Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

বসন্ত এসে গেছে-মুকিত মজুমদার বাবু

‘অভিব্যক্তির ইতিহাসে মানুষের একটা অংশ তো গাছপালার সঙ্গে জড়ানো আছে। কোনো এক সময়ে আমরা যে শাখামৃগ ছিলাম, আমাদের প্রকৃতিতে তাহার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। কিন্তু তাহারও অনেক আগে কোনো এক আদিযুগে আমরা নিশ্চয়ই পাখী ছিলাম, তাহা কি ভুলিতে পারিয়াছি? সেই আদিকালের জনহীন মধ্যাহ্নে আমাদের ডালপালার মধ্যে বসন্তের বাতাস কাহাকেও কোনো খবর না দিয়া যখন হঠাৎ হু হু করিয়া আসিয়া পড়িত, তখন কি আমরা প্রবন্ধ লিখিয়াছি না দেশের উপকার করিতে বাহির হইয়াছি? তখন আমরা সমস্তদিন খাড়া দাঁড়াইয়া মূকের মতো মূঢ়ের মতো কাঁপিয়াছি; আমাদের সর্বাঙ্গ র্ঝর্ঝ র্মর্ম করিয়া পাগলের মতো গান গাহিয়াছে; আমাদের শিকড় হইতে আরম্ভ করিয়া প্রশাখাগুলোর কচি ডগা পর্যন্ত রসপ্রবাহে ভেতরে ভেতরে চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছে। সেই আদিকালের ফাল্গুন-চৈত্র এমনতরো রসে-ভরা আলস্যে এবং অর্থহীন প্রলাপেই কাটিয়া যাইত…।’ বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বসন্তযাপন’-এ এভাবেই ফুটে উঠেছে প্রকৃতির সঙ্গে বসন্তের নিবিড় সম্পর্কের কথা। মূলত প্রকৃতির সঙ্গেই মানুষের বন্ধন জন্ম-জন্মান্তরের। প্রকৃতির কোলেই যুগ যুগ ধরে মানুষ হয়ে আসছে লালিত-পালিত। প্রকৃতির অমৃতসুধা পান করেই পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকে প্রাণ। প্রকৃতিই দান করে মানুষের মনুষ্যত্বকে, তার শিক্ষাকে। অবলীলায় তাই স্বীকার করতেই হবে আমরা প্রকৃতিরই সন্তান। প্রকৃতির ভালো-মন্দের সঙ্গে আমাদের রয়েছে গভীর যোগসূত্র। প্রকৃতি রুগ্ন, রুক্ষ, বৈরী থাকলে তার প্রভাবে প্রভাবিত হই আমরা। প্রকৃতি শান্ত, ¯িœগ্ধ, রঙিন থাকলে মানুষের মনেও ছড়িয়ে যায় সেই শান্ত রঙিন ¯িœগ্ধতা। ষড়ঋতুর এ দেশে প্রকৃতির হাত ধরে চালিত হয় মানবপ্রকৃতি। গ্রীষ্মের খরতাপে যেমন পুড়ে অঙ্গার হয় প্রকৃতি, তেমনি অঙ্গার হয় মানুষের মন ও শরীর। ঘনঘোর বরষায় যখন চারদিকে বৃষ্টির আঁধার নামে তখন মানুষের মনও খুঁজে ফেরে সেই ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। মাঠে মাঠে সোনালি ধানের হাসির ঝিলিকের সঙ্গে যোগ হয় কৃষকের হাসি। হেমন্তের স্বচ্ছতা, ¯িœগ্ধতা আর রাতের চাঁদের মিষ্টি আলো মানুষের মনকে নিয়ে যায় অন্য দেশে, অন্য ভুবনে। শীতের হিমেল দাঁতের কামড় যখন প্রকৃতির গায়ে লাগে; প্রকৃতি তখন নিজেকে গুটিয়ে নেয়, ঠিক মানুষও তাই। এরপর আসে বসন্ত। ঋতুরাজ বসন্ত। বারো মাসের ফাল্গুন-চৈত্র। ষড়ঋতুর শেষ ঋতু। চারপাশের নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় দোলে দেহমন। প্রকৃতির উৎফুল্লতা আর রঙবাহারি ফুল ফুটলে মানব প্রকৃতিও হয়ে ওঠে চঞ্চল। প্রকৃতিতে বসন্ত বিরাজ করে রঙে রঙিন হয়ে, রঙের পরশ বুলিয়ে। সাপের মতো প্রকৃতি তার খোলস বদলায়। পুরনো পাতা ঝেড়ে ফেলে নতুনত্বে নিজেকে সাজায় অপরূপ সাজে। কচিপাতার উঁকিঝুঁকি পেরিয়ে গাঢ় সবুজে ভরে ওঠে গাছপালা। তার সঙ্গে যোগ হয় রঙবাহরি নানা প্রজাতির ফুল। পলাশ-শিমুলের রক্তিম আভা রাঙিয়ে তোলে চারপাশ। এর সঙ্গে যোগ হয় কয়েক প্রজাতির গাঁদা। আমের মুকুলের ঘ্রাণ চারপাশকে করে তোলে উতলা। শুধু আমের মুকুলে ভ্রমরের গুঞ্জন নয়, বসন্তদিনের প্রকৃতিতে রঙের আল্পনা এঁকে দিয়ে যায় অর্জুন, অপরাজিতা, বকুল, অশোক, আকন্দ, আলোকলতা, কাঁঠালীচাঁপা, কুরচি, গুলঞ্চ, জংলী বাদাম, শিমুল, শিরীষ, মুচকুন্দ, মেহেদি, রক্তকরবী, পলাশ, তমাল, ভাঁটফুল, মহুয়া, নাগকেশর, নিম, মাধবীলতা, পাদাউক, পারুল, পিয়ালসহ আরো অনেক অনেক ফুল। বর্ণিল পাখা মেলে দিয়ে ফুলে ফুলে মনের আনন্দে ঘুরে বেড়ায় প্রজাপতি। প্রকৃতির সঙ্গে যোগ হয় কোকিলের কুহু কুহু ছন্দতোলা ঢেউ জাগানিয়া উচ্ছ¡াস, দিগন্ত বিস্তৃত বোরো ধানের গাঢ় সবুজ ক্ষেত, গানের পাখি ‘বউ কথা কও’ -এর সুমধুর সুর, লতাগুল্মের পত্রপুষ্পে সুশোভিত সৌন্দর্যই মিটিয়ে দেয় মনের ক্ষুধা। বাংলা হয়ে ওঠে সোনার বাংলা, রূপসী বাংলা।

প্রকৃতির বসন্ত মানব প্রকৃতিকেও রাঙিয়ে তোলে বিত্ত-বৈভব দিয়ে। শীতের আড়ষ্টতা ভেঙে প্রকৃতি যেমন প্রাণ ফিরে পায় তেমনি বসন্তে মানবপ্রকৃতি উতলা হয়ে ওঠে বর্ণিল এক ফুরফুরে অনুভূতিতে। অপ্রতিরোধ্য যৌবন ফিরে আসে প্রাণ-প্রকৃতিতে। পুরনোকে ঝেড়ে ফেলে নতুনের মোড়কে জেগে ওঠে প্রাণ। তাই বসন্ত হয়ে ওঠে সবার প্রিয় ঋতু। ভালোবাসার ঋতু। কাছে আসার ঋতু।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন