Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

নূসরাত জাহানের স্থাপত্য ভুবন!

নূসরাত জাহান। বাংলাদেশের একজন স্বনামধন্য স্থপতি। দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে বাংলাদেশের স্থাপত্য অঙ্গনে দৃপ্ত পদাচারনা তার। দেশপ্রেম, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে স্থাপত্য শিল্পে সৃষ্টিশীল কাজ করে চলেছেন। ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৯৬ সালে তিনি গড়ে তোলেন আর্কিটেকচার ইন্টেরিয়র ডিজাইন (আর্ক. ইন. ডি) নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। পাশাপাশি তিনি এহসান খান আর্কিটেক্টস লিমিটেড এর একজন ডিরেক্টর হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এযাবৎ তিনি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। তিনি বাংলাদেশ স্থপতি ইন্সটিটিউট এর একজন সদস্য। এবার শাহ্ সিমেন্ট সুইট হোমে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক
স্থাপত্য শিল্পে এ দেশের নারীদের অবদান কোনো অংশেই কম নয়। এর উৎকৃষ্ট উদাহরন স্থপতি নূসরাত জাহান। একসময় মনে করা হতো নারীরা শুধুমাত্র অফিসিয়াল কাজ আর ঘর সংসার সামলাবে। সে ধারনাকে ভুল বলে প্রমান করেছেন তিনি। নারী বা পুরুষ নয়। দক্ষতা, মেধা ও যোগ্যতা থাকলে যে কেউ ভালো কাজ করতে পারে এর জ্বলন্ত উদাহরণ নূসরাত জাহান। ইট, কাঠ, বালু, কংক্রিটের মাঝেই তিনি খুঁজে ফেরেন প্রকৃতির সান্নিধ্য। সবুজের ছোঁয়া। আলো, বাতাস, গাছ, প্রকৃতিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন।
দুই ভাই এক বোনের মধ্যে সর্বকনিষ্ট আর্কিটেক্ট নূসরাত জাহান। তার গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুর জেলায়। কিন্তু তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা ঢাকায়। নূসরাতের বাবার নাম নাজমুল হক। তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক পরিচালক ছিলেন। মা নূরজাহান বেগম গৃহিনী। নিজেকে গড়ে তোলার পিছনে বাবা-মার অবদান ছিল বেশি। ছোটবেলা থেকেই ড্রইং এর প্রতি ছিল তার প্রচন্ড নেশা। ছবি আঁকাআঁকিতে জল রং ব্যবহার করতেন। ওয়েল পেইন্টিং করতেন। এইচএসসি পড়ার সময় একদিন বুয়েটের সাবেক ভিসি মরহুম স্থপতি খালেদা রশীদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়। তার কাছ থেকেই নূসরাত ড্রইং, প্রকল্প পরিকল্পনা এবং স্থাপত্য বিষয়ে ধারণা পান। স্থপতি খালেদা রশীদের অনুপ্রেরনায় স্থাপত্যের প্রতি তার আগ্রহ জন্মায়। সেই আগ্রহ থেকে আজ তিনি হয়েছেন সফল একজন স্থপতি।
শহীদ আনোয়ার গার্লস স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন ১৯৮৪ সালে। ১৯৮৬ সালে হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। ওই সময় প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মাত্র ছাত্রী হল ছিল। নূসরাত তার পরিবারের সাথে বনানীর বাসা থেকে ক্লাস করতেন। ১৯৮৮ সালের শেষ দিকে স্বৈরাচার বিরোধী তুমুল আন্দোলনে এবং সারাদেশে ভয়াবহ বন্যার কারনে ক্লাস শুরু হতে দেরি হয়। লম্বা সেশনজট শেষে ১৯৯৫ সালে তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করেই তিনি একটি বড় প্রকল্পের কাজ করার সুযোগ পেয়ে যান। বারিধারায় ‘ইউনিক লেক ভিউ’ নামের একটি ছয় তলা ভবনের কাজের অনুমোদন পান।
১৯৯৬ সালে তিনি গড়ে তোলেন আর্কিটেকচার ইন্টেরিয়র ডিজাইন (আর্ক.ইন.ডি) নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। ইতিমধ্যে তিনি দেশের নামকরা হোটেল, কমার্শিয়াল বিল্ডিং, অফিস বিল্ডিং, রেসিডেন্সশিয়াল বিল্ডিং সহ বিভিন্ন ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। আর্ক.ইন.ডি প্রতিষ্ঠানের হয়ে তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছেÑ বারিধারায় ইউনিক লেক ভিউ, ইউনিক পার্ক ভিউ, এলিফেন্ট রোডে মাল্টিপ্লান সেন্টার, কাওরানবাজার এ হোটেল লা ভেঞ্চি, বনানীতে ইউনিক ওভাল, গ্রীনরোডে মাল্টিপ্লান গ্রীন ভিলা, সিলেট-এ মাল্টিপ্লান শাহজালাল সিটির মাস্টার প্লান ও ডিজাইন, গুলশান এভিনিউতে খন্দকার টাওয়ার, বনানীতে ইউনিক মেহনুর, কাওরান বাজারে বোরাক জহির টাওয়ার ইত্যাদি। ইন্টেরিয়র কাজের মধ্যে রয়েছেÑ সিলেটে ইন্টারন্যাশনাল হোটেল রোজ ভিউ এর ইন্টেরিয়র, কক্সবাজারে হোটেল সীগাল এর ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন, গুলশান-২ এ ইউনিকলো হেড অফিসের ইন্টেরিয়র, মারুবেনী হেড অফিসের ইন্টেরিয়র, কাওরান বাজারের মিৎসুবিশি হেড অফিসের ইন্টেরিয়র ইত্যাদি। এহসান খান আর্কিটেক্টস লিমিটেড এর হয়ে তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছেÑ টাংগাইল সখিপুরে সী গাল স্পা ভিলেজ, পূর্বাচলে এশিয়ান ডুপলেক্স বিল্ডিং ইত্যাদি।

