Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

দুঃসময়ে নারীদের কথা শোনার জন্য পাশে কেউ থাকে না-রুবানা হক

রুবানা হক। এক নামে অনেক পরিচয়। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, সৃজনশীল উদ্যোক্তা, কবি ও সাহিত্যিক । মোহাম্মদী গ্রুপের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বিজিএমই এর প্রথম নারী সভাপতি হিসেবে কাজ করছেন। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে পরপর দুবার তিনি কবিতার জন্য সার্ক সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে (পিএইডি) ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। কর্পোরেট জীবনের পাশাপাশি ২০০৬ সাল থেকে বাংলাদেশি লেখকদের সাথে মনসুন লেটারস নামে একটি সাহিত্য ম্যাগাজিন চালিয়ে নিচ্ছেন। ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত রুবানা হক সাউথ এশিয়া টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছেন। সাথে সাথে জাদু মিডিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালকও ছিলেন। নাগরিক টেলিভিশনের কার্যক্রম চূড়ান্ত করতে তাঁর রয়েছে অনন্য ভূমিকা। ঢাকা সিটি উত্তরের মেয়র প্রয়াত আনিসুল হকের স্ত্রী তিনি। সম্প্রতি আনন্দ আলোর মুখোমুখি হয়েছিলেন তিনি…

আনন্দ আলো: কেমন আছেন?

রুবানা হক: আলহামদু লিল্লাহ। ভালো আছি।

আনন্দ আলো: ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। করোনার এই দুঃসময়ে দিবসটি’কে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

রুবানা হক: জাতিসংঘ এবারের নারী দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় করেছে ‘নারীর জন্য সমতা, সকলের অগ্রগতি’। সরকারও জাতিসংঘের সাথে সুর মিলিয়ে করেছে ‘অগ্রগতির মূল কথা, নারী-পুরুষ সমতা’। সম্প্রতি, আইএলও এর এক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, করোনা ভাইরাস এর নেতিবাচক  প্রভাবের কারনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পুরুষদের তুলনায় নারী শ্রমিকদের পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। অনেক নারী শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। অনেকের মজুরি কমে গেছে। ফলে তাদের সম্মান কমে গেছে, অন্যের উপর তাদেরকে নির্ভর করতে হচ্ছে। এই প্রেক্ষাপটে করোনার এই দুঃসময়ে উল্লেখিত প্রতিপাদ্য বিষয় নির্বাচন অত্যন্ত  সময়োচিত ও যৌক্তিক। আমি বিশ্বাস করি, নারী এবং মেয়েদের সমতা অর্জনের বিষয়টি শুধু ন্যায্যতা এবং মানবাধিকারের মৌলিক বিষয় নয়, অন্যান্য ক্ষেত্রের অগ্রগতিও এর উপর নির্ভরশীল।

আনন্দ আলো: দেশে প্রকৃত অর্থে নারীদের অবস্থা কেমন বলে মনে হয়?

রুবনা হক: বিনম্র শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে, যিনি মেয়েদের শিক্ষা গ্রহন ও অর্থনৈতিক মুক্তি  অর্জনকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছিলেন। মেয়েদের শিক্ষাকে অবৈতনিক করার কাজটি তিনিই শুরু করেছিলেন। ৭২ সালের সংবিধানে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন তিনিই করে দিয়েছিলেন। তারই যোগ্য উত্তরসুরী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তার প্রথম মেয়াদে ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর উচ্চ আদালতে প্রথমবারের মতো মহিলা জজ নিয়োগ দেন, বিভিন্ন মন্ত্রনালয়ে একাধিক নারীকে সচিব পদে পদোন্নতি দেন। এমনকি মেয়েদের জন্য কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে প্রাথমিক শিক্ষায় ৬০ ভাগ মেয়েদের জন্য বরাদ্দ করেন। আজ বাংলাদেশের মেয়েরা ব্যবসা-বানিজ্য, প্রশাসনের সর্বত্র, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, বর্ডার গার্ড, আন্তর্জাতিক শান্তি   মিশন, ক্রিয়াঙ্গন সর্বত্রই দক্ষতার সাথে বিচরন করছে। এমনকি যে পোশাক শিল্প জাতীয় অর্থনীতিকে  সমৃদ্ধশালী করছে, সেই শিল্পের সিংহভাহ কর্মীরাই হলেন নারী শ্রমিক। তবে, উদ্বেগের বিষয় হলো, এদেশে  নারীরা এখনও ঘরে-বাইরে, নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীরা পদে পদে বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।

আনন্দ আলো: নারী পুরুষের সমতার কথা বলা হয়। বাস্তবে কি ঘটছে?

রুবানা হক: যদিও সরকারি, বেসরকারি, ব্যক্তিগত এবং যৌথভাবে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগে নারীদের উন্নয়ন এবং ক্ষমতায়নে ব্যাপক  অগ্রগতি  অর্জিত  হয়েছে। তবে বাস্তবতা  হলো,  অর্থনৈতিক  কর্মকান্ডে  এখনও  সমতা নিশ্চিত  হয়নি। বিশ্বব্যাংকের ‘ওমেন, বিজনেস অ্যান্ড দ্য ল’ অনুযায়ী ব্যবসা-বানিজ্য ও কর্মক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় অর্ধেক আইনি সুরক্ষা পাচ্ছেন এদেশের নারীরা। সম্প্রতি, বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভলপমেন্ট (বিল্ড) ও ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) এর পক্ষ থেকেও নারী পুরুষ বৈষম্য ও নারীর সুনির্দিষ্ট প্রতিবন্ধকতা খুঁজে বের করার জন্য একটি গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সেখানে দেখা যায়, আমদানি ও রপ্তানিসংক্রান্ত সনদ সংগ্রহ ও নবায়নে পুরুষ উদ্যোক্তাদের তুলনায় নারী উদ্যোক্তাদের বেশি অর্থ ও সময় ব্যয় করতে হচ্ছে। উন্নত দেশের ২৫ভাগ শিল্প ও বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের কর্নধার  হলেন  নারী। অথচ ইন্টারন্যাশনাল  ফাইন্যান্স  কর্পোরেশন  এর ২০১৬ সালে পরিচালিত এক  গবেষনাপত্রে দেখা যায়, বাংলাদেশে এই হার মাত্র ৭.২ শতাংশ।

আনন্দ আলো: নারীর অগ্রযাত্রায় এখনও কি কোন প্রতিবন্ধকতা চোখে পড়ে?

রুবানা হক: অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় নারীরা প্রতিনিয়ত প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছেন। ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের কর্নধার হতে গেলে তাদেরকে যে প্রতিবন্ধকতাগুলো মোকাবেলা করতে হয়, সেগুলো হলো পারিবারিক ও সামাজিক সমর্থনের অভাব; অর্র্থায়নের সমস্যা; হয়রানির আশঙ্কা এবং নারীদের সামর্থ্য বিষয়ে সমাজের অনুদার দৃষ্টিভঙ্গি। ব্যবসায় নামতে হলে ঋণের প্রয়োজন। আর ঋণ পেতে পদে পদে হয়রানির শিকার হন নারী উদ্যোক্তারা। জামানত, গ্যারান্টার এবং স্থায়ী ব্যবসাসহ নানা নথিপত্র  এর শর্তজালে ফেলে তাদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক শাখায় নারী এসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা ডেস্ক থাকার কথা থাকলেও তা নেই। এসএমই ঋণের ১৫ শতাংশ নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিতরনের নির্দেশ থাকলেও এর অর্ধেকও নারীরা পাচ্ছেন না। ফলে, বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তারা উঠে আসতে পারছেন না।

আনন্দ আলো: আপনি দারুণ ব্যস্ত সময় কাটান! তবুও তো অবসর খুঁজে নেন। আপনার বিনোদন কি?

রুবানা হক: আমার তিনটি সন্তান। ওরাই আমার সবচেয়ে বড় বিনোদন। অবসর পেলে বিভিন্ন বিষয়ের উপর লেখালেখি করি, কবিতা পড়ি। আমার একটি কবিতার বই আছে, টাইম অফ লাইফ। ভবিষ্যতে আরও কিছু কবিতার বই বের  করার পরিকল্পনা আছে। অবসর সময়ে ভাবি, নারীদের জন্য কোন কোন জায়গায় কাজ করার সুযোগ আছে। নারীদের দুঃসময়ে তাদের কথা শোনার মতো পাশে কেউ থাকে না। তাই নারীদের জন্য ‘শি ফর শি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান করেছি। এই প্রতিষ্ঠানটি’কে কিভাবে আরও বড় প্লাটফর্মে আনা যায়, সেটি নিয়েও ভাবছি।

আনন্দ আলো: টেলিভিশন নাটক দেখেন? সার্বিক অবস্থা কেমন?

রুবনা হক: ব্যস্ততার কারনে সেভাবে টেলিভিশন নাটক দেখা হয় না। কদাচিৎ দেখি। তবে মানসম্মত নাটক এখন কম হচ্ছে। ভালো গল্পের অভাবে নাটকগুলো বিশেষ করে সিরিয়ালগুলো সেভাবে দর্শকদের মন জয় করতে পারছে না। চাহিদা থাকা সত্ত্বেও খন্ড নাটক কম পরিমাণে নির্মিত হচ্ছে।

আনন্দ আলো: চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার ভাবনা কি? শেষ কবে সিনেমা দেখেছেন তার নাম কি?

রুবানা হক: এ মুহুর্তে মনে করতে পারছি না শেষ কবে সিনেমা দেখেছি। আমি মনে করি, আমাদের চলচ্চিত্রর অনেক সমৃদ্ধশালী। সারেং বউ, গোলাপী এখন ট্রেনে, মনপুরা এর মতো চলচ্চিত্র এদেশে নির্মিত হয়েছে। আমার মনে হয়, সাহিত্য নির্ভর চলচ্চিত্রের দিকে আমাদের মনোযোগ দেয়াটা জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারী অনুদান বিশেষ ভুমিকা রাখতে পারে।

আনন্দ আলো: অনেকে বলেন যার বন্ধু ভাগ্য ভালো, সেই সবচেয়ে সুখী। আপনার কাছে বন্ধুত্ব কি?

রুবানা হক: বন্ধুত্ব টিকে থাকে কিসে? জীবনে একা চলা যায় না। হেসেখেলে জীবনে চলার পথে বন্ধুসঙ্গ অত্যন্ত জরুরি। বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে বয়স, ধর্ম বা বাঁধাধরা নিয়মনীতি নেই। দু’জন বন্ধুর মধ্যে মতের অমিল থাকতেই পারে। তবে তা যেন বন্ধুত্ব নষ্ট না করে দেয়। বন্ধুত্বের আঙ্গিনায়  যতই  আবর্জনা  জমুক না কেন, তা পরিস্কার করে রাখার দায়িত্ব দুজনেরই। সেখানে দু’বন্ধুর সুখ দুঃখের গল্পগুলো থরে থরে সাজানো থাকবে। আর সময়ে সময়ে চলবে সেগুলোর রোমন্থন।

আনন্দ আলো: পরিবার আপনার কাছে কি? পরিবার টিকে থাকার মূল মন্ত্র কী?

রুবানা হক: পরিবার একটি বড় শক্তি। যে কোন সংকটে পরিবার যে শক্তি দেয়, তা আর কোথাও থেকে আসে না। আমি এ বয়সে এসেও ভাইবোন খুঁজি সবার মধ্যে। পরিবার টিকে থাকার মূলমন্ত্রই হলো পরিবারের সদস্যদের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা, তাদের মধ্যে কোন ধরনের দূরত্ব না থাকা। বটম লাইন হলো কোন পরিস্থিতিতেই পরিবার ছেড়ে বের হওয়া যাওয়া যাবে না। আজ আমাকে সবাই উদ্যোক্তা হিসেবে চেনেন। তবে আমি নিজেকে প্রথমত একজন মা বলেই মনে করি। তারপর ব্যবসায়ী। আমার ৩টি সন্তানই বড় হয়ে গেছে। তারপরও আমি সুযোগ পেলেই এখনও ওদেরকে জড়িয়ে ধরি, ওদের সাথে সবকিছু শেয়ার করি। অনেক সময় বিভিন্ন কাজে সন্তানদের পরামর্শও নেই।

আনন্দ আলো: আপনার ব্যক্তি জীবন ও ব্যক্তি সাফল্যের মূল শক্তিটা কি?

রুবানা হক: আমি খুবই মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে। ১৫ বছর বয়স থেকেই টিউশনি করেছি। লেখাপড়ার জন্য বিদেশে যেতে পারি নাই। যদিও পরে বিদেশে পিএইচডি করেছি। আসলে যে কোন সাফল্যের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন স্বপ্ন দেখা, মনের ভেতরের ইচ্ছেটি’কে লালন করা। প্রথম জীবনে শিক্ষকতা করেছি। পরে ব্যবসায়ে এসেছি। তবে, লক্ষ্যনীয় বিষয় হলো, প্রতিটি কাজেই আমি পরিবারের নিরন্তর সহযোগিতা পেয়েছি। আমার পরিবারই আমার সকল সফলতার মূলশক্তি।

আনন্দ আলো: তরুনদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?

রুবানা হক: তরুনদের জন্য আমার প্রথম পরামর্শ হলো স্বপ্ন দেখোÑ স্বপ্ন দেখা বন্ধ করো না। আর স্বপ্নটি এমন হবে, যেটি ঘুমাতে দিবে না, জাগিয়ে রাখবে। আমার প্রয়াত স্বামী আনিস বলতো, মানুষ তার স্বপ্নের চেয়েও বড়। আমিও তাই বিশ্বাস করি। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ন বিষয় হলো টাইম ম্যানেজমেন্ট। এটি খুবই জরুরি। মাথাকে কম্পার্টমেন্টালাইজড করতে হবে। সময়ের কাজ সময়ের মধ্যেই শেষ করতে হবে। আর যে কাজই করো না কেন, সে কাজের জন্য তোমার শতভাগ ভালোবাসা, নিষ্ঠা আর আন্তরিকতা থাকতেই হবে। তাহলেই তুমি সফল হবে।