মনোকালচার গ্রাসে প্রাকৃতিক বন-মুকিত মজুমদার বাবু

বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বন ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ হলো মনোকালচার। এক বা একাধিক বিদেশি প্রজাতি দিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি বনই হচ্ছে মনোকালচার বন। কৃত্রিম বন যেখানেই তৈরি হচ্ছে সেখানে এবং তার আশপাশে প্রাকৃতিক বন দ্রæত নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। কৃত্রিম বনে যেসব বিদেশি গাছ লাগানো হচ্ছে সেসব মূলত মÐ ও কাগজ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ভালো। বাংলাদেশে মনোকালচারের জন্য রাবার, ইউক্যালিপটাস, সেগুন, আকাশমণি, মেহগনি ইত্যাদি গাছ ব্যবহার করা হচ্ছে। ১৯৫৯ সালে প্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামে পরীক্ষামূলকভাবে রাবার চাষ শুরু হলেও রাবার উন্নয়ন প্রকল্প বাণিজ্যিকভাব চাষ শুরু করে ১৯৬৯ সালে। তবে রাবার চাষ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য খুব একটা সুফল বয়ে আনতে পারেনি। উল্টো রাবার চাষ যেখানে হচ্ছে সেখানকার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। রাবার মনোকালচার পরিবেশের জন্য খুবই স্পর্শকাতর। রাবার ও বাণিজ্যিক বনায়নের মাধ্যমে শালবনের প্রাণবৈচিত্র্যের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।

বর্তমানে দেশে কাঠের জন্য ব্যাপক জনপ্রিয় ও উপযোগী গাছ সেগুনও বাংলাদেশের কোনো স্থানীয় প্রজাতি নয়। ১৮৭২ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে বার্মা থেকে আনা বীজপ্রথম পার্বত্য চট্টগ্রামের সীতাপাহাড়ে লাগানো হয়। সেগুন ভবিষ্যতে গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতির গাছ হবে তখন এই ধারণাই পোষণ করা হতো। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে সেগুন মনোকালচার একটি পরিচিত দৃশ্য। বর্তমানে বাংলাদেশের সব জায়গাতেই সেগুন গাছ দেখা যায়। সেগুন মূল্যবান গাছ হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি পরিবেশের জন্য এই প্রজাতি মোটেই ভালো নয়। ভূমিক্ষয়ের জন্য সেগুন গাছ খুব সমালোচিত একটি প্রজাতি। সেগুন গাছের তলায় অন্যকোনো গাছ বা আগাছা জন্মায় না বললেই চলে, বিশেষ করে পাহাড়ের ঢালে। আকাশমণি আজো প্রাকৃতিক বনের জায়গায় রোপিত হচ্ছে ব্যাপক হারে। কারণ এই গাছ খুব কম সময়ে বেড়ে ওঠে ও কাঠের চাহিদা পূরণ করে। দেখা গেছে আকাশমণি গাছের পরাগরেণু বাতাসে মিশে মানুষের হাঁপানি রোগের সৃষ্টি করে। এই গাছ অত্যধিক পানি শোষণ করে বলে আশপাশের জমি শুকিয়ে মাটির উর্বরাশক্তি হ্রাস করে দেয়। এছাড়া এই গাছ দেশি প্রাণীর খাদ্যের জোগান দিতে পারে না। বিদেশি প্রজাতির আরেকটি গাছ হলো ইউক্যালিপটাস। লম্বা, মসৃণ বাকলবিশিষ্ট এই গাছের পাতা সরু ও সুগন্ধিযুক্ত। এটি অস্ট্রেলিয়া, তাসমানিয়া ও নিউগিনির স্থানীয় উদ্ভিদ। সৌন্দর্য, বনায়ন ও কাঠের জন্য বাংলাদেশে ইউক্যালিপটাস রোপণ শুরু হয় ১৯৬০ সালে, যা আমাদের প্রাকৃতিক বনকে হুমকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

বৃক্ষজাতীয় গাছপালা ছাড়াও আনারস ও কলা চাষে আমাদের প্রাকৃতিক বন ধ্বংস হচ্ছে। শালবন কেটে কলা ও আনারস চাষে শুধু যে ভূমিক্ষয় হচ্ছে তা নয়, দ্রæত ফলের বৃদ্ধির জন্য যে হরমোন ব্যবহার করা হচ্ছে তা মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তবে এসব ছাপিয়ে তামাক চাষ আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশকে বিষিয়ে তুলছে। কুষ্টিয়া, রংপুর, যশোর, ফরিদপুর, চট্টগ্রাম ও পটুয়াখালী বাংলাদেশের প্রধান তামাক উৎপাদনকারী জেলা।তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, বান্দরবান এবং খাগড়াছড়িতে ব্যাপক হারে হচ্ছে তামাকের চাষ।

তামাক যে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর সেটা নতুন করে বলার কিছু নেই। তামাকের পাতায় নিকোটিন নামক বিষাক্ত পদার্থ থাকায় মানুষ তা ব্যবহারে নানা ধরনের জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তামাক পোড়ানোর জন্য উজাড় হচ্ছে হাজার হাজার মেট্রিকটন জ্বালানি কাঠ। এই জ্বালানি কাঠের জোগানদাতা বনভূমি। অতএব জ্বালানি কাঠের জোগান দিতে গিয়েও বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে। ফলে জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

একটি দেশের ২৫ ভাগ বনভূমি থাকার কথা থাকলেও বাংলাদেশে রয়েছে তার অনেক কম। আর এই বনভূমির অধিকাংশই  হলো মেহগনি, সেগুন, ইউক্যালিপটাস ইত্যাদির মনোকালচার বন। সুন্দরবন ছাড়া দেশের অধিকাংশ প্রাকৃতিক বন প্রায় উজাড় হয়ে গেছে। অবশিষ্ট যা আছে তাও দ্রæত শেষ হয়ে যাচ্ছে। জীববৈচিত্র্য কীভাবে টিকে থাকবে যদি বৈচিত্র্যময় গাছ না থাকে? তাই মনোকালচারের আগ্রাসন রুখতে হবে। বাঁচাতে হবে জীববৈচিত্র্য।

লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন

  • প্রকৃতি কথা