বন্যেরা বনে সুন্দর!-মুকিত মজুমদার বাবু

ছোটবেলার কথা। গ্রাম-গঞ্জে, শহরের মহল্লায় মহল্লায় তখন বানর নিয়ে খেলা দেখাতে আসত বানরের মালিকরা। উঠোনে গোল হয়ে বসত খেলা দেখার আসর। মালিক আর খেলা দেখানো বানরটি থাকত সবার মাঝখানে। খেলা দেখানো বানরটির একটা নাম থাকত। ধরা যাক বানরটির লাল মিয়া। মালিক বলত, লালমিয়া, মোল্লা বিয়ে করতে যায় কীভাবে? বানরটা দু’পায়ে ভর করে একটা লাঠি কাঁধে নিয়ে হেঁটে যেত কিছুটা দূর। ফিরে এসে আবার লাঠিটা দিয়ে দিত মালিকের কাছে। মালিক বলত, গুলি করলে সে গুলির হাত থেকে তুমি বাঁচবে কীভাবে? বানরটি তখন কয়েকবার ডিগবাজি খেত। ঘিরে থাকা দর্শরা হাতে তালি দিত। ঘরের ঝি-বউদের সঙ্গে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা হেসে গড়াগড়ি যেত।
শহরগুলোতে হয়তো এখন আর বানর নিয়ে খেলা দেখাতে আসে না কেউ। গ্রাম-গঞ্জেও তাই। আগের মতো ঢাকা শহরে এখন আর বানর দেখা যায় না। দেখা গেলেও হাতেগোনা। ছোটবেলায় আমাদের মহল্লাসহ আশপাশে বানরের ছিল অবাধ বিচরণ। বেশি ছিল পুরান ঢাকায়। মানুষের ঘর থেকে, বাচ্চাদের হাত থেকে খাবার কেড়ে নিয়ে যেত। নাজির হোসেনের ‘কিংবদন্তির ঢাকা’ বইতে রাজধানীর বানর সম্পর্কে চমৎকার বিবরণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন, ‘গাছ-গাছালি ও বাড়ির ছাদে অসংখ্য বানর চলাফেরা করত। এমনকি ভোরবেলা শত শত বানর দলবদ্ধভাবে রাস্তার উপর বসে থাকত আর মনের সুখে একে অপরের উকুন মারত। রাস্তার উপর বানরগুলো এমন বেপরোয়াভাবে বসে থাকত যে, পথচারীদের প্রতি তাদের কোন ভ্রƒক্ষেপই থাকত না। দলবদ্ধভাবে বানরদের বসে থাকতে দেখে অনেকেই পথ চলতে ভয় পেত। একা একা ভয়ে তাদের সামনে যেতে সাহস পেত না। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ত। চার-পাঁচজন একত্রিত হলে তবে বুকে সাহস সঞ্চার করে ধীর পদক্ষেপে বানর দলকে অতিক্রম করে যেত। তারা সুযোগ বুঝে মানুষের মত ঘরের শিকল খুলে ঘরে ঢুকে খাবার-দাবার সাবাড় করে দিত। রান্না করা ভাতের হাঁড়ি-পাতিল নিয়ে গিয়ে উঠত ঘরের ছাদে, গাছের ডালে। খাবার না পেলে অনেক সময় কাপড়-চোপড় নিয়ে গিয়ে গাছে বা ছাদে উঠত। গৃহিণীরা আদর করে খাবার দিলে তবেই তারা সেগুলো ফেরত দিত, নতুবা ছিঁড়েখুঁড়ে একাকার করে দিত। ছেলেপুলের হাত থেকেও খাবার-দাবার ছিনিয়ে নিত। তাদের ঘ্রাণশক্তি খুবই প্রখর। তাই বাজারের ঝাঁকা থেকে কেবলমাত্র খাবারের ঠোঙাটি বেছে নিতে পারত। এতে বাধা দেয়ার সাহস কারো হতো না। বাধা দেয়ার চেষ্টা করলেই বত্রিশখানা দাঁত খিচিয়ে তেড়ে আসত।’ পুরনো ঢাকায় এক এলাকার নাম ছিল বানরটুলি। বংশালে আজও আছে বান্দরিয়া গলি। এই নামগুলোই বলে দেয় শহরে বানরের উৎপাত কেমন ছিল।
এখনো ঢাকার শাঁখারী বাজার, তাঁতী বাজার, গেন্ডারিয়াসহ পুরানো ঢাকায় বানরের দেখা মেলে। তবে আগের মতো নয়। খাবারের অভাব আর গাছ-গাছালি উজাড়ের সঙ্গে সঙ্গে বিদায় নিয়েছে বানরের বাঁদরামিও। এখন সুন্দরবন, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কাপ্তাই, ধামরাই, মধুপুর, সিলেট, লাউয়াছড়া, রেমাকালেঙ্গা, সাতছড়িসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু কিছু বানরের বাস। তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, এ সংখ্যা এ যাবৎ কালের ভেতর সবচেয়ে কম।
দুই
ছোটবেলায় বেদে-বেদেনীদের দেখেছি দলবেঁধে পাড়া-মহল্লায় ঘুরে ঘুরে সাপ খেলা দেখাতে। বাঁশের তৈরি ছোট্ট ঝাকায় থাকত বিষদাঁত ভাঙা সাপ। সে খেলা দেখার আসরও বসত গোল হয়ে। ভেতরে থাকত তিনচার জন বেদে-বেদেনী। তাদের কারো কারো হাতে থাকত বীন। বীন বাজত। আহ কী সুন্দর সে বীনের আওয়াজ! সাপ থাকা ঝাকার ঢাকনা খুলে দেয়া হতো। হাত দিয়ে ঝাকার ভেতর থাকা সাপের গায়ে খোঁচা দিলেই বেরিয়ে আসত সাপ। ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস শব্দ করত। বেদে হাত মুঠ করে সাপের সামনে নাচাত। সাপ ছোবল মারত। হাত সরিয়ে নিয়ে আসত বেদে। এভাবে বার বার। বীনের তালে তালে ফণা তুলে হেলেদুলে সাপ মাথা দোলাত। বেদেনীরা বীনের তালে তালে গান গাইত। গান ও বীন বাজানো শেষ হলে বেদেনীরা সাপে যাতে না কামড়াতে পারে তার জন্য তাবিজ বিক্রি করত। সাপের উপদ্রব বেশি থাকায় মানুষ অন্ধবিশ্বাসে তাবিজ কিনত। বেদে-বেদেনীদের সাপের খেলা এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে তাদের জীবন কাহিনি নিয়ে জসিমউদ্দিন রচনা করেছিলেন বিখ্যাত নাটক ‘বেদের মেয়ে’।
সময়ের পরিক্রমায় বেদে-বেদেনীদের সংখ্যা কমে গেছে। আয়-রোজগার না থাকায় অনেকেই পেশা বদল করছে। কিন্তু এখনো টিকে আছে সাপের খেলা। এখনো ধুকে ধুকে চলছে বেদে-বেদেনীদের জীবনযাপন। আগে বাড়ির আশপাশে, বনে-জঙ্গলে সাপ দেখা যেত। এখন সাপের দেখা মেলাই ভার। ঝোপ-জঙ্গল উজাড় করে মানুষ ফসলি জমি বৃদ্ধি করছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে একের পর এক গড়ে উঠছে বসতি। উন্নয়নের তালে তাল মেলাতে দ্রæত ঘটছে শিল্পায়ন। উন্নত সুযোগ-সুবিধার কারণে কলেবর বৃদ্ধি পাচ্ছে শহরগুলোর। আর এসব কিছুই হচ্ছে প্রকৃতির গায়ে আঁচড় কেটে। ঝোপ-জঙ্গল না থাকলে সাপ থাকবে কোথায়! অর্থের লোভ সামলাতে না পেরে অনেক পাচারকারী বিভিন্ন প্রজাতির সাপ বিদেশে পাচার করছে। এছাড়া সাপকে দেখলেই মেরে ফেলার একটা প্রবণতা আমাদের ভেতর কম-বেশি অনেকেরই আছে। এছাড়া আরো অনেক কারণে দিন দিন দেশে সাপের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আমাদের জানা দরকার যে, দেশে প্রায় একশ’ প্রজাতির সাপ রয়েছে। এরমধ্যে দশ থেকে পনের প্রজাতির সাপ খুবই বিষধর, আর মাঝারি বিষধর হলো প্রায় দশ প্রজাতি। বাকি প্রায় আশি প্রজাতির সাপের কোনো বিষ নেই। আমরা না জেনে না বুঝে বিষধর সাপকেও মারছি, আবার নির্বিষ সাপকেও বাঁচতে দিচ্ছি না। অথচ সাপ আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। ফসলের জন্য ক্ষতিকর ইঁদুর, চিকা, শামুক ইত্যাদি খেয়ে ফসল রক্ষা করছে। সাপের সংখ্যা বা প্রজাতির ভিন্নতার ওপর ভিত্তি করে জানা যায় বনের সার্বিক সুস্থতা।
তিন
আমাদের ছোটবেলায় সার্কাসের খুব প্রচলন ছিল। কোনো স্কুল, কলেজ কিংবা খোলা মাঠে চারপাশ ঘিরে বসত সার্কাস। মা-বাবা, ভাই-বোন মিলে আমরা সার্কাস দেখতে যেতাম। যাদু, বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কসরতের পাশাপাশি দলে অন্তর্ভুক্ত থাকত বাঘ, হাতি, ভাল্লুক দিয়ে দেখানো অবাক করা সব খেলা। একটা খাঁচার মধ্যে দুই-তিনটা বাঘ থাকত। গোল একটা রিঙের ভেতর দিয়ে বাঘের আসার ইঙ্গিত দিতেন ভেতরে থাকা মানুষটি। বাঘগুলো তাই করত। লোকটি বাঘকে হাঁ করিয়ে তার মুখগহŸরে নিজের মাথা ঢুকিয়ে দিত। আমরা অবাক হয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতাম। বনে থাকা বাঘ, ভাল্লুকের সঙ্গে মানুষ যে এমন আচরণ করতে পারে তা কিছুতেই বিশ্বাস হতো না।
আমাদের দেশসহ বিশ্বে সার্কাসে বন্যপ্রাণীর ব্যবহার নতুন নয়। আগেও হতো। এখনো হচ্ছে। তবে আগের চেয়ে এখন কম। এর কারণ হলো, একটি সার্কাস দলকে পরিচালনা করতে যে অর্থ ব্যয় হয় তা লাভ নিয়ে ফিরে আসে না। তাই পেশা বদল করে অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
সার্কাসে আমাদের দেশসহ অন্যান্য দেশে সিংহ, গÐার, জিরাফ, বাঘ, হাতি, ঘোড়া, বানর, হনুমানসহ বিভিন্ন প্রাণী দিয়ে খেলা দেখানো হয়। সার্কাস থেকে বন্যপ্রাণী দিয়ে দর্শকদের বিনোদিত করার অংশটা বাদ দিয়ে দিলে সার্কাস দলের খুব বেশি ক্ষতি হবে না। প্রকৃতিকে ভালো রাখতে, সুস্থ রাখতে সবাই এই ত্যাগটুকু স্বীকার করে নেবে বলে আমার মনে হয়। আজ প্রকৃতি যে অবস্থাতে এসে দাঁড়িয়েছে তাতে সার্কাস থেকে বন্যপ্রাণী বাদ দেয়া আজ সময়ের দাবি।
পৃথিবীতে সবকিছুই নিজ নিজ পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতায় স্বাভাবিক সৌন্দর্যে পূর্ণতা পায়। পরিবেশের সঙ্গে থাকে তার স্বাভাবিক ও স্বাচ্ছন্দ্যময় সম্পর্ক। পরিবেশগত বৈশিষ্ট্যের অনুষঙ্গেই বিকশিত হয় তার স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। পরিবেশ বিচ্ছিন্ন হলে স্বাভাবিক সৌন্দর্য ¤øান হয়ে যায়। তাই বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে আজ বানর, সাপ নিয়ে খেলা দেখানো বন্ধের উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বন্ধ করতে হবে সার্কাসে বন্যপ্রাণীর ব্যবহার। পাশাপাশি বন্ধ করতে হবে বন্যপ্রাণী শিকার ও পাচার। অর্থলিপ্সু এক ধরনের অসাধু ব্যবসায়ীরা দেশের বাঘ, হাতি, হরিণসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী শিকার করে তার দাঁত, চামড়া, শিং, হাড় বিদেশে পাচার করছে। আবার মাংসের জন্য ফাঁদ পেতে শিকার করছে হরিণ। শিকারের নিশানা হচ্ছে শত শত পরিযায়ী পাখি। আর বন্যপ্রাণী শিকার নয়, পাচার নয়, ব্যবহার নয়, খেলা নয়, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণই হোক সুন্দর প্রকৃতিতে সুস্থ জীবন গড়ার প্রত্যয়।
লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন

  • প্রকৃতি কথা
Comments (০)
Add Comment