেক্স বাংলাদেশ, গুলশানে জুবিল্যান্ট ফুড ওয়ার্কস হেড অফিস, গ্রীন ডেল্টা ড্রাগন হেড অফিস, মিরপুর-১২ তে বিওপির দ্বিতীয় ক্যাম্পাস ও এফএসটি বিল্ডিং, বিজয়নগরের অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সসহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন।
এছাড়াও বেশ কয়েকটি নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন তিনি। দেশী ম্যাটেরিয়ালস, এ দেশের জলবায়ু, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য নিয়েই কাজ করতে ভালোবাসেন শরীফ উদ্দিন আহমেদ। এ জন্য কাজের কোয়ালিটির ব্যাপারে তিনি কোনোরূপ আপস করতে চান না। সব সময় ভালো মানের কাজকেই শরীফ উদ্দিন প্রাধান্য দিয়ে এগিয়ে চলেছেন।
এই স্বনামধন্য স্থপতির সব কিছু জুড়ে আছে নিজ দেশের প্রতিমমত্ববোধ আর ভালোবাসা। দেশীয় ম্যাটেরিয়ালস তার স্থাপত্য কর্মে নিয়ে এসেছেন ভিন্ন রকম একটা আমেজ। স্থাপনার কাজে শরীফ উদ্দিন আহমেদের রয়েছে অসম্ভব সাফল্য। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক কাজে অংশ নিয়ে তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন।
যার ফলশ্রুতিতে তার সাফল্যের ঝুঁড়িতে জমা হয়েছে সেরাকর্মের স্বীকৃতি। উল্লেখযোগ্য অ্যাওয়ার্ড গুলোর মধ্যে রয়েছে আইএবি’র সহযোগিতায় বার্জার আয়োজিত বার্জার এক্সিলেন্স কমেন্ডেশন অ্যাওয়ার্ড, পঞ্চম সাইকেল ডিজাইন প্রতিযোগিতায় স্কুল সাইক্লোন শেল্টার ডিজাইনের জন্য ওয়ার্ল্ড আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ড, আইএবি এর সহযোগিতায় উম্মুক্ত স্থাপত্য নকশা প্রতিযোগিতায় শাহবাগ অগ্রণী ব্যাংক ভবনের জন্য দ্বিতীয় পুরস্কার, মেটার বেটার আয়োজিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় গঐ-১৭ মেমোরিয়াল পার্কের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকা ভূক্ত, ২০২৩ সালের জন্য মর্যাদাপূর্ণ এরিখ মেন্ডেলসন অ্যাওয়ার্ড প্রতিযোগিতায় ব্রিক আর্কিটেকচার ক্যাটাগরিতে শাহ মুহাম্মদ মহসিন খান সমাধি প্রকল্পের জন্য মনোনীত, ভিয়েনা ২অ আর্ট এন্ড আর্কিটেকচার ম্যাগাজিন আয়োজিত ২অ এশিয়া আর্কিটেকচার অ্যাওয়ার্ডের জন্য সংক্ষিপ্ত তালিকা ভূক্ত।
২০০৫ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম নুসরাত শারমীন নিতু। তিনিও একজন আর্কিটেক্ট। এই দম্পতির দুই সন্তানের জনক-জননী। স্থপতি মো: শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমি মূলত কনটেকচুয়াল কাজ করে থাকি। আমি রিজিয়নালিজমে বিশ্বাসী। আমার স্থাপত্যকর্মের মধ্যে স্থানিকতার প্রকাশ সব সময়ই বিশেষিত হয়েছে। আমি বেঙ্গল আর্কিটেকচার বা বাংলার স্থাপত্য থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে সেটাকে সময় উপযোগী এবং ব্যবহার উপযোগী করে উপস্থাপন করতে চাই। আমার কাজে অতীত হলো শিক্ষা, বর্তমান হলো কর্মক্ষেত্র এবং ভবিষ্যৎ হলো সম্ভাবনা। আমাদের কিন্তু কোনো স্থায়ী ম্যাটেরিয়াল নেই। যা আছে তা হলো পরিবর্তনশীল পলিমাটি। তাই এই মাটি দিয়ে হাতে বানানো ইট হচ্ছে আমার স্থাপত্যের একটি অপরিহার্য ম্যাটেরিয়াল। আমাদের একটি প্রজেক্ট আছে দ্যা কারনেশন নামে সেখানে গ্রামের উঠানকে কীভাবে শহরের বাসা বাড়িতে ইন করপোরেট করা যায় সেই ধারনার ওপর ভিত্তি করে প্রজেক্টের নাম হচ্ছে ‘দ্যা কারনেশন’।
শহরের বাড়ি হবে তবে সেখানে আমাদের শত বছরের যে আচার আচরণ রয়েছে সে রীতিনীতি তা ভুলে গিয়ে নয়, সেগুলোকে রেখে করতে হবে।
তরুণ স্থপতিরা যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চায়, তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ? এ প্রসঙ্গে মো: শরীফ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের আর্কিটেকচার স্কুল গুলোতে আমরা বেশির ভাগ সময়ে ইউরোপীয়ান এবং আমেরিকান স্থাপত্যের উদাহরণ গুলো দেখি এবং তাদের কনটেস্টের স্থাপত্য গুলোকে নিয়ে রীতিমত অবসেস থাকি। কিন্তু আমাদের যে রত্নগুলো সুলতানী পিরিয়ড এবং ভারনাকুলার স্থাপত্যে রয়েছে তা আমরা অবহেলা করি। স্থাপত্য হিসেবে চিহ্নিত করি না।
ঢাকা শহরের যে আধুনিকতা স্থাপত্য বেড়ে উঠছে তা ইউরোপীয়ান এবং আমেরিকান স্থাপত্যের অনুকরণ যা সার্বিকভাবে আমাদের জন্য, আমাদের অস্থ্যিতর অনুকূলে নয়। এখন আমরা ইউরোপীয়ান মর্ডান আর্কিটেকচারকে আমাদের স্থাপত্যের সাথে ফিউজ করে একটা ভাষা তৈরি করছি সেখানে ইউরোপীয়ান, আমেরিকান স্থাপত্য আধিক্য লক্ষনীয়। কিন্তু আমাদের উচিত ইউরোপীয়ান বা আমেরিকানদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের বেঙ্গল স্থাপত্যের ভাষাকে উজ্জীবিত করে আনা এবং আমাদের নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরা।
প্রথমে নিজেকে চিনতে হবে, জানতে হবে। তারপর বিদেশী শিক্ষা গ্রহণ করে নিজেদের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে অনবদ্য নিজস্ব স্থাপত্য তৈরি করতে হবে।

  • শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি