মা ছেলের যুগলবন্দী ভাবনা

‘এইসব দিন রাত্রি’ ধারাবাহিক নাটকে শাহানা চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করে যিনি দর্শকের হৃদয়ে দাগ কেটেছিলেন তিনি হলেন শিল্পী সরকার অপু। অভিনয়ের আয়নায় আমরা যখন তাকে দেখি তখন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় মনটা ভরে উঠে। তার স্বামী নরেশ ভ‚ইয়া একজন বিশিষ্ট অভিনেতা ও পরিচালক। শিল্পী সরকার অপুর অভিনয়ের মতোই উজ্জ্বল উচ্ছ¦ল তার ছেলে ইয়াস রোহান। মা-ছেলেকে আনন্দ আলো একদিন মুখোমুখি বসিয়েছিল। ব্যস জমে গেল মা-ছেলের আড্ডা। সেই প্রাণবন্ত আড্ডার বয়ান নিয়ে এই প্রতিবেদন। লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক

আনন্দ আলো: মা শিল্পী সরকার অপু এবং ছেলে ইয়াস পরস্পরের কাছে কে কেমন?

শিল্পী সরকার অপু: ইয়াস খুবই ঘরোয়া একটা ছেলে। কোনো হৈ হুলে­াড় করে না। বাবা-মায়ের প্রতি অনেক যতœশীল। আজকাল এরকম ছেলে দেখাই যায় না। এজন্য আমি খুবই ভাগ্যবান। ও অনেক সহজ-সরল ছেলে। আমি মাতৃত্ব স্নেহ দিয়ে ওকে আগলে রেখেছি। মা ছেলে দুজনই একই প্রফেশনে আছি।

ইয়াস রোহান: আমার মা পৃথিবীর সেরা একজন মা। আমরা পরস্পর দু’জন খুব ভালো বন্ধু। সব কিছু শেয়ার করা যায় এ রকম একটা সর্ম্পক আছে আমাদের মধ্যে। ব্যক্তি হিসেবে মা সচেতন মানুষ, ভালো মানুষ এবং সর্বোপরি একজন মমতাময়ী মা। ঘর সংসার এবং অভিনয় সব কিছু সমান ভাবে সামাল দেন।

আনন্দ আলো: মায়ের শাসন আর ছেলের জ্বালাতনÐ এ সর্ম্পকে কার কী অভিমত?

শিল্পী সরকার অপু: ছেলের জ্বালাতন বলতে নেই। ও সব বুঝে। তবে একটু গা ছাড়া। পড়াশোনা এবং নিজের শরীরের প্রতি যদি আরেকটু যতœবান হতো তবে আমি খুবই খুশি হতাম।  ইয়াম রোহান: মায়ের শাসন তো অবশ্যই চাই। শাসন না করলে তো সামনের দিকে এগোতে পারব না। আমার কোনো কিছুতে ভুল হলে আম্মু বকাঝকা দেয়। বুঝি সেটা আমার ভালোর জন্যই দেয়।

আনন্দ আলো: আপনাদের অভিনয়ে বাবা-মায়ের প্রভাব কতটুকু?

শিল্পী সরকার অপু: পুরোটাই বাবা-মায়ের প্রভাব। আমার বাবা-মা দু’জনই আমার অভিনয়ের ব্যাপারে প্রচন্ড সিরিয়াস ছিলেন। তারা চাইতেন আমি যেন অভিনয় করি। আমাদের বাড়ি ছিল মফস্বল শহরে। সারা বছর আমাদের বাড়িতে একজন গানের টিচার থাকতেন। আমরা পাঁচ বোন, তিন ভাই ছিলাম। বোনেরা কেউ না কেউ গান করতেন, রেওয়াজ করতেন। আর আমি ছোটবেলা থেকেই ভালো নাচ করতাম। কোনো অনুষ্ঠানে নাটক হলে সেখানে অভিনয় করতাম। বোনেরা উৎসাহ দিতেন। অভিনয়ে আসার পেছনে সবচেয়ে বড় অবদান আমার পরিবারের।

