রেজানুর রহমান
ঘড়ির কাটায় তখন সন্ধ্যে সাড়ে ৭টা। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটির নবরাত্রি হলে তিলধারণের ঠাঁই নেই। অবশেষে অপেক্ষার প্রহর কাটলো। কালো শেরওয়ানি ও সাদা পায়জামা পরে মঞ্চে এলেন উপমহাদেশের জীবন্ত কিংবদন্তি তারকা নাসিরুদ্দিন শাহ। ‘শুকুরিয়া’ বলে দর্শককে স্বাগত জানালেন। অভিভ‚ত কণ্ঠে বললেন, ঢাকায় আসতে পেরে আমরা আনন্দিত। আপনারা অনেকে আমার অভিনীত সিনেমা দেখেছেন। তবে আমার অভিনীত মঞ্চনাটক বোধকরি দেখেননি। আমি মনে করি অভিনয়ের সেরা জায়গাটাই হলো মঞ্চ। তাই মঞ্চে অভিনয় করতে আমার খুবই ভালো লাগে।
এভাবে হিন্দিতে প্রায় পাঁচ মিনিট কথা বললেন নাসিরুদ্দিন শাহ। তার কথার পুরোটাই সাড়া জাগানো মঞ্চ নাটক ‘ইসমত আপা কি নাম’কে ঘিরে আবর্তিত হতে থাকল। একসময় শুরু হলো বহু কাক্সিক্ষত নাটকের অভিনয় পর্ব।
আমাদের বাংলাদেশে একজন অভিনেতা হিসেবে নাসিরুদ্দিন শাহ অত্যন্ত জনপ্রিয়। সে কারণে তাকে একনজর দেখার জন্যই অনেকে সেদিন ছুটে গিয়েছিলেন নবরাত্রি হলে। মঞ্চে সেট বলতে একটি মাত্র বিছানা, একটি চেয়ার আর কয়েকটি বালিশ, সঙ্গে একটি বদনাসহ ছোটখাটো কিছু জিনিসপত্র। অভিনয় শুরুর আগে নাসিরুদ্দিন শাহ বললেন, ইসমত আপা কি নাম নাটকের ৩টি স্তরে ৩টি গল্প রয়েছে। আমরা মূলত এই গল্প তিনটিই বলার চেষ্টা করব।
অভিনয় পর্বে সত্যি সত্যি অজানা কিছু গল্পের ভেতরে ঢুকে গেলেন দর্শক। ভারতের খ্যাতিমান নারীবাদী লেখিকা ইসমত চুখতাইয়ের ‘চুই মুই’ মুঘল বাচ্চা ও ঘরওয়ালি শীর্ষক ৩টি গল্পের মেলবন্ধন রয়েছে ‘ইসমত আপা কি নাম’ নাটকে। তিন গল্পের তিনটি অধ্যায়ে পর্যায়ক্রমে অভিনয় করেন নাসিরুদ্দিন শাহর মেয়ে হেবা শাহ, স্ত্রী রত্মা পাঠক শাহ ও নাসিরুদ্দিন শাহ নিজে। মঞ্চে যখন অভিনয় পর্ব চলছিল তখন মনে হচ্ছিল অভিনয় নয় বাস্তব কিছু চরিত্র মঞ্চে বিচরণ করছে। অথচ মঞ্চে অভিনয় করছিলেন একজনই। প্রথম পর্বে হেবা শাহ, দ্বিতীয় পর্বে রত্মা পাঠক শাহ ও শেষ পর্বে নাসিরুদ্দিন শাহ। নাটকের তিনটি পর্বেই পুরুষ শাসিত সমাজে নারীর পথচলা ও অস্থিত্ব রক্ষার তিনটি গল্প অন্তর দিয়ে অনুভব করেছে দর্শক।
চুই মুই নামের প্রথম গল্পের চরিত্র দুজন গর্ভবতী নারীর। ট্রেনের একটি কামরায় চড়ে যাচ্ছে তারা। এক নারীর জীবন যাপন অনেকটাই আরামপ্রদ। তার একটাই আকাক্সক্ষা যেন সন্তান জন্ম দিতে পারে। সন্তান জন্ম দিতে পারলে স্বামী তাকে ছেড়ে যাবে না। অন্য গর্ভবতীর নারীর জীবন একেবারেই ভিন্ন। তার না আছে স্বামী না আছে সম্পদ। প্রতি মুহূর্তে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে সে।
