আমাদের বৃক্ষসখা-মুকিত মজুমদার বাবু

গাছ ছাড়া কি পৃথিবী থাকবে? সহজ উত্তরÑ না। অক্সিজেন ছাড়া কি আগুন জ্বলবে? এরও সহজ উত্তর- না। অনেকের কাছে এই ‘না’ উত্তরটি হাস্যকর মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কেননা, গাছের বহুবিধ উপকারের কথা তাদেরকে কেউ কোনোদিন বুঝিয়ে বলেনি কিংবা তারাও কোনোদিন কারও কাছ থেকে আগ্রহ নিয়ে শোনেনি। তাদেরকে যখন গুরুত্বের সঙ্গে বোঝানো হবেÑ গাছ যে অক্সিজেন দেয় সেটা আমরা নিঃশ্বাস হিসেবে গ্রহণ করি, আর বাতাসের সঙ্গে যে অক্সিজেন মিশে আছে তা আগুন জ্বালাতে সাহায্য করে। কীভাবে এ কাজগুলো সংগঠিত হয় তা সহজ ভাষায় বিশ্লেষণ করে মানুষকে বোঝালে গাছ যে আমাদের উপকারী বন্ধু এ কথাটা তারা বুঝবে। গাছ যে শুধু আমাদের অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে তা নয়, ঝড়-ঝঞ্ঝার কবল থেকেও বাঁচাচ্ছে। একটি বাড়ির চারপাশে যদি গাছের বাগান থাকে তাহলে ঝড় এসে প্রথমে আঘাত হানবে গাছের গায়ে। তাতে রক্ষা পাবে বসতবাড়ি। অধিকাংশ সময় বাগানঘেরা বাড়ি গাছের কারণে ঝড় থেকে রক্ষা পায়। সিডরের দানবীয় দাপট থেকে যেমন ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করেছিল সুন্দরবন।

গ্রীষ্মের দাবদাহে অতিষ্ঠ মানুষ শীতল পরশ পেতে দাঁড়ায় গাছের ছায়ায়। আবার গাছের কাঠ দিয়েই তৈরি হয় সুন্দর সুন্দর আসবাবপত্র যা অফিস-আদালত, ঘর-বাড়ি, দোকান-পাটসহ নানা জায়গায় ব্যবহৃত হয়। প্রকৃতির শোভাবর্ধনেও গাছের জুড়ি নেই। জ্বালানি হিসেবেও গাছের গুরুত্ব কম নয়। নানা জাতের ফল-ফলাদি আসে গাছ থেকেই। এছাড়া প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আজ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রজাতির ঔষধি গাছ আমাদের অসুখ-বিসুখে প্রতিষেধকের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে পানির সহজপ্রাপ্যতার কারণে আমরা পানির অসুবিধা তেমন একটা টের পাই না। অথচ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ প্রাকৃতিক পানি সংগৃহীত হয় বন থেকে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের বহুবিধ কর্মকাÐের কারণে বাতাসে যে কার্বন ডাই অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে চলছে তা নিয়ন্ত্রণ করতে গাছের কোনো জুড়ি নেই। বিজ্ঞানীদের গবেষণা তথ্য থেকে জানা যায়, একটি পূর্ণ বয়স্ক গাছ বছরে ৪৮ পাউন্ড কার্বন ডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং ওই পরিমাণ অক্সিজেন ত্যাগ করে, যা দুই জন মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য যথেষ্ট। এটি বছরে ১০ পাউন্ড অন্যান্য বায়ু দূষণকারী পদার্থ বায়ু থেকে শোষণ করে। ‘দ্য আমেরিকান ফরেস্টস অরগানাইজেশন’-এর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এক একর জায়গার গাছ (বন) বছরে চার টন অক্সিজেন দেয়, যা দিয়ে ১৮ জন মানুষের অক্সিজেনের অভাব পূরণ হয়। শোষণ করে নেয় ছয় টন কার্বন ডাই অক্সাইড আর সমপরিমাণ অক্সিজেন সরবরাহ করে। একটি বড় গাছ প্রতিদিন ৪০০ গ্যালন পানি বাতাসে ছড়িয়ে দেবার কারণে আশপাশের প্রচÐ তাপ শোষণ করে নেয়।

গাছ না থাকলে পাখি থাকবে না। পাখি না থাকলে সকাল-সন্ধ্যায় পাখির কুজনের সেই মিষ্টি ছন্দ হারিয়ে যাবে। গাছ না থাকলে ফুল ফুটবে না। ফুল না ফুটলে কীট-পতঙ্গ থাকবে না। আবার ফুল না থাকলে আমাদের বিষণœ মনও প্রফুল্ল হবে না। গাছ না থাকলে বন থাকবে না। বন না থাকলে বন্যপ্রাণী থাকবে না। গাছ না থাকলে আমরাও থাকব না। আমাদের কোনো অস্তিত্বও থাকবে না পৃথিবীতে। ভাবতে অবাক লাগে, প্রতিবছর পৃথিবী থেকে ৩২ মিলিয়ন একর বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, যার আয়তন প্রায় ইংল্যান্ডের মতো একটি দেশ। তাই আমাদের স্বার্থেই গাছ বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গাছ সম্পর্কে এ সব কথা শোনার পর নির্দ্বিধায় আমরা বলবÑ গাছ যে এত উপকারী বন্ধু আগে তো জানতাম না। অথচ এই বন্ধুর গায়ে করাত বসাতে দ্বিধা করছে না কিছু অর্থলিপ্সু মানুষ। তারা সড়কের পাশের গাছ, বন উজাড় করছে, বন থেকে কাঠ পাচার করছে, আবার বনের ভেতর করাতকল স্থাপন করেও কাঠচেরাই করার খবর প্রকাশ হচ্ছে গণমাধ্যমে। বন বিভাগের এমন অনেক জায়গা আছে যেখানে কোনো গাছ নেই, কোনো বন নেই, এমনকি বন বিভাগের দখলেও নেই। যারা বন ধ্বংস করছে অর্থের লোভে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করবে অন্যরা।

একটি দেশের মোট আয়তনের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও সরকারি হিসাবমতে আমাদের রয়েছে মাত্র ১৭ ভাগ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর পরিমাণ আরও কম। বাংলাদেশই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সবচেয়ে বড় শিকার। এই দানবীয় দুর্যোগের হাত থেকে বাঁচতে অবশ্যই আমাদের বন সৃজনের বিকল্প নেই। বৈরী জলবায়ুর রাহুগ্রাস থেকে বাঁচতে আমাদের গাঢ় সবুজের ভূখÐ গড়ে তুলতে হবে। আগামী প্রজন্মের চলার পথ সুগম করতে হবে। আমাদের প্রকৃতি আমাদেরই রক্ষা করতে হবে।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন

  • প্রকৃতি কথা
Comments (০)
Add Comment