শাকুর মজিদ। বর্ণিল পরিচয়ে একজন মেধাবী মানুষ। লেখালেখি, সাংবাদিকতা, ডকুমেন্টারি নির্মাতা, স্ক্রিপ্ট রাইটার, শিক্ষক, ব্যবসায়ী সব পরিচয় ছাপিয়ে শাকুর মজিদ একজন খ্যাতিমান স্থপতি। পড়াশুনো করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য অনুষদে। ১৯৯৩ সালে বুয়েট থেকে পাস করার পর বন্ধু সহপাঠী গুণী অভিনেতা তৌকীর আহমেদকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘ট্রায়াঙ্গাল’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ মেধাবী মানুষটি কাজ করছেন নানা মাধ্যমে। গল্প, নাটক, ভ্রমণ কাহিনি লিখেছেন অনেক। নাটকের সকল শাখায় তার বিচরণ। বেতার, টেলিভিশন ও মঞ্চের জন্য তার লেখা নাটকের সংখ্যা ১৬টি। দেশ ভ্রমণ তার একটি বড় নেশা। ত্রিশাধিক দেশ ভ্রমণ করেছেন। এযাবৎ তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৩৬টি। লেখালেখির জন্য এবার তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। শাহ্ সিমেন্ট সুইট হোমে স্থপতি শাকুর মজিদকে নিয়েই এবারের প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক।
আমি চেষ্টা করি আমাদের পরিবেশের সাথে এবং জলবায়ুর সাথে মিল রেখে স্থাপনাগুলো বানানোর। যত কম মেকানিক্যাল সাপোর্ট দেয়া যায় সেই চেষ্টাও থাকে। মেকানিক্যালি ইনভারমেন্ট তৈরি না করে প্রাকৃতিক ভাবে আলো-বাতাস যেভাবে জায়গার ভেতরে ঢুকে তা আনার চেষ্টা করি। আমি বেশির ক্ষেত্রে খোলা ইটের ব্যবহার করে থাকি। প্লাস্টারটা পরিহার করতে চাই। আরেকটা জিনিস হচ্ছে পরিবেশবান্ধব স্থাপনা যাতে নির্মাণ করতে পারি সেই চেষ্টাটা থাকে সব সময়। আবার সব ক্ষেত্রে সেটা করতে পারি না। কারণ হচ্ছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ক্লায়েন্টদের দ্বারা আমাদের আর্কিটেক্টরা নিয়ন্ত্রিত হন। ক্লায়েন্টরা যে রকম বলে সেই রকম করেই দিতে হয় অনেক ক্ষেত্রে। এটার ক্ষেত্রে এ জিনিস গুলো সব সময় করা যায় না। আমি চেষ্টা করি যাতে বিল্ডিংটা দেখে মনে হয় যেন এটা বাংলাদেশের জলবায়ু উপযোগী বিল্ডিং।
কথাগুলো বললেন, খ্যাতিমান স্থপতি শাকুর মজিদ। ব্যক্তি জীবনে একজন পেশাদার স্থপতি হয়েও শিল্প, সাহিত্য ও চলচ্চিত্রসহ নান্দনিক সৃজনের বহুমাত্রিক শাখায় তিনি বিচরণ করেছেন সহজাত প্রতিভায়। শাকুর মজিদের জন্ম সিলেটের বিয়ানী বাজারের মাথিউরা গ্রামে। তার বাবার নাম মরহুম আব্দুল মজিদ। তিনি একজন নাবিক ছিলেন। মা ফরিদা খাতুন গৃহিণী। পাঁচ ভাই- বোনের মধ্যে শাকুর মজিদ সবার বড়। ১৯৮২ সালে ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজ থেকে তিনি এসএসসিতে বিজ্ঞান বিভাগে ১৯তম স্থান দখল করে একই কলেজে এইচএসসিতে ভর্তি হন। ১৯৮৪ সালে কৃতিত্বের সাথে পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগে। বুয়েটে পড়ার সময় নিজ খরচ চালানোর জন্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, সাংবাদিকতা এবং ফটোগ্রাফি চর্চা শুরু করেন। তৃতীয় বর্ষের ছাত্র থাকাকালে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন আলোকচিত্র প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে ৫টি পুরস্কার অর্জন করেন।
২০০৬ সালে বিৃটিশ বাংলা যৌথ উদ্যোগে ডেভেলপার কোম্পানি ব্রিটানিয়া প্রপার্টিজ লিমিটেড নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। শাকুর মজিদ এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। শাকুর মজিদ যতটা না আর্কিটেক্ট হিসেবে পরিচিত তার চাইতে বেশি পরিচিতি পান নির্মাতা ও পরিচালক হিসেবে। একসময় তিনি সিলেটের আঞ্চলিক সংস্কৃতিকে টেলিভিশন পর্দায় নিপুণ ভাবে তুলে ধরেন। আর এ কাজের ফল হিসেবে শ্রেষ্ঠ নাট্যকার ও পরিচালক হিসেবে দেশি-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থার কুড়িটিরও বেশি পুরস্কার তার ভাগ্যে জুটেছে। ২০০১ সালে আমেরিকা ভ্রমণের সময় সিলেটের মানুষজনের আমেরিকা অভিবাসনের ইতিহাস নিয়ে প্রথম তথ্যচিত্র একজন মোহাম্মদ আলীর আমেরিকা জয় নির্মাণ করেন। এরপর শান্তি নিকেতনের ওপর তার নির্মিত আরেকটি তথ্যচিত্র দর্শকের মন ব্যাপক ভাবে নাড়া দেয়। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি একের পর এক নির্মাণ করেছেন ভ্রমণচিত্র। বাউল স¤্রাট শাহ্ আব্দুল করিমের ওপর নির্মাণ করেন ভাটির পুরুষ নামের একটি তথ্যচিত্র। বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য প্রামাণ্য ও ভ্রমণ চিত্র বানিয়েছেন তিন শতাধিক পর্বের মতো। অক্লান্ত, পরিশ্রমী, উদ্যমী, ভ্রমণ পিপাসু আর সৃষ্টিশীল মানুষ শাকুর মজিদ একজন সুলেখকও। এবার বইমেলায় তার সাতটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এ যাবৎ তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৩৬টি। প্রকাশিত ভ্রমণ গ্রন্থ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে ৪ খÐের ভ্রমণ সমগ্র, ৮টি নাটক নিয়ে নির্বাচিত নাটক। এ ছাড়াও প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশের প্রথম মঞ্চ নাটকের আলোকচিত্র গ্রন্থ ‘রিদম অন দ্য স্টেজ’, স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ ইসলামের স্থাপত্য ধারা।