Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

ভলিউমজিরো নিয়ে ফয়েজের যত ভাবনা

দীর্ঘ দুই যুগের বেশি সময় ধরে স্থাপত্যচর্চায় নিবেদিন প্রাণ মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান আর্কিটেক্ট। আধুনিক ও টেকসই স্থাপত্য নকশায় সুউচ্চারিত তাঁর নাম। নির্ভরযোগ্যতা, বিচক্ষন ডিজাইন ও নিরলস পরিশ্রম তাঁর সাফল্যের মূল ভিত্তি। বর্নাঢ্য ও লক্ষ্যে অবিচল এক ক্যারিয়ার নিয়ে তিনি এগিয়ে চলেছেন তুমুল আত্মবিশ্বাসের সাথে। তাঁর ব্যক্তিগত অর্জন গুলো ব্যক্তিসীমা ছাড়িয়ে সমাজ ও দেশের উন্নয়নেও একের পর এক মাইল ফলক স্থাপন করে যাচ্ছে। প্রথিতযশা এই স্থপতিকে নিয়ে এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি’তে লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
স্থপতি মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহর পৈত্রিক নিবাস ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায়। কিন্তু তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। তাঁর বাবার নাম এ কে এম ওয়ালি উল্লাহ। তিনি একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। মা সুলতানা বেগম গৃহিণী। পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে ফয়েজ তৃতীয়। মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৮৩ সালে। ১৯৮৫ সালে একই কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বুয়েটের স্থাপত্য অনুষদে। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্থাপত্য বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। শিক্ষাজীবন শেষে নিজে কিছু করবেন এ প্রত্যয় নিয়ে শুরু করেন স্থাপত্যচর্চা। পরবতীতে তিনি যোগ দেন বুয়েটের আর্কিটেকচার বিভাগে প্রভাষক হিসেবে। ১৯৯৭ সালে তিনি মাস্টার্স সম্পন্ন করেন এবং স্বীকৃতি স্বরূপ গোল্ড মেডেল এ ভূষিত হন। একই বছর সহকারী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৮ সালে স্বনামধন্য স্থপতি মুস্তাফা খালিদ পলাশের সাথে গড়ে তোলেন ‘ভিস্তারা আর্কিটেক্টস’। ভিস্তারা আর্কিটেক্টস এ থাকাকালিন তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে পান্থপথে বসুন্ধরাসিটি শপিংমল। বাংলাদেশে স্থাপত্য শিল্পে বসুন্ধরাসিটি একটি অন্যতম মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। এছাড়াও পান্থপথে ইউনিক ট্রেড সেন্টার, বসুন্ধরায় জিপি হাউস, মতিঝিলে পিপলস ইন্সুরেন্স ভবন, গুলশান-২ এ ওয়েস্টিন হোটেল, বাংলালিংক ভবন, ল্যাব এইড হাসপাতাল ও আরো অনেক কাজ রয়েছে তাঁর সেই সময়ের।
২০০৮ সালে মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ গড়ে তোলেন তাঁর নিজের স্থাপত্যচর্চা প্রতিষ্ঠান ‘ভলিউমজিরো’। একদল তরুণ প্রতিভাবান আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সহকর্মীদের নিয়ে তিনি সাফল্যের সাথে কাজ করে চলেছেন ভলিউমজিরোতে। বাংলাদেশে উন্নত স্থাপত্য পেশা চর্চায় ভলিউমজিরো খুব দ্রুত অনন্য এক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। স্থাপত্যের বিভিন্ন শাখায় সব্যসাচী বিচরণ মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ তথা ভলিউমজিরোর। এ প্রতিষ্ঠান থেকে তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে বসুন্ধরা স্পোটর্স কমপ্লেক্স, বসুন্ধরা ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি, আবাসন প্রকল্প রূপায়ন সিটি (উত্তরা), দ্যা ওয়েসিস (মগবাজার), গুলশান এভিনিউতে লিড প্লাটিনাম সনদ প্রাপ্ত গ্রিন বিল্ডিং সিম্পলট্রি আনারকলি, আবাসিক ভবন সিম্পলট্রি কফিল ম্যানর, শান্তা অলটেয়ার, শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক এর হেড অফিস, আকিজ হাউজ, সিম্পলট্রি লাইট হাউজ, হোটেল শেরাটন, উত্তরায় আরহামস টাওয়ার ইত্যাদি । এছাড়াও আরো অনেক নান্দনিক ভবনের ডিজাইন করেছেন যা সারা ঢাকা শহর ও দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্মিত ও নির্মিয়মান।