নাসিরুদ্দিন শাহর মেয়ে হেবা শাহ দুই নারীর ভ‚মিকায় অভিনয় করে মঞ্চ ছাড়তেই মঞ্চের পেছন থেকে উঠে এলেন রত্মা পাঠক শাহ। এর মাঝে শুধু বিছানার চাদর পাল্টে বিছানাটাকে নতুনরূপ দেয়া হলো। মুঘল বাচ্চা শিরোনামের গল্প বলতে শুরু করলেন রত্মা পাঠক শাহ। মুঘল আমল পরবর্তী সময়কে ঘিরে মুঘল বাচ্চার গল্প আবর্তিত হয়েছে। দুটি চরিত্র- গৌরি ও কালে মিয়া। কালে মিয়া মুঘলদের বংশধর। সে তার বিয়ের রাতে স্ত্রীকে একাকী ফেলে রেখে চলে যায়। এই গল্পে মূলত স্ত্রীর প্রতি ক্ষমতাধরদের নির্দয়, নিষ্ঠুর আচরণের বাস্তবচিত্র তুলে ধরা হয়েছে। রত্মা পাঠক শাহ তার অভিনয় সৌকর্যে গল্পটিকে এতটাই বিশ্বস্ত ও প্রাণবন্ত করে তোলেন যে, তিনি যখন মঞ্চ ত্যাগ করেন তখনও দর্শকের অনেকে ঘোরের মধ্যে ছিলেন। তবে হ্যাঁ, তৃতীয় গল্পটি বলতে এসে নাসিরুদ্দিন শাহ চমকে দিলেন সবাইকে। ঘরওয়ালি শীর্ষক এই গল্পেরও দুটি চরিত্র। একদিকে অবিবাহিত মির্জা, অন্যদিকে গৃহপরিচারিকা ও যৌনকর্মী লাজ্জো। তার প্রতি আশেপাশের সব পুরুষই আকর্ষণবোধ করে। কিন্তু সে তার মনির মির্জার প্রতি দারুণ উদার। একসময় তাদের সম্পর্ক পরিণয়ে রূপ নেয়। কিন্তু শারীরিকভাবে অক্ষম মির্জা কামকাতর লাজ্জোকে সুখি করতে ব্যর্থ হয়। একসময় দুজনের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটে।
গল্প বলার ঢঙে মির্জা আর লাজ্জোর চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেন নাসিরুদ্দিন শাহ। বসুন্ধরার নবরাত্রি হলে সহ¯্রাধিক দর্শক মন্ত্রমুগ্ধের মতো নাসিরুদ্দিন শাহর অভিনয় দেখেন। ব্লুজ কমিউনিকেশনের উদ্যোগে ‘ইসমত আপা কি নাম’ শীর্ষক এই নাটক মঞ্চায়নের আয়োজন করা হয়েছিল। সহযোগিতায় ছিল সিটি ব্যাংক ও চ্যানেল আই। নাটক মঞ্চায়ন শেষে নাসিরুদ্দিন শাহ ও তার পরিবারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ মঞ্চে আসেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান আবুল খায়ের লিটু।
যদি একবার সত্যজিতের ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেতাম!
-নাসিরুদ্দিন শাহ
ঢাকায় এসে প্রচার মাধ্যমকে অনেকটা এড়িয়েই যাচ্ছিলেন কিংবদন্তি চলচ্চিত্রাভিনেতা নাসিরুদ্দিন শাহ। ব্লুজ কমিউনিকেশনের কর্মকর্তাদের আন্তরিকতায় তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ মিলল সন্ধ্যায় নাটক শুরুর মাত্র এক ঘণ্টা আগে। তাও মাত্র ১০ মিনিটের জন্য।