Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

জনসম্মুখে মুখ দেখিয়ে পরিচিতি বুদ্ধির তাগিদ বোধ করিনা

কাজী আনোয়ার হোসেন

মাসুদ রানা’র জনক কাজী আনোয়ার হোসেন আর আমাদের মাঝে নেই। গত ১৯ জানুয়ারি তিনি না ফেরার দেশে চলে গেছেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আনন্দ আলোর এই লেখাটি পুণঃপ্রকাশ করা হলো… আনন্দ আলো: কেমন আছেন? কাজী আনোয়ার হোসেন: ভালো। ধন্যবাদ। আনন্দ আলো: আপনাকে সাক্ষাৎকারের জন্য সাধারণত পাওয়া যায় না। আজ পাওয়া গেল। অভয় দিলে কিছু প্রশ্ন করতে পারি? কাজী আনোয়ার হোসেন: নিশ্চয়ই পারেন। তবে প্রশ্নগুলো লিখিত আকারে পেলে আমার জন্য সুবিধা হয়। কথা বলায় তেমন পটু নই, তাই এই অনুরোধ। আনন্দ আলো: বেশ, লিখিত প্রশ্নই দিচ্ছি তা হলে। মাসুদ রানার লেখক হিসেবেই আপনার ব্যাপক পরিচিতি। এই মাসুদ রানা আসলে কে? আপনার দেখা কোনও চরিত্র, নাকি কল্পনার? কাজী আনোয়ার হোসেন: আসলে আগে থেকে এই চরিত্র সম্পর্কে তেমন কোন ধারণাই আমার ছিল না। এটুকু জানতামÑ দেশপ্রেমিক এক দুঃসাহসী বাঙালী যুবকের কাহিনী লিখতে চাই। লিখতে লিখতে ওর চরিত্রটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে আমার নিজের কাছে। ও কী, এবং কী নয়; সেটা বুঝতেও বেশ অনেকটা সময় লেগেছে আমার। ফটো প্রিণ্ট করার সময় কেমিক্যালে চুবানোর পর ছবিটা যেভাবে ধীরে ধীরে ফুটে ওঠে, ঠিক তেমনই একটু একটু করে স্পষ্ট হয়েছে ও আমার কাছে। আনন্দ আলো: মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম উপন্যাস লেখার কাহিনীটা আসলে কেমন? কাজী আনোয়ার হোসেন: ১৯৬৫ সাল, পাক-ভারত যুদ্ধ চলছে। কুয়াশা সিরিজের বই লিখছিলাম তখন একের পর এক। আমার শিকারি-বন্ধু মাহবুব আমিন একদিন হঠাৎ চেয়ে বসলেন: ক’টা বই দেবেন তো, পড়ে দেখব কী লিখছেন? দিলাম। তিনি ছিলেন লাহোরের আর.জি.এ রেডিও কোম্পানির ঢাকা-চিফ। তিন দিন পর যখন আবার দেখা হলো, আশা করছিÑ প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে কিছু বলবেন বুঝি! কিন্তু কিছুই বলছেন না তিনি। ভাবলাম, পশ্চিম পাকিস্তানে মানুষ হয়েছেন, বাংলা পড়তে পারেন কি না কে জানে! শুনেছি ম্যাট্রিক (এস.এস.সি) পাশ করে জার্মানি গিয়েছিলেন লেদার টেকনোলজি পড়তে, বছর কয়েক ঘুরেফিরে চলে এসেছেন কোনো ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা ছাড়াইÑ হয়তো টেনে-টুনে একটা বইয়ের দু’তিন পৃষ্ঠা পড়ে কষ্ট হওয়ায় বাদ দিয়েছেন। চা-টা খেয়ে যখন উঠি-উঠি করছি, তখন আমার লেখার প্রসঙ্গ তুললেন তিনি। বললেন: খুব খারাপ তা বলব না, তবে বই তিনটে পড়ে যা বুঝলামÑ আধুনিক রহস্যসাহিত্য সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই আপনার। একটা ইংরেজি থ্রিলারও পড়েননি আপনি, তাই না? স্বীকার করলাম, পড়িনি। কিন্তু আমি তো বাংলা লিখছি, ইংরেজি নয়। উনি বললেন: দুনিয়ার কোথায় কে আপনার লাইনে কী কাজ করছে সেটা জানতে হলে ইংরেজি ঘেঁটেই জানতে হবে আপনাকে। মুখ কালো করে উঠে পড়লাম। আবুও (মাহবুব আমিনের ডাকনাম) উঠলেন। বললেন: আপনার মনে কষ্ট দিয়েছি, সেজন্যে দুঃখিত। চলুন, আপনাকে একটা বই প্রেজেণ্ট করব। তাঁর ছোট্ট ফিয়াট সিক্স হানড্রেড গাড়িতে চেপে ঢাকা স্টেডিয়ামের বিখ্যাত বইয়ের দোকান ‘আইডিয়াস’-এ এলাম। ওখান থেকে সাড়ে তিন টাকা দিয়ে ইয়ান ফ্লেমিঙের ‘ডক্টর নো’ কিনে আমাকে প্রেজেণ্ট করলেন। ওইদিনই দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পর বইটা নিয়ে বিছানায় উঠলাম। এবং চিরকালের জন্য কৃতজ্ঞ হয়ে গেলাম মাহবুব আমিন আবুর কাছে। লজ্জাও পেলাম। সত্যিই, কী লিখি আমরা! এর পর কয়েক মাস ধরে যতগুলো ইংরেজি থ্রিলার পেলাম একে একে সব পড়ে ফেললাম। তারপর লিখতে বসলাম মাসুদ রানা সিরিজের প্রথম বই ‘ধ্বংস-পাহাড়’। লেখার ব্যাপারেও অনেক ভাবে সাহায্য করেছেন আমাকে আবু ও তাঁর এক সিএসপি বন্ধু আতাউল হক। আনন্দ আলো: মাসুদ রানার একটি সিরিজে নায়কের নাম ছিল রাহাত খান। এটা কি বিশিষ্ট সাংবাদিক রাহাত খানের প্রতিচ্ছবি? কাজী আনোয়ার হোসেন: সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক রাহাত খান আমার ক্লাসফ্রেন্ড ছিলেন।যদিও বয়সে আমার চেয়ে দু’-তিন বছরের ছোট বলে আমাকে নব্ভাই (নবাব ভাই) বলে ডাকতেন। এম.এ ক্লাসের দুটো বছর ঢাকা ভার্সিটিতে আমরা মানিকজোড় বলে পরিচিত ছিলাম। পাশ করার পরেও বেশ কয়েক বছর তিনি আমাদের বাড়িতে ছিলেন। খুবই হাসিখুশি, আলাপি মানুষ ছিলেন তিনি। মাসুদ রানা লেখার সময় ঠাট্টার ছলে সিরিজের সবচেয়ে গুরুগম্ভীর চরিত্রটির নাম দিয়েছিলাম মেজর জেনারেল (অব.) রাহাত খান। তিনি হেসেছিলেন। এই মেজর জেনারেল যখন মেজর ছিলেন সে-সময়ে দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধে তাঁর কী অবদান ছিল তাই নিয়ে দু’-তিনটে বই লিখেছিলাম। এক হিসেবে ঠিকই ধরেছেন: সেই একই রাহাত খান। আনন্দ আলো: মাসুদ রানার লোগোসহ অলঙ্করণের একটা বৃহৎ জায়গা জুড়ে ভ‚মিকা রেখেছেন বিশিষ্ট শিল্পী হাশেম খান, এটা কীভাবে সম্ভব হল? এর পেছনের কাহিনীটা কেমন? কাজী আনোয়ার হোসেন: উনি স্ট্রেট ফরোয়ার্ড মানুষ, কোনও ভান-ভণিতা নেই। কাছাকাছিই ‘ললনা’ নামে একটি পত্রিকায় পার্ট-টাইম কাজ করতেন। ১৯৬৭-র মাঝামাঝি হঠাৎ একদিন এসে হাজির। নিজের পরিচয় দিলেন, বললেন আমাদের সঙ্গে কাজ করতে চান। আমি তো আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। শুরু হলো সেবা প্রকাশনীর প্রচ্ছদ শিল্পের স্বর্ণযুগ। পরবর্তী সময়ে আমাদের রহস্য পত্রিকার তিনিই ছিলেন প্রথম শিল্প-সম্পাদক। সেবা প্রকাশনী, মাসুদ রানা, রহস্যপত্রিকাÑ এ সবের প্রথম লোগো তাঁরই হাতে তৈরি। ঘনিষ্ঠতা এতই গাঢ় হয়েছিল যে বাহাত্তরের জানুয়ারিতে হাশেম খান, শাহরিয়ার কবীর ও বেবি মওদুদকে নিয়ে শিয়ালবাড়ির বধ্যভ‚মিতে গিয়েছিলামÑ যদি শাহরিয়ারের মেঝদা নিখোঁজ জহির