বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০১৯ তবুও অপেক্ষায় আছি

রেজানুর রহমান
মেলবোর্নে এখন রাত ১২টা ২৫। দেশের ছেলেদের মাঠে রেখে ঘুমাতে যেতে পারছিনা। মাশাআল্লাহ শেষটুকু দিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল কর বাবারা… ফেসবুকে এই আবেগময় কথাটি লিখেছেন দেশের গুণী অভিনেত্রী ডলি জহুর। বাংলাদেশেও তখন গভীর রাত। কিন্তু গোটা বাংলাদেশ ছিল জেগে। শহরে বন্দরে, পাড়া মহল্লায়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও টিভির সামনে বসেছিল সবাই। ইংল্যান্ডের মাঠে ক্রিকেট বিশ্বকাপের লড়াইয়ে এককালের ক্রিকেট পরাশক্তি ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি বাংলাদেশ। টস জিতে ফিল্ডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনাংক মাশরাফি বিন মর্তুজা। তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে হঠাৎ করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিরূপ নানা মন্তব্য ভাসতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পাহাড় সমান রান অর্থাৎ ৩২২ করে মাঠ ছাড়লে বাংলাদেশ দলের সমালোচনায় একটা বড় পাহাড় তৈরি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাশরাফি বিন মর্তুজাকে ঘিরে নানা অশোভন মন্তব্য ভাসতে থাকে। “যে অধিনায়ক বোঝেনা টস জিতলে কী করা উচিৎ তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা উচিৎ”। এমন আপত্তিকর মন্তব্যও দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগ ম্যাধমে। কেউ একজন তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখেন “৩২২ করতে পারলে তোগো বাপের নামে বকরী কোরবানী দিব রে, ভাগিনার গোষ্ঠী…”
অবাক কান্ড। অতি সহজেই বাংলাদেশ টপকে যায় ৩২১ রান। তাও আবার ৪১ ওভারের মধ্যে। অর্থাৎ বাংলাদেশ দল যদি সেদিন পুরো ৫০ ওভার ব্যাট করতে পারতো তাহলে দলীয় রান সংখ্যা ৪০০ পেরিয়ে যেতো একথা জোর দিয়েই বলা যায়। একেই বলে লড়াই করে জেতা। ৫০ ওভারের খেলায় ৩২২ রান প্রতিপক্ষের কাছে তো পাহাড় সমান রান। অনেকে ধরেই নিয়েছিল বাংলাদেশ দলের পক্ষে এই রান টপকানো সহজ হবে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশ দলের ক্যাপ্টেন মাশরাফি বিন মর্তুজাকে ঘিরে আপত্তিকর মন্তব্যের ডালপালা ক্রমান্বয়ে বড় হচ্ছিলো। কিন্তু বাংলাদেশ জিতে যাবার পর পরিস্থিতি হঠাৎ করেই পাল্টে গেল। সবার মুখেই মাশরাফি বন্দনা। সাকিব আল হাসানকে ঘিরে কত কথাই না সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছিল। কিন্তু সাকিব সেঞ্চুরী করার পর দলকে জিতিয়ে নিয়ে তবেই মাঠ ছেড়েছেন। সাথে সাথে সাকিবকে ঘিরেও বন্দনা শুরু হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম। অনেকেই সমালোচনার জবাব দিতে শুরু করলেন। বিশিষ্ট সাংবাদিক আনিস আলমগীর তার ফেসবুক ওয়ালে লিখলেন বাংলাদেশ তো আজও টসে জিতে ফিল্ডিং করল। সাড়ে ৯ ওভার বাকী থাকতেই জিতল। ফেসবুকের পন্ডিতরা এখন কী বলবেন…. মাশরাফি খেলা বুঝে না… শফি বাবু নামে একজন তার ফেসবুক ওয়ালে লিখেছেন, আচ্ছা যে দলে হিরো সাকিব আর নেতা মাশরাফি থাকে সে দলে এতো অশিক্ষিত সাপোর্টার থাকে কেন? বাংলাদেশের সাপোর্টারদের এটাই প্রবেলের। বেশি বুঝে। তা সে খেলাই হোক অথবা রাজনীতিই হোক। বাংলাদেশ দলের জয়ের পর জনপ্রিয় অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরী তার ফেসবুক ওয়ালে সাকিবকে ঘিরে চমৎকার একটি ছড়া লিখেছেন। অভিনন্দন সাকিব আল হাসান, পুর্ন করলেন ৬০০০ রান। ভরসা থাকুক সাকিবে, মান সম্মান থাকিবে।
