যেমন তিনি ছবি আঁকেন রং তুলি দিয়ে তেমনি তিনি ছবি আঁকেন কণ্ঠস্বরের যাদুতেও। সৃষ্টি করেন আকাশ চুম্বী কিছু চোঁখ ধাধানো ইমারত। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী মুস্তাফা খালীদ পলাশ। খ্যাতিমান এই স্থপতিকে সবাই চিনেন এক নামে দেশে-বিদেশে। স্থাপত্য বিদ্যা নিয়ে সব সময় সৃিষ্টশীল চিন্তা করেন তিনি। ভালো কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ এ পর্যন্ত অনেক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। পেশার বাইরে তার আছে একটা বিশাল নেশার ভুবন। ছবি আঁকা, গান গাওয়া, আর লেখালেখি করা। সেতার, এসরাজ, পিয়ানো সহ আরো অনেক বাদ্য যন্ত্র বাজাতে পারেন এই গুণী মানুষটি। ছায়ানট থেকে সেতারের ওপর পাঁচ বছরের কোর্স সম্পন্ন করেন। তার গাওয়া রবীন্দ্রসঙ্গীতের বেশ কয়েকটি অ্যালবাম দেশে-বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। ইতোমধ্যে তার চারটি একক প্রদর্শনী সুধী সমাজে বিশেষ ভাবে প্রশংসিত হয়েছে। সময় পেলেই রং তুলি দিয়ে রাঙিয়ে তুলেন ক্যানভাস। সম্প্রতি মানাস এর শাড়িতেও ফুটে ওঠেছে তার আঁকা চিত্র কর্ম। বর্তমানে তিনি আই এ বি এর সহ সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এবারের শাহ সিমেন্ট ‘নির্মাণে আমি’তে এই গুণী স্থপতি, চিত্রশিল্পী ও সঙ্গীত শিল্পীকে নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
আপনার ছবি আঁকার শুরুটা বা চিত্র শিল্পী হয়ে ওঠার গল্পটা বলুন? এ প্রশ্নের উত্তরে পলাশ বলেন, জন্ম সূত্রেই আমি চিত্রশিল্পী। আমার চারুকলাতেই অধ্যায়ন করার ইচ্ছা ছিল। আমার বাবা-মা দুজনই চারুকলা থেকে পাশ করা চিত্রশিল্পী ছিলেন। একেবারে ছোটবেলা থেকেই আমার ছবি আঁকার প্রচন্ড ঝোঁক ছিল। ছবি আঁকা ছিল আমার নিত্য দিনের কাজ। পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিদিনই ছবি আঁকতে হতো। আশির দশকের শুরুর দিকের কথা বলছি, সেই সময় চারুশিল্পীদের অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল নাকাজেই তারা স্বচ্ছল হবে কী করে? নিজে সেটা বাসায় এসে দেখতাম। চিত্রশিল্পী বাবা-মার বেশ কষ্ট হতো সংসার চালাতে। ছবি আঁকার সাথে সাথে স্থাপত্যের বিষয়ে আমার আগ্রহ ছিল। বাবা-মার ইচ্ছে অনুযায়ী বলব আমাকে বুয়েটে পরীক্ষা দিতে হলো। স্থাপত্য বিভাগে ভর্তির সুযোগও পেয়ে গেলাম। একাডেমিক ভাবে চারুশিল্পী হয়েও ওঠা হলো না আমার।
ছেলে বেলা থেকেই পলাশের জীবন ছিল একজন পরিনত মানুষের মতোই কর্মময়। স্কুলে থাকা অবস্থায় স্কাউটিং আর ছাত্র ইউনিয়ন করতেন তিনি। স্কাউটিং করতে গিয়ে গান শেখা তার। প্রথমে তার গান শেখা শুরু হয় গানের শিক্ষক খায়রুল হাসান খানের কাছ থেকে। তারপর বিশিষ্ট সুরকার মঈনুল ইসলাম খানের কাছে সঙ্গীতের ওপর তালিম নেন। এ ছাড়াও তিনি গান শিখেছেন খোদা বক্স সানুর কাছ থেকে। ওস্তাদ খুরশীদ খানের হাত ধরে সেতারের সঙ্গে পরিচয়। সেখান থেকেই সেতার বাজানোর পথ চলা শুরু তার।
সেতারের সঙ্গে আপনার সখ্যতা শুরু হলো কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তরে পলাশ বলেন, আমরা তিন ভাই বোন ছিলাম। বড় বোন মারা গেছেন ১৯৮৯ সালে। আমার ছোট ভাই আবৃত্তিকার শিমুল মুস্তাফা। আমার বাবা খুবই শিল্পমনা ছিলেন। উনি ভালো বাঁশি বাজাতেন। তাঁর খুব ইচ্ছা ছিল ছেলে-মেয়েরা গান বাজনা করুক। সেই গান বাজনার মধ্যে আমি পড়ে গেলাম বাজনার দলে। যেহেতু আমার গলা ফেসফেসে, কণ্ঠস্বর ভালো ছিল না। আমাকে দিয়ে গান হবে না। আমাকে প্রথমে ধরিয়ে দেওয়া হলো সেতার। তার