ভলিউম জিরো নিয়ে ফয়েজের স্বপ্ন

মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য স্থপতি। বর্তমানে তিনি ‘ভলিউম জিরো’ নামের একটি স্থাপত্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্য বিষয়ে ¯œাতক ডিগ্রি লাভের পর যোগ দেন স্থাপত্য বিভাগে প্রভাষক হিসেবে। ১৯৯৭ সালে বুয়েট থেকে মাস্টার্স কমপ্লিট করেন এবং স্বীকৃতি স্বরূপ গোল্ড মেডেল এ ভূষিত হন। ১৯৯৮ সালে দুইজন সিনিয়র স্থপতিকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ভিস্তারা আর্কিটেক্টস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এযাবৎ তিনি অসংখ্য দর্শনীয় হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের ডিজাইন করেছেন। এবার শাহ সিমেন্ট সুইট হোমে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

স্থপতি মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার শাহপুরে। কিন্তু তার জন্ম বেড়ে ওঠা ঢাকায়। ফয়েজ উল্লাহর বাবার নাম এ কে এম ওয়ালি উল্লাহ। তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। মা সুলতানা বেগম গৃহিণী। চার ভাই এক বোনের মধ্যে ফয়েজ উল্লাহ তৃতীয়। স্কুলে পড়াকালীন সময় থেকে সাংস্কৃতিক কর্মকাÐের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ছবি আঁকাআঁকিতে পারদর্শী ছিলেন। ভালো আবৃত্তি করতে পারতেন। আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। বুয়েটে পড়াকালে জাতীয় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় তার দল সোহরাওয়ার্দী হল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৮৩ সালে। ১৯৮৫ সালে একই কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বুয়েটের স্থাপত্য অনুষদে। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্য বিষয়ে ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে নিজে কিছু করবেন এ প্রত্যয় নিয়ে শুরু করেন স্থাপত্য চর্চা। পরবর্তীতে ফয়েজ উল্লাহ যোগ দেন বুয়েটের আর্কিটেকচার বিভাগে প্রভাষক হিসেবে। ১৯৯৭ সালে তিনি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন এবং স্বীকৃতি স্বরূপ গোল্ড মেডেল এ ভ‚ষিত হন। একই বছর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত একটানা শিক্ষকতা শেষে বুয়েট ছেড়ে আবার শুরু করেন স্থাপত্য চর্চা। প্রতিষ্ঠা করেন ভিস্তারা আর্কিটেক্টস এর। স্বনামধন্য স্থপতি মুস্তাফা খালীদ পলাশ ও শাহজিয়া ইসলাম অন্তনকে সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন ‘ভিস্তারা আর্কিটেক্টস লিমিটেড’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ভিস্তারা আর্কিটেক্টস লিমিটেড এ থাকাকালীন তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিংমল। বাংলাদেশে স্থাপত্য শিল্পে বসুন্ধরা সিটি একটি অন্যতম মাইল ফলক হিসেবে বিবেচিত। একই ভাবে পান্থপথে ইউনিক ট্রেড সেন্টার, বসুন্ধরায় গ্রামীণফোন কর্পোরেট হেড অফিস, মতিঝিল দিলকুশায় পিপলস ইন্সুরেন্স ভবন, গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেল, বাংলালিংক ভবন, ল্যাবএইড হাসপাতাল, নাফি টাওয়ার, সিয়াম টাওয়ার ইত্যাদি। ২০০৮ সালে ফয়েজ উল্লাহ নিজে গড়ে তোলেন ‘ভলিউম জিরো’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বনানীতে তিনি খুব সুন্দর একটি অফিস সাজিয়েছেন। যেখানে তিনি প্রায় ৮০ জনের এক দক্ষকর্মী বাহিনী গড়ে তুলেছেন। বর্তমানে তিনি এ প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরায় বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি (আইসিসিবি), গুলশান এভিনিউতে বাংলাদেশের প্রথম পরিবেশবান্ধব কমার্শিয়াল বিল্ডিং সিম্পল ট্রি আনারকলি, তেজগাঁও লিংক রোডের আকিজ গ্রæপের আকিজ হাউজ, গুলশান এভিনিউতে শাহজালাল ইসলামিক ব্যাংকের হেড অফিস, গুলশান-২ এ সিটি কর্পোরেশন ও ইউনাইটেড যৌথভাবে নির্মিত গুলশান সেন্টার পয়েন্ট, তেজগাঁও এ টাওয়ার ১১৭, বনানীর ফাইভ স্টার হোটেল শেরাটন, উত্তরার আধুনিক কমার্শিয়াল বিল্ডিং আরহামস, মিকা কর্ণার স্টোন কমার্শিয়াল বিল্ডিং, বনানীর ইষ্টার্ন হাউজিং-এর দৃষ্টিনন্দন কমার্শিয়াল ভবন, গুলশান-১ এ সায়হাম টাওয়ার, ইষ্টার্ন হাউজিংয়ের কমার্শিয়াল বিল্ডিং, ইএইচএল ওয়ান টুয়েন্টি সিক্স সহ অসংখ্য বিল্ডিংয়ের ডিজাইন করেছেন।