প্রিয় পাঠক,
এই ভরসার ক্ষেত্র নিয়েই একটা গল্প শোনাই আপনাদেরকে। গ্রামের একজন মেধাবী ছাত্র ক্লাশে প্রথম হয়েছে। একই ক্লাশে গ্রামের মাতব্বরের ছেলেও পড়ে। কিন্তু সে পরীক্ষায় পাস করতে পারেনি। মাতব্বরের চেলা চামুন্ডারা মাতব্বরকে বলল, চেয়ারম্যান সাব এটা কি হল! আপনার ছেলে তো পাস করতে পারল না। অথচ কবীর দেখি ‘ফাস্ট’ হয়ে গেল…
মাতব্বর একটু ভেবে নিয়ে বললেন, চিন্তা করিস না। ঝড়ে বক পড়েছে। কবীর সামনের ক্লাশে আর ভালো করতে পারবে না। দেখিস সে ফেল করবে। পরের ক্লাশ অর্থাৎ এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ নিয়ে পাশ করলো কবীর। এবার তো মাতব্বরের চ্যালা চামুন্ডারা আরও বেশী অবাক। মাতব্বর এবারও কবীরের মেধার স্বীকৃতি দিলেন না। তুচ্ছ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বললেন, কোনো মতে ম্যাট্রিক পাশ করেছে। দেখিস আর বেশি দূর যাইতে পারবে না। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে কবীর নামের মেধাবী ছাত্রটি উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষারও জিপিএ-৫ পেয়ে পাস করলো। মাতব্বর এবারও কবীরকে নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করলেন। বললেন, কলেজে পড়া যত সহজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া ততই কঠিন। কবীর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যাইতে পারবে না। কবীর ঠিকই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলো এবং কৃতিত্বের সাথে অনার্স, মাস্টার্স ড্রিগী সম্পন্ন করার পর বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে এক সময় জেলা প্রশাসকের চাকরি পেল। বলা বাহুল্য, গ্রামের একটি নতুন কলেজের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করার জন্য কবীরকেই প্রধান অতিথি করা হয়েছে। এলাকার চেয়ারম্যান সুর পাল্টে ফেলেছেন। গ্রামের যাকেই কাছে পান তাকেই ডেকে নিয়ে কবীরের প্রশংসা করেন, কী আপনাদেরকে বলেছিলাম না কবীরের মতো মেধাবী ছেলে একদিন সত্যি সত্যি দেশের মুখ উজ্জ্বল করবে। আমার কথাই তো সত্যি হলো…
বলা বাহুল্য জেলা প্রশাসক কবীর আহসানকে প্রথম মালা পরালেন গ্রামের সেই মাতব্বর। যিনি একসময় কবীরকে পাত্তাই দিতে চাননি।
প্রিয় পাঠক, এই গল্পের মাজেজা নিশ্চয়ই ধরতে পেয়েছেন। কোনো কারণে বাংলাদেশ দল যদি ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে যেতো তাহলে সমালোচনার তীরটা কতটা বিষ মেশানো থাকতো তা সহজেই অনুমান করা যায়। একথা সত্য, জয়ী মানুষের পক্ষেই সবাই দাঁড়ায়। তাই বলে পরাজিতদেরকে একেবারেই তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করব এটাও তো ঠিক নয়। বরং দুঃসময়েই প্রিয়জনের পাশে সবারই থাকা উচিৎ। বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রতিটি সদস্যই আমাদের প্রিয়জন। আত্মার আত্মীয়। কাজেই তাদের সাফল্যে আমরা তো আনন্দিত হবই। তাই বলে তাদের ব্যর্থতার সময় পাশে থাকব না সেটা বোধকরি ঠিক সিদ্ধান্ত নয়। কথায় আছে বিপদেই বন্ধুর পরিচয়। আমরা সকলেই ক্রিকেটকে ভালোবাসি। আর তাই বাংলাদেশ দল মাঠে ক্রিকেট খেলতে নামলেই জয়ের জন্য সমবেত প্রার্থনায় নেমে পড়ি। খেলায় জয়, পরাজয় থাকে। একদল জিতে অন্যদল হারে। কাজেই নিজের প্রিয় দল প্রতিটি খেলায় জিতবে এমন কোনো কথা নেই। কাজেই দলের ব্যর্থতার দিনেই আমাদের উচিৎ দলের প্রতিটি সদস্যকে সমর্থন দেওয়া।