মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন বিস্ময়কর মিরাজ
টেস্ট অভিষেকের রোমাঞ্চ আর প্রথমবারের মতো জাতীয় দলের হয়ে মাঠে নামায় স্নায়ুচাপতো আছেই। তার ওপর নতুন বলে বোলিং করা একজন স্পিনারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ আর কী হতে পারে! তবে এই চ্যালেঞ্জটা ‘এ-প্লাস’ পেয়েই উতরেছেন আমাদের মেহেদী হাসান মিরাজ। অসাধারণ ক্রিকেটীয় দক্ষতায় ইংলিশদের বিপক্ষে চট্টগ্রাম টেস্টে ১৯ বছর বয়সী স্পিনার ৮০ রানে তুলে নিয়েছিলেন ৬ উইকেট। অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসে বাংলাদেশের হয়ে যেটি সেরা বোলিং। মিরাজ প্রসঙ্গ আসছে কলিন ডি গ্র্যান্ড হোমের কারণেই। কিউই পেস বোলিং অলরাউন্ডার ক্রাইস্টচার্চ টেস্টে পাকিসৱানের বিপক্ষে নিয়েছিলেন ৪১ রানে ৬ উইকেট, যেটি নিউজিল্যান্ডের হয়ে টেস্ট অভিষেকে সেরা বোলিংয়ের কীর্তি। ‘বোলার’ মেহেদী হাসান মিরাজের প্রশংসা এখন এই কলিনের সঙ্গে বিশ্বজুড়ে।
এবার বিশ্ব দেখল ‘ব্যাটসম্যান’ মিরাজের নান্দনিক ব্যাটিং, যে ব্যাটিং মুগ্ধতা ও সৌরভ ছড়িয়েছে। মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে। রাজশাহী কিংসের মিরাজ যখন ব্যাটিংয়ে এলেন দলের রান তখন ৬ উইকেটে ৪১। স্কোর বোর্ডে ২ রান যোগ হতেই আরও ১ উইকেটের পতন। কি করবেন মিরাজ! দলের স্কোর বোর্ডে কত রানইবা যোগ করবেন? আগের ৬ ইনিংসে মাত্র ২০ রান করা মিরাজের কাছে প্রত্যাশা আর কতটুকুই বা!
কিন্তু আফ্রিদিকে যেভাবে বাউন্ডারি মেরে শেষ দিকের খেলা শুরু করলেন তাতে মনে হচ্ছিল ২০ ওভার পুরো খেলতে পারলে মিরাজ কিছু একটা করে বসবেনই! তাই করে বসলেনও মিরাজ। ৩৩ বলে ৩ চার ও ১ ছক্কায় তার রান ৪১। আফ্রিদির বলে সাব্বির আউট। ঐ ওভারের শেষ বলে পয়েন্ট ও শর্ট থার্ডম্যান অঞ্চল দিয়ে মিরাজ কাট করে বল পাঠালেন বাউন্ডারিতে।
শেষ দুই ওভারে মিরাজ হাত খুলে খেললেন। সানীর করা ১৯তম ওভারের প্রথম বলে মিড উইকেট দিয়ে বাউন্ডারি। এরপর রুবেলের করা ২০তম ওভারের প্রথম বলে শর্ট ফাইন লেগ দিয়ে বল পাঠালেন বাউন্ডারিতে। পরের বলটিতে হাওয়ায় ভাসিয়ে লং অফ দিয়ে ছক্কা! অসাধারণ মিরাজ। তার কারনেই সেদিন রাজশাহী অনায়াসে ম্যাচ জয় করেছে। জাতীয় দলে অভিষেকের পর নিজের বোলিং প্রতিভা দেখিয়েছেন মিরাজ। এবার ব্যাটিং প্রতিভা দেখালেন বিপিএলেও। শুধু ব্যাটিং প্রতিভা দেখালেন না উপরে ব্যাটিং করার জোর দাবিও তুললেন। নিউজিল্যান্ড টুরে বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলতে গেছেন মিরাজ। এখন দেখার পালা সেখানে আমাদের রাইজিং স্টার কতটুকু আলো ছড়ান!
মোসাদ্দেক ভালো ফিনিশার হতে পারে
এবারের বিপিএল এর একটি খেলায় ১৮তম ওভারে শহীদ আফ্রিদির দুই বলে পর পর দুই বাউন্ডারি মেরে দিলেন মোসাদ্দেক হোসেন। প্রথমটা রিভার্স সুইপে, পরেরটা অফ স্ট্যাম্পের অনেক বাইরের বলে কাট করে। নিজের শেষ ওভারে দুই বাউন্ডারি খাওয়া স্বসিৱদায়ক ছিল না আফ্রিদির জন্য। তবু ওভার শেষে হাত বাড়িয়ে মোসাদ্দেকের মাথার হেলমেটটা নাড়িয়ে বাহাবা দিলেন সাবেক পাকিসৱানী অধিনায়ক।
সাধারনত তরুণ ক্রিকেটারদের নিয়ে আগেভাগেই মনৱব্য করতে রাজী হন না সাকিব। নিখুঁত দৃষ্টিতে যখন পাখির চোখে পরখ করেন, তখনই মনৱব্য করেন। আসলেই মোসাদ্দেক একজন ভালো ফিনিশার হতে পারেন। তার ঝলক তিনি এর আগে জাতীয় দলে দেখিয়েছেন। অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপেও নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন। এবার যোগ্যতা প্রমাণ করার সুযোগ এসেছে বিদেশের মাটিতে। নিউজিল্যান্ড সফরে এই অলরাউন্ডারের অগ্নিপরীক্ষা হতে। দেখা যাক ক্রীড়া ক্ষেত্রে আমাদের রাইজিং স্টার এবার কতটুকু সাফল্য দেখান।
এশিয়ার সপ্তম ফুটবলার সানজিদা
মাঠের বাইরেও সানজিদা চটপটে। দলে কেউ ভুল কিছু বললে প্রতিবাদ করে। এই দলে ময়মনসিংহের বিখ্যাত কলসিন্দুরের আট-নয়জন মেয়ের মধ্যে নিজেকে উজ্জ্বলভাবে তুলে ধরছে ৭ নম্বর জার্সি পরে খেলা সানজিদা। অন্যদের চেয়ে একটু ‘সচ্ছল’ পরিবারের এই ফুটবলার ২০১৩ সালে ‘প্ল্যান বাংলাদেশ’ টুর্নামেন্টে খেলতে প্রথম ঢাকায় আসে। সেই শুরু। তবে ২০১৪ নভেম্বরে ইসলামাবাদে সাফ খেলতে যায়নি। যদিও জাপানের কোচ সুকি তাকে চেয়েছেন। কিন্তু সানজিদার বাবা রাজি হননি মেয়ের জেএসসি পরীক্ষার জন্য।
যেভাবে উঠে এলেন মেহেদী মারুফ
সত্যি বলতে কী… ক্রিকেট আমার প্রিয় খেলা ছিল না। আমি ফুটবল খেলতেই পছন্দ করতাম। বাবা খুব
ফুটবল খেলতে পছন্দ করতেন। টাঙ্গাইলে আমাদের বাড়ির কাছেই মাঠে বাবার সঙ্গেই ফুটবল খেলতে যেতাম। আমি মা-বাবার একমাত্র সনৱান। তখন আমার বয়স ১২। এলাকার তিন বড় ভাইয়ের সহযোগিতায় ক্রিকেট খেলা শুরু। এরপর আজমদার ক্রিকেট কোচিং সেন্টারে ৬ মাস কাটিয়ে চলে যাই বিকেএসপিতে। সেখান থেকে জাতীয় অনূর্ধ্ব-১৫ দলের তামিম, মুশফিকদের সঙ্গে ভারতে খেলতে যাই। এভাবেই ক্রিকেট নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকি। তবে আমার চেষ্টাটা মনে হয় জোরালো ছিল না। যে কারণে সবার নজরে আসতে সময় লাগে। এবার বিপিএলএ আমাকে মানুষ যে রকম চিনেছে, গত ১০ বছরেও তা চেনেনি।’
এবারের বিপিএলে আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে সবার নজর কেড়েছেন মেহেদী মারুফ। ফিফটি করেছেন দুটি। ঢাকা ডায়নামাইটসকে প্রায় প্রতিটা ম্যাচেই এনে দিয়েছেন উড়নৱ সূচনা। ১৪ ম্যাচে ২৬.৬৯ গড়ে তার ব্যাট থেকে এসেছে ৩৪৭ রান। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ২০টি ছক্কাও হাঁকিয়েছেন তিনিই। বিপিএলে পারফরম্যান্সের পুরস্কারও পেয়েছেন হাতেনাতে। ডাক পেয়েছেন নিউজিল্যান্ড সিরিজের জন্য অস্ট্রেলিয়ায় প্রস্তুতি ক্যাম্পের বাংলাদেশ দলে। এবার দেখার পালা আমাদের ক্রীড়া জগতের রাইজিং স্টার ভবিষ্যতে কতদূর যায়!
মালদ্বীপের ফুটবলে পলাশপুরের সাবিনা
বাংলাদেশের মেয়েদের জন্য এটা বড় প্রাপ্তিই মানছেন বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল কমিটির কো-চেয়ারম্যান মাহফুজা আক্তার কিরণ, ‘মহিলা ফুটবলের যে ধারাবাহিকতা অব্যাহত আছে, এটা তারই পুরস্কার। তিনি বলেন, ‘আমাদের মেয়েরা বিদেশের ক্লাবে খেলতে যাচ্ছে, এটা অনেক বড় পাওয়া। আশা করব, আগামী দিনগুলোতে আরও অনেকে বিদেশের মাটিতে খেলবে।’ সাবিনার এই উত্থান রূপকথার গল্পের মতোই। পাঁচ বোনের সংসারে তিনি চতুর্থ। স্বপ্ন ছিল চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু মেয়েকে পড়ানোর খরচ চালানোর সামর্থ্য ছিল না বাবা সৈয়দ গাজীর। অথচ সেই মেয়েই ফুটবল খেলে উপার্জন করছেন, সংসারের উন্নতিতে রাখছেন অবদান। বর্তমানে সাতক্ষীরা কলেজের দিবা-নিশি শাখায় উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছেন সাবিনা।
ডানপিটে সাবিনা স্কুলে ছেলেদের সঙ্গে ফুটবল খেলতেন। সেখানেই চোখ পড়ে জেলা ফুটবল কোচ ‘আকবর স্যারের’। তিনিই প্রথম ২০০৯ সালে ঢাকায় আনেন সাবিনাকে। সেবার খেলেন সিটিসেল জাতীয় মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপে। সর্বোচ্চ গোলদাতার পুরস্কার তো পেলেনই, বোনাস হিসেবে পরের বছর এসএ গেমসেও ডাক পেলেন সাবিনা। এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ধারাবাহিকভাবে খেলেছেন ঢাকা মহানগর মহিলা ফুটবল লিগে, কেএফসি জাতীয় মহিলা ফুটবলে হয়েছেন সেরা খেলোয়াড়। সর্বশেষ গত মৌসুমেও ১৭ গোল করে হন সর্বোচ্চ গোলদাতা। এ পর্যনৱ ঘরোয়া ফুটবলে ১১৬টি গোল করেছেন ‘গোলমেশিন’ খ্যাত সাবিনা। মেয়েদের উপার্জনেই সংসারটা চলছে সাবিনাদের। এতে এতটুকু আক্ষেপ নেই। বরং তৃপ্তির সঙ্গে বললেন, ‘আমরাই বাবার ছেলে। প্রথম মহিলা ফুটবলার হিসেবে বিদেশে খেলতে যাচ্ছি শুনে খুব খুশি আমার বাবা-মা।’ শুরুটা করে দিলেন সাবিনা। এবার তার পথ ধরে সানজিদা, লিপিদেরও এগিয়ে যাওয়ার পালা। ব্রাজিলের প্রমীলা ফুটবলার মার্তা সাবিনার আদর্শ। ব্রাজিলের মতোই একদিন বিশ্বে মাথা উঁচু করে খেলতে চান সাবিনারা।
ব্রেট লি হওয়ার পথে যাত্রা শুরু
পেসারহান্ট কর্মসূচিতে দ্রুততম বোলার হওয়ার পরই স্বপ্নটার কথা জানিয়েছিলেন ইবাদত হোসেন চৌধুরী। হতে চান ব্রেট লি’র মতো গতিময় বোলার। সেই স্বপ্ন পূরণের পথে কতটা এগোলেন তিনি? ১৭ জুলাই থেকে শুরু হওয়া বিসিবির হাইপারফরম্যান্স (এইচপি) স্কোয়াডে সুযোগ পেয়ে ইবাদত পা দিয়েছেন স্বপ্নযাত্রার প্রথম ধাপে। দলের অন্যদের মতো লিস্ট ‘এ’ কিংবা প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলার অভিজ্ঞতা তাঁর নেই। এমনকি ভাঙেননি বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সিঁড়িও। এইচপিতে সুযোগ মিলেছে ফাস্ট বোলার অন্বেষণ কর্মসূচিতে প্রথম হওয়ার সনদ পেয়েই। অবশ্য স্কোয়াডে থাকা আরেক পেসার নূর আলম সাদ্দামও এসেছেন পেসারহান্ট থেকে। তবে তিনি গত ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন ব্রাদার্সের হয়ে, ১০ ম্যাচে নিয়েছেন ১১ উইকেট।
পেসারহান্টে সর্বোচ্চ গতিতে (ঘণ্টায় ১৩৯.৯ কিলোমিটার) বোলিং করা ইবাদত পরে পেস বোলিং কোচ সরওয়ার ইমরানের অধীনে সুযোগ পান দুই সপ্তাহ অনুশীলন করার। এরপর একটা বিরতি। তবে বসে থাকেননি। প্রশিক্ষণ চালিয়ে গেছেন। তার পুরস্কারও পেয়েছেন ইবাদত। সুযোগ পেয়েছেন পূর্ণাঙ্গ সিরিজ খেলতে নিউজিল্যান্ড সফরে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলে। পূর্ণাঙ্গ সিরিজে লম্বা এক বহর নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিউজিল্যান্ডে। সেই বহরে সঙ্গী সিলেটের তরুণ ক্রিকেটার ইবাদত হোসেন। ইংল্যান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশ যেমন মিরাজকে তুরুপের তাস হিসেবে খেলিয়েছিল, ইবাদতও নিউজিল্যান্ডে তুরুপের তাস হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেন। দেখা যাক কী হয়!
আফিফকে যেন শুধু বোলার বানানো না হয়
একজন ক্রিকেটার পরিপূর্ণ অলরাউন্ডার হিসেবে দলে ঢুকলেও তাকে বোলিং করানোর পাশাপাশি বানানো হয় নিচের পজিশনের ব্যাটসম্যান। সাকিব, রিয়াদ, নাসির, শুভাগত, মিরাজসহ অনেকেই এই পজিশনে খেলছে। তার মধ্যে একমাত্র রিয়াদ ও সাকিবই নিজেদের যোগ্যতাবলে টপ অর্ডারে আসতে পেরেছেন। অথচ ক্রিকেট বিশ্বে অলরাউন্ডারদের ওপেনিং ব্যাট করার অহরহ উদাহরণ আছে। ইরফান পাঠান, শেবাগ, দিলশান, জ্যাক ক্যালিস, জয়সুরিয়া, আফ্রিদি, ওয়াটসনসহ অনেকেই ওপেনিং ব্যাটসম্যান। যারা ব্যাটে বলে নিজেদের সেরাটা দিয়েছেন সবসময়।
কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটে এমনটা কল্পনাও করা যায় না। উল্টো নাসির, শুভাগত ও মিরাজের মতো ব্যাটসম্যানকেও ব্যাট করতে হয় বোলারের পজিশনে, যা একজন ব্যাটসম্যানের জন্য চাপের জায়গা নিঃসন্দেহে। এই পজিশনে ব্যাট করে সবাই নিজের সেরাটা দিতে পারে না। উল্টো হারিয়ে যেতে হয়। অভিষেকেই মাঠ মাতানো আফিফ হোসাইনও সম্ভবত এই ভাবনাটা ভেবে রেখেছেন, না হলে বোলিংয়ে ৫ উইকেট নেয়া আফিফও কেন বলবেন, আগে আমি ব্যাটসম্যান, তারপর বোলার।