বর্তমাানে বেশ কিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন তিনি। মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ তার সব ধরনের কাজ স্থাপত্য নীতি ও রাজউকের নিয়ম মেনেই করেন। ১৯৯৮ সালে পিপলস ইন্সুরেন্স ভবনের কাজ করে ডিজাইন কম্পিটিশনে অংশ নিয়ে জিতে নেন বেস্ট ডিজাইনের স্বীকৃতি। এরপর শুধুই এগিয়ে চলা। একই বছর রূপারূপ আবাসিক ভবনের জন্য আইএবি ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড জিতেন। বার্জার অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন তিনি। গ্রামীণফোন কর্পোরেট হেড অফিসের ডিজাইনের জন্য হোলসীম গ্রীণ বিøট পুরস্কার পান। ২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ডিজাইনের জন্য বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত হন। একই বছর ভলিউম জিরো স্টুডিওটির ইন্টেরিয়র ডিজাইনের জন্য অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। পাশাপাশি আরও বিভিন্ন  কাজের  জন্য মেলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি।

তিনি ১৯৯৩ সালে বিয়ে করেন। স্ত্রীর নাম মোর্শেদা নাসমিন। তিনিও ‘ভলিউম জিরো’ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত আছেন। এই দম্পতি দুই সন্তানের জনক-জননী। বড় মেয়ে লামিয়াওয়ালি উপমা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে স্থাপত্য বিষয়ে পড়াশোনা করছেন। স্থপতি ফয়েজ উল্লাহ বলেন, আমার স্থাপত্যের দর্শন মূলত সংবেদনশীলতা ও ব্যবহারিকতা এ দুটি শব্দ দিয়ে বলা যেতে পারে। স্থাপত্য চর্চার ক্ষেত্রটি বহুমাত্রিক ও নান্দনিক উৎকর্ষ নির্ভর। এ প্রসঙ্গে স্থপতি লুই সুলি ভানের বিখ্যাত উক্তিটি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেনÑ ‘অবয়ব আসে ব্যবহারিকতা থেকে’। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে কোনো স্থাপনা নির্মিত হয় তার ব্যবহারিক ধরনটা মুখ্য বিষয়। এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোই আসলে তার বাহ্যিক রূপ বা উপস্থাপনে ভঙ্গিটা বলে দেয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি ফলপ্রসূ স্থাপত্য তৈরি হয় মৌলিক চাহিদাগুলো সঠিকভাবে বোঝা এবং সেখান থেকে বাহুল্য অর্জিত নকশা প্রণয়ন ও তার প্রয়োগের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গগুলোও অবিচ্ছেদ্য ভাবে এসে যায় যা স্থপতির নৈপুণ্যে যথাযথ মর্যাদা পায়। স্থাপত্য ও নির্মাণের আরেকটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো প্রযুক্তি। যে কোনো স্থাপত্য নিজেও একটি প্রযুক্তি। শিল্প এবং বিজ্ঞানের অপূর্ব মিশেলে সৃষ্টি হয় এক একটি অনবদ্য স্থাপনা। আমি তাই সব সময় প্রযুক্তিকে স্বাগত জানাই আর নতুন ও উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারকে উৎকর্ষের সিঁড়ি মনে করি। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংবেদনশীলতা। মানুষের জন্য যে স্থাপত্য তাকে অবশ্যই সংবেদনশীল হতে হবে। ব্যবহারকারীর সূ² অনুভ‚তি থেকে শুরু করে এর কার্য সম্পাদনের সুষ্ঠতা স্থাপনার ভেতর ও বাইরে পরিবেশের ভারসাম্য, সর্বোপরি প্রকৃতির মাঝে এর সুস্থ বিরাজমানতা সবকিছুই সেই সংবেদনশীলতার অংশ। আর তাই আমার চেষ্টা থাকে সব সময়ই মানুষ ও প্রকৃতিকে সেই সম্মানটা দেয়ার। বাংলাদেশের একজন স্থপতি হিসেবে স্থাপত্য চর্চার এসব আদর্শের পাশাপাশি এই পেশাটার প্রতিও আমি প্রবল দায়বদ্ধতা অনুভব করি।

  • শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি
Comments (০)
Add Comment