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে বাংলাদেশের একটি জয় বদলে দিয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের অনেক সমীকরণ। পয়েন্ট তালিকায় বাংলাদেশ ৫ নম্বরে উঠে এসেছে। আনন্দ আলোর এই রিপোর্ট প্রকাশের সময় সমীকরণটা এমন নাও থাকতে পারে। তবে আশা ছাড়িনি আমরা। দক্ষিণ আফ্রিকার পর ওয়েস্ট ইন্ডিজকে বাংলাদেশ যে ভাবে পরাজিত করেছে এই ধারা যদি বজায় রাখতে পারে তাহলে যোগ্যতর ৪টি দলের একটি হয়ে ওঠা বাংলাদেশের পক্ষে মোটেই কঠিন হবে না। আমরা সেই আশায়ই আছি।


এই লেখাটি যখন লিখছি তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজনের কমেন্টস দেখে একটু যেনো হাসিই পেল। একজন কৌতুক করে লিখেছেন, ম্যাককালামকে কোথায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রশিদ খানের অবস্থান নিশ্চিত করা গেলেও তিনি ফোন ধরছেন না… ম্যাককালাম বাংলাদেশের ক্রিকেট প্রেমী মানুষের কাছে বেশ পরিচিত একটি নাম। এই ম্যাককালাম হঠাৎ কেন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের সামর্থ নিয়ে একটি বিরুপ মন্তব্য করেছেন সেটা এক ধরনের রহস্যের সৃষ্টি করেছে। ম্যাককালাম বলেছিলেন এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দল নাকি মাত্র একটি খেলায় জিতবে। কিন্তু তার ভবিষ্যৎবানী তো টিকলো না। এখন কি বলবেন ম্যাককালাম? এখনও কি অঘটনের কথা বলবেন? আর রশিদ খান…? এই ভদ্রলোককে আমার কেন যেন রিপোর্টে উল্লেখ করা গ্রামর সেই টাউট টাইপের মাতব্বরের মতো মনে হচ্ছে! অচিরেই এই ভদ্রলোক বাংলাদেশ দলের প্রশংসায় মুখে ফেনা তুলবেন আশা করছি।
লেখাটি শুরু করেছিলাম গুণী অভিনেত্রী ডলি জহুরের একটি বক্তব্য দিয়ে। তারই আরেকটি বক্তব্য উল্লেখ করে লেখাটি শেষ করতে চাই। দ্বিতীয় বারে ডলি জহুর লিখলেন, অভিনন্দন সাকিব, লিটন দাস। জানটা ঠান্ডা করে দিয়েছ।
আসলেই জানটা ঠান্ডা করে দিয়েছে আমাদের বীর ক্রিকেটাররা। এবার আরও সাফল্যের অপেক্ষায় আছি…

সাকিব ‘নাম্বার ওয়ান’
ক্যারিয়ার শেষে ইতিহাসের সেরা অলরাউন্ডারদের তালিকায় কোথায় জায়গায় পাবেন সাকিব আল হাসান, তা ভবিষ্যতের জন্যই তোলা থাকল। তবে এই সময়ে যে বাংলাদেশের অলরাউন্ডারই সেরা তা নিয়ে দ্বিধা আছে খুব কম মানুষেরই। রেকর্ড-পরিসংখ্যানও কথা বলে সাকিব হয়ে।
যত রেকর্ড
১ আইসিসি অলরাউন্ডার র‌্যাঙ্কিয়ে তিন সংস্করনেই শীষে ওঠা একমাত্র ক্রিকেটার। এক বিশ্বকাপে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রান ও উইকেট সাকিবের। অন্য কোনো দলের কারও এই ‘ডাবল’ নেই। ৩ টেস্টে একই ম্যাচে সেঞ্চুরি ও ১০ উইকেট পাওয়া তৃতীয় ক্রিকেটার। ওয়ানডেতে ৫০০০ রান ও ২০০ উইকেটের ডাবলে দ্রæততম (১৭৮ ম্যাচ)। ওয়ানডেতে ৫০০০ রান ও ২৫০ উইকেটের ডাবলে দ্রæততম (১৯৯ ম্যাচ)। ওয়ানডেতে ৬০০০ রান ও ২৫০ উইকেটের ডাবলে দ্রæততম (২০২ ম্যাচ)। টেস্টে ৩০০০ রান ও ২০০ উইকেটের মাইলফলকে দ্রæততম (৫৪ ম্যাচ)। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ হাজার রান ও ৫০০ উইকেটে দ্রæততম। (৩০২ ম্যাচ)। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১১ হাজার রান ও ৫০০ উইকেটে দ্রæততম (৩২৬ ম্যাচ)।

  • প্রচ্ছদ মুখ
  • শীর্ষ কাহিনি