রায়হানের কোন হদিশ পাওয়া যায়! সম্প্রতি সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘মায়ের বাক্স’ নামে একটি চমৎকার বই লিখেছেন শিল্পী হাশেম খান। আনন্দ আলো: মাসুদ রানার কাভার কোলাযের ক্ষেত্রে শিল্পী শাহাদত চৌধুরীর নাম দেখা যায়। ইনি কি প্রয়াত সাংবাদিক শাহাদত চৌধুরী? মাসুদ রানার কোলায প্রচ্ছদের কাহিনীটা কেমন? কাজী আনোয়ার হোসেন: জী। ইনিই সাপ্তাহিক বিচিত্রার সম্পাদক সেই শাহাদত চৌধুরী বা শাচউ। স্বাধীনতার পর শিল্পী হাশেম খান যখন চিত্তরঞ্জন বাবুর প্রকাশনী ‘মুক্তধারা’ নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, তখন তাঁরই পরামর্শে ধরলাম শাহাদতকে। আর্ট কলেজ থেকে পাশ করলেও ছবি আঁকার দিকে তেমন ঝোঁক ছিল না শাহাদতের, সমস্ত ধ্যান-জ্ঞান-ভালবাসা ছিল সাময়িক পত্রিকার প্রতি, নতুন আঙ্গিকে পত্রিকা সাজাবার প্রতি। শাহাদত সাফ বললেন: ছবি আঁকার মত সময় তাঁর নেই। হঠাৎ চোখে পড়ল, সাপ্তাহিক বিচিত্রার জন্য চমৎকার একটা কোলায প্রচ্ছদ করেছেন শাহাদত। আমি বললাম: ছবি আঁকতে হবে না, আপনি কোলায করে প্রচ্ছদ করেন। নিমরাজি হলেন তিনি। সেই শুরু হলো সেবা থেকে কোলায প্রচ্ছদ। আজও সে ধারাই চলছে। আনন্দ আলো: এক সময় গান গাইতেন। ছাড়লেন কেন? কাজী আনোয়ার হোসেন: জীবন যুদ্ধে নেমে প্রেস, প্রকাশনী ও লেখালেখি নিয়ে এতই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়লাম যে গান গাইবার আর সময় থাকল না। বুঝলাম, সব একসঙ্গে হবে না; অন্তত একটাকে ছাড়তে হবে। ভেবেচিন্তে গানটাই ছাড়লাম। আনন্দ আলো: যোবায়দা মির্যা, সন্জীদা খাতুন ও ফাহমিদা খাতুন আপনার তিন বোন সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। কাজী আনোয়ার হোসেন: বড় বোন যোবায়দা মির্যা ইংরেজির অধ্যাপক ছিলেন। বাংলা লেখার হাতও ছিল চমৎকার। তাঁর ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি’ বইটি আত্মজীবনীমূলক হলেও সমসাময়িক মজার মজার তথ্যে এমনই ভরপুর যে পড়তে নিলে সহজে ছাড়া যায় না। কবি নজরুল ইসলাম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এবং আরও অনেক মহারথীর কথা এসেছে এ বইয়ে। ড. সন্জীদা খাতুন আমার বোনেদের মধ্যে পঞ্চম। বাংলার অধ্যাপক। সংগঠনপ্রিয় মানুষ। সেই ছোটবেলাতেই আমাদের তিন ভাইকে পাঠাতেন ফজলুল হক হলের ছাত্রদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে আনতেÑ কী, না বই-খাতা কিনে গরীব বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাবেন। তারপর একটু বড় হয়ে মুকুল ফৌজ পরিচালনার ভার নিলেন। পরিণত বয়সে শুরু করলেন ছায়ানট। এখন ছায়ানটের নিবেদিতপ্রাণ কর্ণধার। লাইক মাইÐেড, বন্ধু-সহযোগী পেতে কোনও সমস্যা হয়নি কখনও। তাঁর গান ও লেখালেখির ব্যাপারে তো সবাই জানেন, তাই আর কথা বাড়ালাম না। আর ফাহমিদা খাতুন আমার সাত বোনের মধ্যে লাস্ট বাট ওয়ান। যখন অবসর নেন তখন