আগে আমি ইজ্জত আলী দেওয়ান নামের একজন ওস্তাদের কাছে। তবলা বাজানোর তালিম নেই। তারপরে আমি সেতারে তালিম নেই দীর্ঘ দিন। ছায়ানট থেকে সেতার বাজানোর ওপর পাঁচ বছরের কোর্স সম্পন্ন করি। সেতারে আমার প্রথম ওস্তাদ ছিলেন খুরশীদ খান। উনার কাছে আমি বাসাও সেতার শিখতাম, আবার ছায়ানটেও শিখতাম। তারপর স্থাপত্যে ভর্তি হওয়ার পরে ১৮/১৯ বছর বয়স তখন আমি প্রখ্যাত ওস্তাদ আবিদ হোসেন খানের কাছে যন্ত্র সঙ্গীতে তালিম নিয়েছি বহুদিন। তারপর উনার ছেলে আমার গুরু ভাই প্রয়াত ওস্তাদ শাহাদাত হোসেন খান শাহীন, উনার কাছেও তালিম নিয়েছি। গত ১০/১২ বছর ধরে তিনি আবার এসরাজ বাজাচ্ছেন। পিয়ানো বাজাচ্ছেন। মোটামুটি ৮/১০টি বাদ্য যন্ত্র বাজাতে পারেন এই গুণী মানুষটি।
১৯৮১ সালে তিনি ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় পরিচিত হন সহকর্মী সহধর্মনী ও বন্ধু শাহজিয়া ইসলাম অন্তনের সাথে। ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৮৯ সালে তার একমাত্র বড় বোনকে হারাতে হয়। একই বছরে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন শাহজিয়া ইসলাম অন্তনের সাথে। স্থপতি মুস্তাফা খালীদ পলাশ এই পুরোটা সময় পাশে পেয়েছেন তার স্ত্রীকে। তারা তাদের কর্মজীবন ও সংসারের জীবনের দায়িত্ব গুলো সুন্দর ভাবে ভাগাভাগি করেন। ১৯৯৮ সালে পলাশ সহধর্মনী শাহজিয়া ইসলাম অন্তনকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ভিস্তারা আর্কিটেক্টস নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
ক্লায়েন্ট, সহকর্মী সবাইকে যেন একটি বড় পরিবারের মতো করে বেঁধে রেখেছেন স্থপতি পলাশ। কাজের গভিরতা, চিন্তা, ব্যাপকতা এবং সর্বপরী মানুষের সম্পর্কের আন্তরিকতা তাকে তার স্থাপত্যকে গ্রহণযোগ্য করে তোলে সবার কাছে। ভিস্তারা পরিবারকে নিয়ে একে একে তৈরি করে চলেছেন বাংলাদেশের আধুনিকতম সব স্থাপত্য। ধীরে ধীরে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠে তার পরিবার। এক অন্যান্য পরিবারের নাম ভিস্তারা আর্কিটেক্টস পাইভেট লিমিটেড। এই উচ্চতায় উঠতে তাকে অমানবিক শ্রম আর সাধনার পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। প্রবল ইচ্ছে শক্তি ও সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তাকে এই অবস্থানে নিয়ে এসেছে। কাজের জন্য জীবন নয়। জীবনের জন্য কাজ। সময় পেলেই রঙ তুলি দিয়ে রাঙিয়ে তুলেন ক্যানভাস। সম্প্রতি মানাস এর শাড়িতেও তার আঁকা চিত্রকর্ম ফুটে ওঠেছে।
তার চিত্র কলার প্রেরণা বাংলাদেশের নদী, নিসর্গ ও নগর। স্থপতি পলাশ শুধু চিত্রকলায় তার শৌখিন একগ্রতা সীমিত রাখেননি, সঙ্গীতের জগতেও তার উৎসাহ অপরিসীম। তিনি তার সহধর্মনী শাহজিয়া ইসলাম অন্তন ও দুই সহকর্মীকে নিয়ে রবীন্দ্র সঙ্গীতের বেশ কয়েকটি সিডি প্রকাশ করেছেন। যে গুলোতে তাদের প্রতিভার প্রমাণ পাওয়া যায়।
পলাশের ভারি গলার রবীন্দ্র সঙ্গীত অবশ্যই শ্রোতাদের ভীষন ভাবে আবেগ্লুত করে। তারা মনে করেন রবীন্দ্রনাথ আছেন তাদের সবটা জুড়ে। তাদের দিন শুরু হয় রবি ঠাকুরের গানের সাথে, দিনে শেষেও যেন তিনিই মিশে থাকেন। রবীন্দ্রনাথকে শুধু মননেই নয়, জীবনে ধারণ করেন তারা। মুস্তাফা খালিদ পলাশ শুধু যে ব্যক্তিগত ভাবে প্রতিভাবান তাই নয়, অন্যদেরকেও সুযোগ করে দিতে প্রচন্ড আন্তরিকতা ও উদ্যোগ তার। তার ও স্ত্রী শাহজিয়া ইসলাম অন্তনের পরিচালনায় তাদের ডেলভিস্তা ফাউন্ডেশন এ কাজটি করছেন। নানা জনের সৃজনশীল ও পরসেবী কর্মকান্ডে এই ফাউন্ডেশন সাহায্য সহযোগিতা করছে।