Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

নারীর হাতে আলোর মশাল

মামুনুর রহমান

বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় ক্রিকেট দলের শুরু থেকেই আছেন জাহানারা। দেশের ক্রিকেটের উর্বর ভূমি খুলনায় জন্ম তাঁর। স্কুলের পড়ালেখার ফাঁকে ভলিবল ও হ্যান্ডবলের নিত্যদিনের খেলোয়াড় ছিলেন। শারিরিক ভাবে ফিট থাকায় দৌড়াদৌড়িটাও ভালো পারেন ছোট থেকেই। ক্লাস সিক্সে থাকা অবস্থায়ই স্কুলের ভলিবল দলে খেলা শুরু হয় তাঁর। ২০০৪ সালে স্কুলের হয়েই খেলেছেন মহিলা ফুটবল। তার জীবনের গল্প শুনি।
আমি নিজেকে অনেক সৌভাগ্যবান মনে করি। আমি বাংলাদেশ মহিলা জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে পারছি। এটা নিশ্চয়ই আমার পরিশ্রমের ফসল এবং আল্লাহ্র বিশেষ রহমত। দেশের হয়ে এরই মধ্যে ৩৭টি ম্যাচ খেলা হয়েছে আমাদের। তবে এতো গুলো ম্যাচের মধ্যে গত ম্যাচটা যেটা পাকিস্তানের সাথে হয়েছিল সেটিই বিশেষ ভাবে মনে করতে পারছি। কারণ সেই ম্যাচটি জেতা আমাদের জন্য জরুরি ছিল। র‍্যাংকিং এ এগিয়ে আসার ম্যাচ ছিল সেটি। সেই ম্যাচটাতে জয় পাবার পর এখন আমরা বিশ্বের ৮ নং র‍্যাংকিং এর দল এক দিনের ক্রিকেটে। ২০০৭ সালে আমি ক্রিকেট খেলা শুরু করি। খুলনায় মহিলা দলের বাছাই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। যেহেতু আমি অন্যান্য খেলা গুলো ভাল খেলতাম, আমার ফিটনেসটা খুব ভালো তখন থেকেই। দৌড়াদৌড়িটাও খুব ভালো পারতাম। সে দিক থেকেই পায়ে বল নিয়েও টুর্নামেন্ট খেলেছি। আর তারপর হাতে বল নিয়ে মিডিয়াম পেসার হয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছি। আর এটাই সত্যি হুট করেই কিন্তু পেস বোলিং এ আসা। বলতে পারেন প্রি প্লান ছাড়াই।
ক্রিকেটার না হলে কি হতেন? এই প্রশ্নের জবাবে জাহানারা বললেন, আমি ক্রিকেটার না হলে শেফ হতাম। তবে এখানেও একটা মুশকিল আছে শেফরা সব ধরনের রান্না পারেন। আমি কিন্তু বাঙালী রান্না ছাড়া অন্য রান্না তেমন পারি না। সাথে দু একটা ইন্ডিয়ান ও চাইনিজ জানা আছে। তাই আসলেই বলা মুশকিল শেফটাও কি ভালো হতে পারতাম কি না।
অনুপ্রেরণার প্রশ্নে জাহানারা জানালেন, আমি আসলে অনুপ্রেরণা ছাড়াই ক্রিকেটার হয়েছি। আগেই বলেছি হুট করে খেলার জগতে আসা। হুট করেই ক্রিকেটে আসা। আর হুট করে অলরাউন্ডার হতে পারা। খুলনা জেলা ও বিভাগের জন্য বিভিন্ন খেলায় অংশ নেয়ার জন্য বিভাগীয় পর্যায়ে বিভিন্ন খেলায় অংশ নেয়ার জন্য আমাকে বলা হলো তুমি কি ক্রিকেট খেলতে চাও? আর প্রশ্নটা এলো আমার শ্রদ্ধেয় সালাউদ্দিন স্যারের কাছ থেকে। তিনিই সে সময় ক্রিকেট বোর্ডের কোচ। খুলনা ডিভিশনের জন্য দল গঠন করবেন। আমিও রাজি হয়ে গেলাম। ঝুলিতে এরই মধ্যে নিয়েছেন শত উইকেটেরও বেশি, কেমন লাগে? জাহানারা এবারে উদযাপনের সুরে নেই। বললেন, ভিন্ন কথা। আমি আসলে বিষয়টি অন্য ভাবে ভাবি। ওডিআই এবং টি২০ মিলিয়ে যে কয়টি উইকেট আমি পেয়েছি তা যদি আলাদা আলাদা ডিপার্টমেন্টে শত কিংবা তার বেশি হতো তাহলে হয়তো উদযাপন করার বিষয়টি নিয়ে ভাবতাম। আনঅসিফিয়ালি ২০০৮ সালে হংকং এর বিরুদ্ধে আমার ডেব্যু হয়। যদিও আইসিসির কোন র‍্যাংকড ম্যাচ ছিল না সেটা। তবে আমার আন্তর্জাতিক ম্যাচ বলেই আমি মনে করি। সেদিনের কথা আমার আজও মনে আছে ৪৭ ওভারে প্রথম আমাকে বোলিং এ আনা হয়। হংকং এর তিন উইকেট বাকি ছিল। আমার জীবনের প্রথম ম্যাচ আর প্রথম ওভার। আরও বিস্ময়কর সেই ওভারেই পরপর তিন বলে তিন উইকেট। হ্যাট্রিক। যদিও সেটা আনঅফিসিয়ালি। বোধ করি সেই ম্যাচটাই আমার জায়গাকে শক্ত করে পেস বোলিং এ।


সাবেক এই অধিনায়কের আইডল বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সর্বকালের সেরা অধিনায়ক মাশরাফি বিন মোর্তুজা। বিশ্বের সকল ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের সাথে নিজেদের অবস্থানের জায়গাটায় শুধুমাত্র অভিজ্ঞতার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। বিশ্বের অন্যান্য দেশ গুলো যত গুলো ম্যাচ এক বছরে খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ দল সে তুলনায় অনেক কম ম্যাচ পায়। নারী দলের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে চাইলে বছর জুড়ে বিশ্বের পরাশক্তি গুলোর সাথে খেলা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। আরেকটি দূর্বল দিক তিনি দেখতে পান তা হলো ব্যাটিং এর ক্ষেত্রে সঠিক এক্সিকিউশন। তবে এক্সিকিউশনেও আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। তার প্রমান ২০১৮ সালের এশিয়া কাপের ব্যাটিং। সেই সিরিজে আসলেই আমাদের এক্সিকিউশন সঠিক ছিল। আর বোলিং ফিল্ডিংএ আমরা কারো থেকে কম নেই। শেষ কথায় বলতে চাই, আমি আমার কাজটি করছি, আপনি আপনার কাজটি করুন। আসুন আমরা এক সাথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাই।

জাহানারা আলমরা যে পথে হাঁটছেন তাদের দেখে যারা ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহী হয়ে এগিয়ে আসছেন তাদেরই একজন ফারিয়া ইসলাম তৃষ্ণা। ইমার্জিং গ্রেড ক্রিকেটার বাংলাদেশ মহিলা দলে সুযোগ পাওয়াটাকে ভাগ্যের বিষয় বলে মনে করেন। ঘরোয়া ক্রিকেটে বেশ কিছু ম্যাচ খেলার পর ইমাজিং দলে ডাক পান। দেশের বাইরে দুই বার ট্যুর করার সুযোগ হয়েছে। একটি ম্যাচ খেলার সুযোগে ভালো পারফর্ম করেন। স্বপ্ন দেখেন বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দল অনেক বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ জিতবে। গ্রাউন্ডস, কোচ এবং ফ্যাসিলিটিজ এমন প্রশ্নে তৃষ্ণা জানালেন, সব মিলিয়ে ভালো ভাবেই আমাদের প্রাকটিস সেসন চলছে। বিসিবি’র ফ্যাসিলিটি বেশ কেয়ারিং। ওয়েল বিহেভ্ড। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই ভালো সাউড উইকেট ও মাঠ সুবিধা রয়েছে আমাদের।কোচিং স্টাফ, ম্যানেজমেন্ট সবই অসাধারন। সবাই বেশ কেয়ারিং আমদের প্রতি। বিসিবির একাডেমিতে আসার আগে তিন বছর বি কে এস পিতে থেকেছি। পরিবারের কথা মনে হয় ঠিকই তবে আমাদের বড় আপুরা অসম্ভব কেয়ারিং আমাদের প্রতি। বাড়ির কথা মনেই পড়ে না তেমন একটা। বিনোদনের প্রশ্নে তৃষ্ণা বলেন, আমাদের বিনোদনটা একেবারে অন্যরকম। প্রাকটিস শেষে পৃথিবীর অন্যান্য ক্রিকেটারদের খেলার স্টাইল, ফুট ওয়ার্ক, শক্তি, এগুলো নিয়ে কথা বলাই বিনোদন। আমরা গান করি, গল্প করি। সবই কিন্তু ক্রিকেটকে নিয়ে। যেমন একটা পরিবারে হয়। আমরা এখন একটা পরিবার। সবাই সবার খেয়াল রাখি। তাই পরিবার ছেড়ে একাডেমিতে আছি এমনটা মনেই হয় না।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলের যত অর্জন আইসিসি মহিলা বিশ্ব টি২০ বাছাই পর্ব।
২০১৫ রানার্স আপ (উত্তীর্ণ)
২০১৮ চ্যাম্পিয়ন (উত্তীর্ণ)
২০১৯ চ্যাম্পিয়ন (উত্তীর্ণ)
আইসিসি মহিলা বিশ্ব টুয়েন্টি ২০
২০১৪ প্রথম রাউন্ড
২০১৬ প্রথম রাউন্ড
২০১৮ প্রথম রাউন্ড
মহিলা ক্রিকেট বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব
২০১১-৫ম
২০১৭-৫ম
মহিলা এশিয়া কাপ
২০০৮ সাল থেকে খেলা শুরু করে বাংলাদেশ নারী দল। ২০০৮ এ গ্রুপ পর্বের পর এগুতে পারেনি টিম টাইগ্রেসরা। ২০১২ তে এসে চমৎকার নৈপুন্যে সেমিফাইনালে এসে সব ওলোট পালোট। আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টায় ২০১৬ সালে গ্রুপ পর্বতে থেমে থাকতে হয়। তবে চতুর্থ বারের চেষ্টায় ২০১৮ সালে এশিয়া কাপের চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দল।এছাড়াও রয়েছে মহিলা এসিসি প্রতিযোগিতা যেখানে ২০০৭ সালে বিজয়ী হয় টিম টাইগ্রেস। এশিয়ান গেমস্ ২০১০ ও ২০১৪ এসেছে রৌপ্য পদক। ১৩ বছরের ক্রিকেট জার্নিতে নারী ক্রিকেট দলের এ গৌরব গাঁথা বেশ উজ্জবল। আরও এগিয়ে যাক দেশের ক্রিকেট। আরও এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।