ইয়াস রোহান: অভিনয়ে আমার ক্ষেত্রে মায়ের প্রভাব অনেক বেশি। ছোটবেলায় দেখতাম বাবা-মা দুজনই অভিনয় করছেন। বিষয়টি আমাকে অনুপ্রেরণা দিয়েছে। মা আমার অভিনয়ের ব্যাপারে প্রচন্ড সিরিয়াস ছিলেন। তিনি চাইতেন আমি যেন অভিনয় করি। তবে বাবা কখনই চাইতেন না আমি অভিনয় করি। তিনি আমাকে অভিনয় থেকে দূরে সরে রাখতে চাইতেন। কিন্তু মা-বড় ভাই, বৌদি, বোনেরা সবাই আমাকে উৎসাহ দিতেন অভিনয় করার জন্য। অভিনয়ে মা-বাবার প্রভাব আছে বলেই আজকে আমি এতদূর এসেছি।

আনন্দ আলো: বিশিষ্ট অভিনেতা ও পরিচালক নরেশ ভ‚ইয়া আপনাদের পরিবারের প্রধান। একজন স্বামী কিংবা একজন বাবা হিসেবে তিনি কেমন?

শিল্পী সরকার অপু: নরেশ ভ‚ইয়া স্বামী হিসেবে অসম্ভব রকমের দায়িত্বশীল একজন মানুষ। খুবই সৎ। সন্তানদের প্রতি দায়িত্ববোধ, ভালোবাসা অনেক বেশি। সর্বোপরি সে একজন ভালো মানুষ।

ইয়াস রোহান: বাবা হিসেবে তিনি অসাধারণ। শ্রেষ্ঠ বাবা। একজন বাবার ভেতরে যা যা গুণাবলী থাকা দরকার সবকিছুই তার মধ্যে আছে। আমার ফিল্ম মেকিংয়ের খুব শখ ছিল। ফিল্ম মেকিং সর্ম্পকে আমি যতটুকু জেনেছি তার আশি ভাগ বাবার কাছ থেকে শেখা। বাবা অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবেও অসাধারণ। তার তুলনা হয় না।

আনন্দ আলো: ছেলের ভালো মন্দ দিক নিয়ে কিছু বলুন?

শিল্পী সরকার অপু: ইয়াস রোহানের ভালো দিক হচ্ছে ও খুবই লক্ষী একটা ছেলে। ভালো মন্দ যাচাই করার ক্ষমতা ওর মধ্যে আছে। সৃষ্টিকর্তা তাকে অভিনয়ের একটা প্রতিভা দিয়েছেন। ও যেন এটাকে অনুশীলনের মাধ্যমে টিকিয়ে রাখে এবং আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেটাই আমার প্রার্থনা। ওর মন্দ দিক হচ্ছে ও আমার কথা শুনে না। আমি যা বলি সেটা করতে চায় না। শুধু ঘরে বসে থাকবে আর কম্পিউটারে কি জানি বানায়।

আনন্দ আলো: ছেলের কাছে জানতে চাই মায়ের কোন দিকটা সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে?

ইয়াস রোহান: মা অনেক সত্যবাদী। বুদ্ধিমান একজন মানুষ। প্রথমত তাকে বুঝতে তেমন একটা অসুবিধা হয় না। সবার সাথে সহজেই মিশে যান। অহংকার বলতে নেই। সন্তানদের প্রতি তার অফুরন্ত ভালোবাসা। সারা পৃথিবী একদিকে আমরা তিন ভাই মার দিকে। একজন অভিনয় শিল্পী হিসেবে মা আমার কাছে অসাধারণ।

আনন্দ আলো: মায়ের কাছে ছেলের কোন কাজটি এবং ছেলের কাছে মায়ের অভিনীত কোন নাটকটি প্রিয়?

শিল্পী সরকার অপু: ইয়াসের অভিনীত কোকাকোলার দুটি বিজ্ঞাপন চিত্রই আমার ভীষন ভালো লেগেছে। ওর গ্রামীণফোনের বিজ্ঞাপন চিত্রটিও ভালো হয়েছে। নাটকে অভিনয়ও খুব ভালো করে।

ইয়াস রোহান: মায়ের অভিনয় আমার কাছে অসাধারণ লাগে। মায়ের অভিনীত এই সব দিন রাত্রি, খুশি, আনোয়ারা, জাদুর শহর, কাঙিক্ষত প্রহর এই গুলো আমার প্রিয় নাটক।

আনন্দ আলো: মা-ছেলের এক সঙ্গে স্মৃতিময় কোনো ঘটনা?