কক্সবাজার রেলওয়ে স্টেশন তেমনই একটি নির্মাধীন প্রকল্প যা ইতোমধ্যে মানুষের মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলেছে। এটি বাংলাদেশের সর্বাধিক রেলস্টেশন এখন পর্যন্ত। সাগর সৈকত থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে, নান্দনিক ডিজাইন আর নির্মাণ শৈলীর পাশাপাশি এর বহুমাত্রিক মাস্টার প্ল্যান পর্যটন শহর কক্সবাজারকে নিসন্দেহে করবে আরো আকর্ষনীয়। সাগর উপভোগের উদ্দেশ্যে আগত পর্যটকরা রেলস্টেশনে এসেই নিজেদের আবিস্কার করবে সামুদ্রিক এক উপমার মাঝে। ট্রেন আসা যাওয়া ছাড়াও এ স্টেশনে রয়েছে বিভিন্ন যাত্রী সেবার আয়োজন, হলরুম, লকার রুম ও শপিং এর ব্যবস্থা। স্টেশনের লকারে লাগেজ রেখেই পর্যটকরা চাইলে ঘুরে আসতে পারবেন সাগর কিংবা বিভিন্ন দর্শনীয় স্থান।
আধুনিক নির্মাণ শৈলীর এই আইকনিক রেলস্টেশনের স্থপতি মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ স্টেশনটি সম্পর্কে বলেন, কক্সবাজার রেলস্টেশন ডিজাইন করার সময় একটা অনুপ্রেরণা ছিলো। ঝিনুক ও শামুকের গঠনটা যেন বাইরে থাকে। আর বাকি শরীরের অংশটুকু ভেতরে আবৃত থাকবে। আমরা সেখান থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে পুরো স্টেশনটাকে একটা ছাউনি দিয়ে ঢেকে দিয়েছি। এখন রেলস্টেশন শুধু যাত্রী যাওয়া-আসার জন্য নয়। এখানে আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে টেকসই করার জন্য নানা ধরনের ব্যবহারকে সংমিশ্রন করা হয়। পর্যটকদের জন্য বিভিণ্ন ধরনের সুবিধা, রেস্টুরেন্ট, ফুডকোর্ট, মাল্টিপারপাস হল, হোটেল থাকবে। সুতরাং এটি শুধু রেলস্টেশন নয়, এটি একটি ডেস্টিনেশন।
তিনি আরও বলেন, তাপনিরোধী কাঁচের ব্যবহার ও স্কাই লাইটের মাধ্যমে এই স্টেশনে থাকবে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা। এখানে কৃত্রিম আলোর প্রয়োজন নেই। এছাড়া ছাউনিটা পুরো কাঠামোটাকে ঢেকে রেখেছে। ফলে সবসময় ভবনটি সহনীয় তাপমাত্রায় থাকবে। এতে কুলিং লোড কম হবে। ফলে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের লোডও কম হবে। এতে এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ সাশ্রয় হবে।
আরেকটি গুরুত্ব বিষয় হচ্ছে, এই প্রকল্পটি পরিবেশগত ভাবে টেকসই হিসেবে ডিজাইন করা। এখানে বৃষ্টির পানি থেকে শুরু করে পানি পুনব্যবহার করা, বিদ্যুৎ সাশ্রয়, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া পুর্নব্যবহৃত টেকসই উপাদান ব্যবহার করছি। পানির জন্য কম অপচয় ওয়াটার ফিক্সচার ব্যবহার করছি। নানা রকম সুযোগ-সুবিধা আছে এখানে। বলা যায় এই স্থাপনা একটি পরিপূর্ণ গ্রীন বিল্ডিং।
১৯৯৮ সালে পিপলস ইন্সুরেন্স ভবনের কাজ করে ডিজাইন কম্পিটিশনে অংশ নিয়ে জিতে নেন বেস্ট ডিজাইনের স্বীকৃতি। এরপর থেকে শুধুই এগিয়ে চলা। একই বছর রূপারূপ আবাসিক ভবনের জন্য আইএবি ডিজাইন অ্যাওয়ার্ড জিতেন। বার্জার অ্যাওয়ার্ড জিতে নেন তিনি। গ্রামীণফোন কর্পোরেট হেড অফিসের ডিজাইনের জন্য হোলসীম গ্রীন বিট পুরস্কার পান।