ময়মনসিংহ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের জুলজি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। সেইসঙ্গে সারাটা জীবন চলেছে তাঁর রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা। তিনি পাকিস্তান আমলে ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালবাসি’ গানটি গেয়ে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মানিত হয়েছেন। আনন্দ আলো: বাবা কাজী মোতাহার হোসেন সম্পর্কে কিছু বলুন। কাজী আনোয়ার হোসেন: অক্লান্ত পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন আমার বাবা। কখনও খামোকা বসে থাকতে দেখিনি তাঁকে। হয় পড়ছেন, পড়াচ্ছেন, লিখছেন, অঙ্ক কষছেন, নয় তো দাবা খেলছেন Ñ আর নয় তো চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। মৃত্যুর এত বছর পরওÑ তা প্রায় ৩৮ বছর তো হলোইÑ তাঁর আদরের কথাটাই উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে আমার স্মৃতিতে। আমি নিজেই এখন বুড়োমানুষ, কিন্তু এখনও মিস্ করি বাবার সেই আদর। বুকে জড়িয়ে ধরে চুমো দিচ্ছেন গালে, গেঞ্জিতে তাঁর গায়ের গন্ধ, নাকে-মুখেপাকা, খসখসে দাড়ির স্পর্শ এখনও অনুভব করতে পারি স্পষ্ট। আনন্দ আলো: শুনেছি মাছ ধরা আপনার প্রিয় শখ, এ ব্যাপারে কিছু বলুন। কাজী আনোয়ার হোসেন: প্রিয় শখ ছিল, একসময়ে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছি লেকের পারে। মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম কয়েকটা বছর। চার, মশলা, পাউরুটি, পিঁপড়ের ডিম; ছিপ, বড়শি, ফাৎনা, সুতা, হুইল; রুই, কাতলা, মৃগেল, সিলভার কার্প, আইড়, বোয়াল, গজার, চিতলÑ সে এক আলাদা জগৎ, আলাদা জীবন, অপার আনন্দ। তবে সময় এতই নষ্ট হয় যে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছি। আনন্দ আলো: এক সময় সাপ্তাহিক বিচিত্রাসহ বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটগল্প লিখেছেন। এখন কেন লেখেন না? কাজী আনোয়ার হোসেন: আসলে আমার বেশিরভাগ ছোটগল্পই লেখা হয়েছে চাপে পড়ে। আমার ছোট ভাইয়ের মত ছিল বিচিত্রার শাহরিয়ার কবির, তাগাদা দেয়ার ওস্তাদ… অত তারিখে আমার একটা ছোটগল্প চাই-ই চাই! রানা লেখার চাপ, শিডিউলের চাপ, ব্যবসার চাপ ওসব কিচ্ছু বুঝি না, গল্প দিতেই হবে। সেই শাহরিয়ার পত্রিকার লাইন ছাড়তে বাধ্য হলো, পুরোপুরি যুক্ত হলো শহীদ জননী জাহানারা ইমামের সংগঠনের সঙ্গে। আমারও গল্প লেখার ইতি হয়ে গেল। এখন চেষ্টা করলেও আর লিখতে পারব না। আনন্দ আলো: মাসুদ রানার দেশপ্রেম নিয়ে কিছু বলুন। কাজী আনোয়ার হোসেন: মাসুদ রানার দেশপ্রেমের সঙ্গে কোনও রকম স্বার্থ বা প্রাপ্তিযোগ জড়িত নেই, সম্ভবত সেজন্যেই ওর প্রেম মানুষের মন ছুঁয়েছে। ওর কথা বলতে গিয়ে প্রায় সবাই তাই বুদ্ধি, সাহস, কৌশল, দক্ষতা এসবের পাশাপাশি বিশেষ করে দেশপ্রেমের কথাটা উল্লেখ করেন। আনন্দ আলো: এক সময় পেপার