স্থপতি এবং স্থাপত্য গড়ার কারিগর সাজ্জাদুর রশীদ

সাজ্জাদুর রশীদ। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য স্থপতি। দীর্ঘ তিন দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের স্থাপত্যাঙ্গনে দৃপ্ত পদচারণা তার। তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে পড়াশোনা করেছেন। তার রয়েছে ‘ত্রিমাত্রা আর্কিটেক্টস’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। তিনি স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এর স্থাপত্য বিভাগের প্রধান ছিলেন। বর্তমানে স্বনামধন্য এই স্থপতি প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। একজন অভিজ্ঞ শিক্ষক হিসেবে শিক্ষার্থীদের তিনি স্থাপত্যের নানা বিষয়ে হাতে কলমে শিক্ষা দিচ্ছেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি স্থাপত্যচর্চাও চলছে। ইন্টোরিয়র ডিজাইনও করেছেন। তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে সাভার ইপিজেড এ স্টাইরেক্স ফ্যাশন, গাজীপুর কুনাবাড়িতে এলজেড টেক্সটাইল ফ্যাক্টরি বিল্ডিং, সাভারে দ্য অ্যাকসেসরিস ফ্যাক্টরি বিল্ডিং, গুলশানের শিশু পার্ক, নোয়াখালীর ফেনীতে শপিং সেন্টার মহিপাল প্লাজা, লালবাগে মেটাওর হাউজ, মোহাম্মদপুরে মোহাম্মাদীয়া হাউজিং লিমিটেড এ সুলতানাস ড্রীম অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং, ইন্দিরা রোডে ত্রয়ী নীড় ইত্যাদি। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি’তে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

স্থাপত্য শিক্ষা ও পেশা নিয়ে স্থপতি সাজ্জাদুর রশীদ বলেন, স্থাপত্যকে বলা হয় ‘mothar of all arts’ স্থাপত্য একটি সৃজনশীল বিষয়। এ বিষয়ে যারা অধ্যয়ন করে পেশা চর্চা করেন তাদেরকে বলা হয় স্থপতি। স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশুনা করতে হলে তাকে সৃষ্টিশীল হতে হবে আর এই সৃষ্টিশীল কাজে তাকে অবশ্যই ছবি আঁকা জানতে হবে, কারিগরী জ্ঞান থাকতে হবে, আলোকচিত্র, সাংস্কৃতিক কাজে সম্পৃক্ত থাকতে হবে। সর্বোপরি সংস্কৃতিমনা হতে হবে।
স্থপতিদের মূল কাজ স্থাপনা নিয়ে। কোন স্থাপনার বিন্যাস, পারিপার্শিকতা জলবায়ু, আবহাওয়া, আলো বাতাসের প্রবাহমানতা ব্যবহার উপযোগিতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিতে হয় এবং সেগুলো বিবেচনা নিয়ে ডিজাইন উপস্থাপনা করতে হয়। এই উপস্থাপনায় তাকে তার সৃষ্টিশীলতা, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে হয়। তাই স্থপাত্য বিষয়ে অধ্যয়ন করতে হলে তাকে যেমন সৃজনশীল হতে হবে তেমনি কারিগরী বিষয়ে জ্ঞান থাকতে হবে। স্থপাত্য বিষয়ে অধ্যয়ন একটি বিরামহীন প্রক্রিয়া। শিক্ষার্থীকে আজীবন শিখতে হবে। ছাত্রজীবনে তাকে ক্লাসের শিক্ষার বাইরেও জীবন ও প্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করতে হবে। শিক্ষাজীবন শেষে তাকে তার সিনিয়র স্থপতিদের কাছ থেকে পেশাগত শিক্ষা নিতে হবে।