ইন্টেরিয়র ডিজাইনের মধ্যে রয়েছেÑ গুলশান-২ এ আমারি ঢাকা’র ইন্টেরিয়র, গুলশান-২ এ এবং বনানীতে নান্দোস এর ইন্টেরিয়র, গুলশান-২ এম জিএইচ গ্রপের ইন্টেরিয়র, সিঙ্গাপুর এয়ার লাইনস কার্গো অফিসের ইন্টেরিয়র, তেজগাঁও-এ মেঘনা গ্রæপ হেড অফিসের ইন্টেরিয়র, শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট এ স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক লাউঞ্জ এর ইন্টেরিয়র সহ অনেক ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন।
এছাড়া বর্তমানে তিনি বেশ কিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন। ১৯৯৫ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্বামীর নাম এহসান খান। তিনিও একজন স্বনামধন্য স্থপতি। এহসান খান আর্কিটেক্টস লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান আছে তাদের। এই দম্পতি দুই সন্তানের জনক-জননী। বড় মেয়ে আনিশ্তা সামরিন খান ও ছোট মেয়ে সেহিনতা সাবিন খান। স্বামী এবং তার পরিবারের সকলের অসম্ভব সহযোগিতা ছিল বলেই নূসরাত স্থাপত্য চর্চা করে যাচ্ছেন।
স্থপতি নূসরাত জাহান বলেন, স্থাপত্য শিল্প নানান উপকরণের একটি পরিপূর্ণ বিন্যাস। একজন ফাংশনালিস্ট হিসেবে আমি এ সকল উপকরনকে নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বোঝার চেষ্টা করি। যেমনÑ বিভিন্ন দিক থেকে আপতিত সূর্যের আলোর ইফেক্ট, ইট পাথরের দেয়ালে গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদের বিপরীত ধর্মী সামঞ্জস্যতা এবং এই উপকরণ সমূহ যেভাবে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে তাতে গুরুত্বারোপ করে থাকি। আমি বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পেক্ষাপটে এই বিষয় গুলোকে উপস্থাপন করার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু, প্রকৃতিকে ঠিক রেখে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের ডিজাইনের দিকে নজর দেন স্থপতি নূসরাত জাহান। এই স্থপতি নিজের কাজ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে ভালোবাসেন। নিজের পেশার কাছে দায়বদ্ধ থেকে সেটাকে সততার সাথে শেষ করতে চান। বর্তমানে এই স্থপতি আধুনিক স্থাপত্যচর্চার সাথে নিজেকে যুক্ত রেখে নতুন প্রজন্মের স্থপতিদের পথ প্রদর্শক হিসেবে কিছু করে যেতে চান।