২০০৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ডিজাইনের জন্য বিশেষ সম্মাননায় ভূষিত হন। একই বছর ভলিউমজিরো স্টুডিওটির ইন্টেরিয়র ডিজাইনের জন্য অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। পাশাপাশি আরও বিভিন্ন কাজের জন্য মেলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃর্তি।
তরুণ স্থপতিদের উদ্দেশ্যে স্বনামধন্য স্থপতি মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ বলেন, সব স্থপতিই কোনো না কোনো সময় তরুণ ছিল, তারপরে সে প্রবীন হয়। আমিও তরুণ অবস্থা থেকে আজকে এই জায়গায় পৌছেছি। আমার নিজের একটা জার্নি আছে। সেই জার্নিকে আমি স্মরণ করি, আমার সামনে প্রতিভাত্ব করি, তখন আমি যেটা দেখি, সেটা হচ্ছে আমার কমিটমেন্ট, আমার হার্ডওয়ার্কি আমার, সিনসিয়ারিটি, সেটা আমাকে সাহায্য করেছে একজন ভালো স্থপতি হয়ে তৈরি করতে। আরেকটা হচ্ছে আমার অভজারভেশন ক্ষমতা বাড়ানো। স্থপতিদের কিন্তু সব কিছু সমন্ধে একটা সম্বক ধারণা থাকতে হয়। সামগ্রীক বিষয়ে, পরিবেশ, ভবন, স্থাপত্য আর্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং, সায়েন্স সব বিষয়ে তার নলেজ থাকতে হয়। একজন স্থপতি, একজন পুনাঙ্গ মানুষ হিসেবে তার শিল্পবোধ, আবার বৈজ্ঞানিক বৃত্তি সব কিছু মিলিয়ে একটা পুনাঙ্গ নলেজ থাকতে হয়। তরুণ বয়সে ওই ভিত্তিটা তৈরি করতে হবে। অনেক বেশি প্রবীণদের সাথে কাজ করে শিখতে হবে। তারপরে গিয়ে সে আস্তে আস্তে তার কাজের এক ধরনের ম্যাচুরিটি আসবে। তরুণ স্থপতিদের জন্য তিনি আরও বলেন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এই উন্নতির যুগে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ডিজিটাল ট্রান্সফরমেশন এবং ইনফরমেশন টেকনোলজির সুফল তরুণরা নিতে পারবে যদি তাদের কমিটমেন্ট, সিনসিয়ারিটি ও হাডওয়ার্কিং এটিচিউড ঠিক থাকে। স্থাপত্য পেশায় কোনো রকম আয়েশ করে স্থাপত্য পেশা করার কোনো সুযোগ নেই। অনেক পরিশ্রম করতে হবে। কারণ আমাদের নিজেদের কাজ নিজেদেরই করতে হবে। আমাদের কাজ কেউ করে দিতে পারবে না।
ভলিউমজিরো নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ বলেন, ‘ভলিউমজিরো’ বাংলাদেশে একটি অন্যতম আর্কিটেকচার প্র্যাকটিস। যেখানে আমরা অনেক স্থপতি, প্রকৌশলী, আর্টিস্ট এক সাথে কাজ করি। আমরা একটা সুন্দর কাঠামোর মধ্যে দাঁড় করিয়ে এই চর্চাটা করার চেষ্টা করি। যেটা আমাদের দেশে খুব বেশি এক্সজাম্পল ছিল না। সেই দিক থেকে ভলিউমজিরো বলতে পারেন একটা সার্থক প্র্যাকটিস। প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভলিউমজিরো আমাদের দেশে একটা সুস্থ এবং সুন্দর স্থাপত্য চর্চার একটি ভালো প্রতিষ্ঠান হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে। আমরা চাই, এটাকে আরো বেশি স্থপতিদের সন্নিবেশ ঘটিয়ে এই চর্চাটাকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যেতে।
১৯৯৩ সালে মোহাম্মদ ফয়েজ উল্লাহ বিয়ে করেন মোর্শেদা নাসমিনকে। তিনিও ভলিউমজিরো প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িয়ে আছেন। এই দম্পতি দুই সন্তানের জনক-জননী। বড় মেয়ে লামিয়া ওয়ালি উপমা স্থাপত্য বিষয়ে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ও যুক্তরাজ্যের এএ স্কুল অফ আর্কিটেকচার থেকে মাস্টার্স শেষ করে ভলিউমজিরোতেই পেশাজীবন শুরু করেছেন। ছোট ছেলে যাহি ওয়ালি আদিত স্যার জন উইলসন কলেজে অধ্যায়ন শেষে এ লেভেল পরীক্ষার্থী।