শিল্পী সরকার অপু: আমি একবার বাড়ি থেকে বাসায় ফিরছিলাম। পথে মনে মনে ভাবছিলাম জার্নি করে বাসায় ফিরে আমাকে হয়তো রান্না বান্না করে খেতে হবে। কারণ আমার বাসায় তখন কাজের মেয়ে ছিল না। বাবা-ছেলে দুজনই বাসায় ছিল। আমি জানি ওরা কিছু করবেনা। কিন্তু বাসায় এসে দেখলাম আমার ছেলে ভাত, ডাল, বেগুন ভাজি, করল­াভাজি রান্না করে রেখে দিয়েছে। তখন কী কে খুশী লেগেছিল। জীবনে প্রথম ছেলের হাতে রান্না খেলাম। ভীষণ শান্তি পেলাম। সেদিনের সেই ঘটনা এখনো মনে পড়ে।

ইয়াস রোহান: মা জার্নি করে আসবে। বাসায় কোনো রান্নাবান্না ছিল না। মা এসে কী খাবে? এই কথা চিন্তা করে আমি রান্না করতে যাই। রান্না করতে গিয়ে দেখি ভাত, বেগুন ভাজি, করল­া ভাজি সবই করা গেল কিন্তু ডাল কিছুতেই রান্না করতে পারছিলাম না। তখন এক বন্ধুকে ফোন করে জেনে নিলাম ডাল কেমন করে রান্না করতে হয়। তারপর ডাল রান্না করলাম। কিন্তু ডালে হলুদ দিতে ভুলে গিয়েছিলাম। তা সত্বেও আমার খাবার খেয়ে অনেক মা শান্তি পেয়েছিলেন। সেই মুহূর্তটা আমার কাছে সারাজীবন স্মৃতি হয়ে থাকবে।

আনন্দ আলো: অবসর সময় কীভাবে কাটান?

শিল্পী সরকার অপু: অবসর সময়ে আমি ঘুমাই, বই পড়ি আর লেখালেখি করি।

ইয়াস রোহান: প্রচুর মুভি দেখি। বই পড়ি। আম্মুর সাথে আড্ডা দিতে পছন্দ করি।

আনন্দ আলো: অপু সরকারের কাছে জানতে চাই আপনার কাছে পরিবার কী?

শিল্পী সরকার অপু: জীবনের সব কিছুই তো পরিবারের জন্য। পরিবার ছাড়া কোনো কিছু ভাবা যায় না। যেমন আমার বাচ্চাদেরকে টেককেয়ার করার জন্য আমি ১৫ বছর অভিনয় থেকে দুরে ছিলাম। কাজেই সবার আগে পরিবারের স্থান। এখন আমার বাচ্চারা বড় হয়েছে। তাই আবার অভিনয় জগতে ছুটে এসেছি।

আনন্দ আলো: আপনার পরিবার সর্ম্পকে কিছু বলুন?

শিল্পী সরকার অপু: পরিবারের ছায়া আমার কাছে জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমার বাবা সনিন্দ্র চন্দ্র সরকার, মা পারুল সরকার দুজনই সংস্কৃতিমনা মানুষ। তাদের অনুপ্রেরণায় অভিনয় অঙ্গনে আমার পথচলা শুরু। আমার স্বামী নরেশ ভুইয়া অভিনেতা, পরিচালক, একজন ভালো মানুষ। আমার তিন ছেলে। বড় ছেলে অভিম্ন্যু কিশোয়ার রুপাই সিঙ্গাপুরের ফিলিপ ক্যাপিটাল এর মার্কেটিং ম্যানেজার। দ্বিতীয় ছেলে ইয়াস রোহান ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সাইন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়াশোনা করছে। আর ছোট ছেলে অর্জুন কিডস টিটোরিয়াল স্কুলের ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র।

  • মুখোমুখি
Comments (০)
Add Comment