ব্যাক বইয়ের জয়জয়কার ছিল। বর্তমানে মানুষ বই বিমুখ হয়ে যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে মাসুদ রানা কি শেষ পর্যন্ত বই হিসেবে থাকবে? কাজী আনোয়ার হোসেন: এ প্রশ্ন আমারও। লক্ষ করেছি, গত কয়েক বছর ধরেবইপত্রের বিক্রি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। কেন, তা আমার জানা নেই। টেকনোলজি? স্মার্ট ফোন? ফেসবুক? ইউ টিউব? নাকি কিছু অসৎ ব্যক্তি বাজারের চালু বইগুলোকে বেআইনীভাবে পিডিএফ-এ রূপান্তরিত করে ইণ্টারনেটে ছেড়ে দিচ্ছে বলে এই অবস্থা? অথবা লেখকরা সবাই হঠাৎ করে খারাপ লিখতে শুরু করেছেন? শুধু রানা নয়, গোটা প্রকাশনা ব্যবসারই এখন টাল-মাটাল অবস্থা। আনন্দ আলো: আসলে ছাপা বইয়ের ভবিষ্যৎ কী বলে আপনার মনে হয়? বই কি হারিয়ে যাবে? কাজী আনোয়ার হোসেন: খুব ভালো ভবিষ্যৎ তো দেখতে পাচ্ছি না। পৃথিবীর বুক থেকে বই হারিয়ে যাবে, এটা বিশ^াস করা কঠিন। আসলে কী হবে কে জানে! সরকার এইসব আচমকা গজিয়ে ওঠা বেআইনী ইণ্টারনেট-ব্যবসায়ীদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেন তার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে হয়তো। লেখকের কলম যদি বন্ধ হয়েই যায় তা হলে এই পিডিএফ-ওয়ালারাই বা হক মারবে কার, কী করে? আনন্দ আলো: অবসরে কী করেন? কাজী আনোয়ার হোসেন: গান শুনি, নয়তো ইউ টিউবে গ্র্যাÐমাস্টারদের চমকপ্রদ দাবা খেলা দেখে মুগ্ধ হই। আনন্দ আলো: পর্দার আড়ালেই থাকতে পছন্দ করেন। কেন? কাজী আনোয়ার হোসেন: আমার তো আত্মপ্রকাশের একটা মাধ্যম আছেই। সেটা নিয়েই খুশি থাকি। টিভিতে বা জনসমক্ষে মুখ দেখিয়ে পরিচিতি বৃদ্ধির কোনও তাগিদ বোধ করি না। জানি তো: কিছুই রবে না। আনন্দ আলো: আপনার বর্ণাঢ্য জীবনের অভিজ্ঞতায় জীবনে সফল হতে গেলে কীভাবে এগুনো প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন? কাজী আনোয়ার হোসেন: আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে যেটুকু আসে বলি। প্রথমে খুঁজে বের করতে হবে কী আমার ভালো লাগে, কোন্টা ভালো পারি। তারপর সেটার পেছনে লাগতে হবে আদাজল খেয়ে। এর ফলে জীবনে সফলতা যা আসার তা তো আসবেই, সার্থকতা আসবে শতভাগ। আনন্দ আলো: আবার যদি জীবন শুরু করার সুযোগ হতো তাহলে কীভাবে শুরু করতে চাইতেন? কাজী আনোয়ার হোসেন: ঠিক এভাবেই। পছন্দের কাজটা করতাম যতদিন বাঁচি।…আনন্দ আলো কে ধন্যবাদ। ছবি: রাকিবুল হক একনজরে জন্ম ১৯ জুলাই ঢাকায়। জনপ্রিয় মাসুদ রানা সিরিজের স্রষ্টা। সেবা প্রকাশনীর কর্ণধার হিসাবে তিনি ষাটের দশকের মধ্যভাগে মাসুদ রানা নামক গোয়েন্দা চরিত্রকে সৃষ্টি করেন। এর কিছু আগে কুয়াশা নামক আরেকটি জনপ্রিয় চরিত্র তার হাতেই জন্ম নিয়েছিলো। কুয়াশা চরিত্রটি নিয়ে কাজী আনোয়ার হোসেন প্রায় ৭৬ টির মতো কাহিনী রচনা করেছেন। কাজী আনোয়ার হোসেন ছদ্মনাম হিসেবে বিদ্যুৎ মিত্র ও শামসুদ্দীন নওয়াব নাম ব্যবহার করে থাকেন। তাঁর পুরো নাম কাজী শামসুদ্দিন আনোয়ার হোসেন। ডাক নাম ‘নবাব’। তাঁর পিতা প্রখ্যাত বিজ্ঞানী, গণিতবিদ ও সাহিত্যিক কাজী মোতাহার হোসেন, মাতা সাজেদা খাতুন। ১৯৫২ সালে সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর জগন্নাথ কলেজ থেকে আইএ ও বিএ পাস করেন। ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এমএ পাস করেন। পড়াশুনা শেষ হওয়ার পর রেডিওতে তিনি নিয়মিত গান গাইতে শুরু করেন। নিয়ম মাফিক কোনো প্রশিক্ষণ না নিলেও বাড়িতে গানের চর্চা সবসময় ছিলো। তাঁর তিন বোন সানজীদা খাতুন, ফাহমিদা খাতুন ও মাহমুদা খাতুন এখনও রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত। তিনি ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ঢাকা বেতারের সঙ্গীত শিল্পী ছিলেন। ১৯৬৩ সালের মে মাসে বাবার দেয়া দশ হাজার টাকা নিয়ে সেগুনবাগিচায় প্রেসের যাত্রা শুরু করেন। আট হাজার টাকা দিয়ে কেনেন একটি ট্রেডল মেশিন আর বাকিটাকা দিয়ে টাইপপত্র। দুজন কর্মচারী নিয়ে সেগুনবাগান প্রেসের শুরু, যা পরবর্তীকালে নাম পাল্টে হয় সেবা প্রকাশনী। পরবর্তীতে তাঁর প্রকাশনা সংস্থা বাংলাদেশে পেপারব্যাক গ্রন্থ প্রকাশ, বিশ্ব সাহিত্যের প্রখ্যাত উপন্যাসের অনুবাদ এবং কিশোর সাহিত্যের ধারাকে অগ্রসর করার কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। ১৯৬৪ সালের জুন মাসে প্রকাশিত হয় কুয়াশা-১, যার মাধ্যমে সেগুনবাগান প্রকাশনীর আত্মপ্রকাশ ঘটে। কাজী আনোয়ার হোসেনের এক মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে। তাঁর মেয়ে শাহরীন সোনিয়া একজন কন্ঠশিল্পী। বড় ছেলে কাজী শাহনূর হোসেন এবং ছোট ছেলে মায়মুর হোসেন লেখালেখির এবং সেবা প্রকাশনীর সাথে জড়িত। মাঝে ১৯৬৯-৭০ সালের দিকে সাংবাদিক রাহাত খানের অনুপ্রেরণায় রহস্যপত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা নেয়া হয় এবং পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৭০ সালের নভেম্বরে। চারটি সংখ্যা বের হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের সময় পত্রিকাটির প্রকাশনা স্থগিত রাখা হয়েছিলো। স্বাধীনতার পর সবাই বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে পত্রিকাটি প্রকাশ সম্ভব হচ্ছিলো না। এরপর ১৯৮৪ সালে রহস্যপত্রিকা আবার প্রকাশিত হয়। আজ পর্যন্ত তা অব্যাহত রয়েছে। ১৯৭৪ সালে মাসুদ রানা’র কাহিনী নিয়ে বাংলাদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয় (মূল ভুমিকায় ছিলেন সোহেল রানা)। বাংলাদেশের টিভি নাটকের ইতিহাসে প্রথম প্যাকেজ নাটক প্রাচীর পেরিয়ে’র কাহিনী রচনা করা হয় কাজী আনোয়ার হোসেন রচিত মাসুদ রানা সিরিজের পিশাচ দ্বীপ নামক বই থেকে। ১৯৯৪ সালে প্রচারিত নাটক প্রাচীর পেরিয়ের নির্দেশক ছিলেন আতিকুল হক চৌধুরী। ঐ নাটকের প্রধান দুটি চরিত্রে ছিলেন বিপাশা হায়াত ও নোবেল।