স্থপতি সাজ্জাদুর রশীদ

পেশায় যুক্ত হবার পর তাকে ক্লায়েন্টেসদের সাথে কথা বলতে হয়, তাদের চাওয়া পাওয়া বুঝতে হয় এবং সে মোতাবেক স্থাপত্যিক সেবা দান করতে হয়। একই সাথে তাকে ভবনের কারিগরী বিষয়েও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তার ডিজাইন প্রক্রিয়া সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করতে হয়, আর এজন্য দরকার কারিগরী বিষয়ে সম্যক জ্ঞান।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় স্থপতিদের কাজ সম্বন্ধে অনেকেরই ধারনা নেই। অনেকেই মনে করেন স্থপতিরা ভবনের সৌন্দর্যবর্ধনে কাজ করে থাকেন। অনেকের ধারণা প্রকৌশলীরা ভবনের নকশা করে থাকেন। মূলত এই ভূল ধারণার কারনেই আমাদের দেশের বেশীর ভাগ স্থাপনাই অপরিকল্পিত ও কদর্য হয়ে থাকে।
স্থপতিরাই ভবনের নকশা প্রণয়ন ও এর বাহ্যিক অবয়বের সৌন্দর্যের জন্য কাজ করে থাকেন। সেটা আমরা লক্ষ্য করবো পরিকল্পিত আবাসন এলাকা ও অপরিকল্পিত আবাসন এলাকায়। বৃহৎ স্থাপনাগুলো মূলত স্থপতিদের পরিকল্পনাতেই গড়ে ওঠে। এটা সরকারী ভাবে স্বীকৃত। তবে এর ব্যতিক্রমও আমরা কখনো কখনো দেখতে পাই। একজন স্থপতিকে সবধরনের স্থাপত্য নকশা প্রণয়নে দক্ষতা অর্জন করতে হয়। মানুষের বসবাসের জন্য আবাসন থেকে শুরু করে বানিজ্যিক ভবন, শপিং সেন্টার, হাসপাতাল, খেলাধুলার জায়গা, উম্মুক্ত পরিসর থেকে নগরায়ন। তাই তাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় সব ধরনের শিক্ষাই প্রয়োজন। স্থাপত্য শিক্ষা হচ্ছে কলা ও কারিগরী শিক্ষার সংমিশ্রণ। এখানে যেমন একজন মানুষের জীবন জীবিকা, তার ভালোলাগা, তার অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ থাকবে তেমনি কারিগরী দিক থেকেও এটি হবে অনেক বেশী সৃদৃঢ় ও ব্যবহার উপযোগী।
বাংলাদেশে স্থাপত্য পেশায় যারা আসছেন তারা মূলত কয়েকটা সেক্টরে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। স্থপতিরা পাশ করার পর অনেকেই উম্মুক্ত পেশায় যুক্ত হয়ে পড়েন। অনেকেই নিজ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। অনেকেই স্বনামধন্য স্থাপত্য ও কারিগরী-উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠানে চাকরি গ্রহণ করেন। আজকাল কিছু কিছু স্থপতি আবাসন উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান ও ইন্টেরিয়র ডিজাইন প্রতিষ্ঠানেও কর্মরত আছেন। এছাড়াও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাকতায়ও অনেক নিযুক্ত হন। সরকারি পর্যায়ে স্থাপত্য অধিদপ্তর, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্থপতিরা কর্মরত আছেন। দেশের প্রধান কয়েকটি সিটি কর্পোরেশনেও স্থপতিরা কর্মরত আছেন। স্থাপত্য পেশা ছাড়াও আজকাল স্থপতিরা ইন্টেরিয়র ডিজাইন, গ্রাফিক ডিজাইনার ফটোগ্রাফার, চলচ্চিত্র পরিচালক, রিয়েল এস্টেট ও ফার্নিচার ডিজাইন ও ব্যবসায় জড়িত আছেন।
তবে সরকারী পর্যায়ে স্থপতিদের আরো বেশি নিয়োগ ক্ষেত্র সৃষ্টি করাটা জরুরি। প্রতিটি জেলায়, প্রতিটি পৌরসভায় স্থপতিদের কর্মসংস্থান আজ সময়ের দাবী। সরকারী ভাবে এ সিদ্ধান্ত নিলে স্থপতি কর্মসংস্থানের একটি দ্বার উম্মুক্ত হবে।
বাংলাদেশে স্থাপত্য পেশাচর্চায় স্থপতিদের নিবন্ধন, স্থাপত্য প্রতিযোগিতা, স্থপতিদের মান উন্নয়নে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট মূল ভূমিকা পালন করে থাকে। স্থাপত্য শিক্ষা নিয়ন্ত্রণেও স্থপতি ইনস্টিটিউট বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে এক্রেডিটেশন আরোপ করে থাকে। বাংলাদেশে সরকারী-বেসরকারী পর্যায়ে ২৯টি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য শিক্ষা প্রদান করা হয়। তার মধ্যে ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগ স্থপতি ইনস্টিটিউটের এক্রেডিটেড।
বাংলাদেশের যে সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে স্থাপত্য শিক্ষা দেয়া হয়। তার নাম যথাক্রমেÑ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যাালয়, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিদ্যালয়, গাজীপুরে ঢাকা প্রকৌশল ও পযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সামরিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, বেসরকারী: আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়, আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ, সাউথ ইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট ইউনিভার্সিটি, প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়, ফারইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়, শান্ত মারিয়াম ইউনিভািির্সটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজি, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি, চট্টগ্রামে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটে লিডিং ইউনিভার্সিটি, খুলনায় নর্দান ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এন্ড টেকনোলজি।

  • শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি