রেজানুর রহমান
একটি জাতীয় দৈনিকে দেশের প্রথমসারির চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। যার শিরোনাম ছিল ‘নির্মাতারা অপুর খোঁজ চান’। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে ঢাকাই চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় মুখ অপু বিশ্বাস। অনেকদিন ধরেই কোনো শুটিং করছেন না তিনি। নিজের ব্যবহৃত মোবাইল ফোনটি বন্ধ রেখে কোথায় যেন ডুব দিয়ে আছেন। এদিকে এ বছরের শুরুতে তিনি বেশকিছু শুটিং শুরু করেন। যেসব ছবির পরিচালকদের মধ্যে অনেকেই অপু বিশ্বাসের চরিত্র দৃশ্যায়নের জন্য অপেক্ষা করছেন। অনেকেই তার খোঁজ খবর নেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। অপু বিশ্বাস অভিনীত বেশকিছু ছবির কাজ বন্ধ রয়েছে। কারণ তিনি নিজে ছবিগুলোর মূল নায়িকা!
এত গেল অপু বিশ্বাসের কথা। দেশের আরেকজন জনপ্রিয় নায়িকাকেও খুঁজে পাচ্ছেন না নির্মাতারা। তার নাম পপি। একটি পত্রিকায় তাকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম দেয়া হয়েছে ‘অভিমান নিয়ে আড়ালে পপি’। প্রতিবেদনটি উল্লেখ করা হয়েছে ‘অনেকদিন ধরেই চিত্রনায়িকা পপিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পপিকে ফোনে খুঁজে পাওয়া যায় না এই ধরনের অভিযোগ প্রায়শই শোনা যায়। তবে কোথাও হারিয়ে যাননি তিনি। পপি নিজেই জানালেন সেই কথা। সাম্প্রতিক সময়ে কোনো ভালো কাজের প্রসৱাব তার কাছে না আসার কারণেই তিনি অনেকটা অভিমান করেই আড়ালে রয়েছেন। পপি বলেছেন, ‘আমি চলচ্চিত্রের মানুষ। দীর্ঘদিন ধরে মাধ্যমটিতে কাজ করছি। এখন একটু দূরে আছি। সময় হলেই আবার ফিরে আসব। আবার নিয়মিত চলচ্চিত্রে কাজ করবো। আমি কোথাও হারিয়ে যাইনি। এই সময়ের প্রযোজক যারা চলচ্চিত্রে কাজ করার প্রসৱাব দিচ্ছেন তাদের বেশির ভাগকেই আমি চিনি না। অর্থাৎ পেশাদার প্রযোজক এখন নেই বললেই চলে। এমনকি আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগে, কারা এখন চলচ্চিত্রে প্রযোজনা করছেন? অবশ্যই সময়ের ধারায় অনেক কিছুরই পরিবর্তন হবে। তবে সেই পরিবর্তনটা যেন ভালো কিছুর জন্যই হয়।
যে যাই বলুক এখনো বিনোদন মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্র এবং চলচ্চিত্রই প্রথম অবস্থানে রয়েছে। আমরা টেলিভিশনের পর্দায় যতই সিনেমা দেখি না কেন সময় ও সুযোগ পেলে বড় পর্দায় সিনেমা দেখার চেষ্টা করি। সে কারণে সিনেমার প্রতি সবার এত আগ্রহ। খুব বেশি দূরের কথা নয় ৮০-র দশকেও আমাদের দেশে সিনেমার প্রতি মানুষের ছিল সীমাহীন আগ্রহ। পারিবারিক বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল সিনেমা। হলে গিয়ে সিনেমা দেখার পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। অগ্রিম টিকেট কিনে এনে পরিবারের সকল সদস্য মিলে দল বেঁধে সিনেমা হলে যাওয়া, তারপর সিনেমা দেখে বাড়িতে ফিরে খাবার টেবিলে, আড্ডায় সিনেমার গল্প আর অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনয় নিয়ে মনৱব্য তর্ক করার মধ্যেই কেটে যেত কয়েকটা দিন। তারপর আবার আসে নতুন সিনেমা। হলে মুক্তি পায় নতুন সিনেমা। আবার দল বেঁধে সিনেমা দেখা…।
অনেকের ভাবনায় ছিল এভাবেই চলবে আমাদের সিনেমা। সে কারণে বোধকরি দূরদর্শী কোনো চিনৱা ভাবনাও ছিল না। অর্থাৎ আগামী ১০ বছরে সিনেমার গতিপথ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? এই ভাবনাও গুরুত্ব পায়নি। অথচ সময় পাল্টে গেল।
প্রিয় পাঠক, অনেকে হয়তো ভাবছেন লেখাটি শুরু হয়েছিল দেশের দুজন জনপ্রিয় অভিনেত্রীকে নিয়ে। হঠাৎ পেছনের ইতিহাস কেন? এসব ইতিহাসতো আমরা অনেকেই জানি।
প্রিয় পাঠক, সবিনয়ে বলতে চাই, আমরা অনেকেই অনেক কিছু জানি। কিন্তু সময়ের বাস্তবতায় পরিস্থিতি মোকাবিলায় অনেকেই উদ্যোগী হই না। আমাদের চলচ্চিত্রে আজকে এই যে এত সংকট, আমরা কি জানতাম না অথবা আমরা কি বুঝে উঠতে পারিনি। চলচ্চিত্র একদিন এ ধরনের সংকটের মুখোমুখি পড়বেই। একসময় দেশে টেলিভিশন ছিল একটি বিটিভি। সময়ের বাস্তবতায় চোখের পলকে দেশে অনেকগুলো টেলিভিশন চ্যানেলের জন্ম হলো। বিটিভি সপ্তাহে একটি পুরনো সিনেমা প্রদর্শন করতো। সেখানে বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল প্রায় প্রতিদিনই সিনেমা প্রদর্শন করতে থাকলো। যার ফলে ঘরে বসে সিনেমা দেখার অবারিত সুযোগ পেল দর্শক। এই যে একটা পরিবর্তন দেখা দিল তা মোকাবিলায় চলচ্চিত্রাঙ্গনে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়লো না। বরং আমাদের চলচ্চিত্রে অশ্লীলতা প্রদর্শনসহ নানা সংকট ঘনিভূত হতে থাকলো। অশ্লীল কুরুচিপূর্ণ চলচ্চিত্র নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেই আন্দোলন চলচ্চিত্রের উন্নয়নে কোনো প্রভাব ফেলতে পারলো না। হলের দুরবস্থা, নকল কাহিনির ছবি নির্মাণ, কুরুচিপূর্ণ অভিনয়সহ নানা কারণে দর্শক হল বিমুখ হতে শুরু করল। দর্শককে হলে ফিরিয়ে আনার কার্যকর কোনো উদ্যোগই দৃশ্যমান হলো না।
বর্তমান সময়ে আমাদের চলচ্চিত্রের গতিপথ নিয়ে শুধুই অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। যৌথ প্রযোজনার নামে পাশের দেশের শিল্পীদের এনে ছবি নির্মাণের ব্যাপারে অনেকেই অসনেৱাষ প্রকাশ করছেন। এ ব্যাপারে ব্যানার নিয়ে রাজপথেও নেমেছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তথ্যপ্রযুক্তির এই বিস্ময়কর যুগে কাউকে দমিয়ে রেখে নিজের মেধার দ্যুতি ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব নয়। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও বিষয়টি মাথায় রাখা জরুরি। যুগটাই মেধাবীদের। যে যত মেধাবী সে তত বেশি উপরে উঠবে অথবা নিজেকে ফোকাস করতে পারবে। যে কোনো পরিবর্তনে মেধা যেমন জরুরি তেমনি জরুরি সম্মিলিত প্রচেষ্টা। মোটকথা যা করব বুঝে করব। কাজটির প্রতি আমার একটি দায়বদ্ধতা আছে। আমি যেন সে ব্যাপারে সচেতন থাকি।
৯টার মানুষ এলেন ৮টা ৫০ মিনিটে। সেখানে একটি চলচ্চিত্রে মূল ভূমিকায় যিনি অভিনয় করবেন সেই নায়িকা লাপাত্তা। এমন যদি হোত যে তিনি চলচ্চিত্রটিতে অভিনয় শুরু করেননি। কাজেই অন্য কাউকে নিয়েও ছবিটি শুরু করা যায়। কিন্তু তাতো নয়। উল্লেখিত নায়িকা চলচ্চিত্রটিতে শুটিং করেছেন। মাঝপথে তিনি হাওয়া। প্রযোজক বেচারার কথা ভাবুন একবার। চলচ্চিত্রতো আর একজনকে দিয়ে হয় না। অনেক মানুষের প্রয়োজন পড়ে। কাজেই একদিন শুটিং বাতিল হলেই পরবর্তীতে অনেক ঝক্কি ঝামেলার মুখোমুখি হন পরিচালক প্রযোজক। আবার সবাইকে একত্রিত করতে হয়। একজন সময় দিতে পারলে অন্যজন বলেন তার সমস্যা আছে। বিশেষ করে অভিনেতা অভিনেত্রীদের কাছ থেকে নতুন করে সময় নেয়াটা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। এই বাস্তবতায় মূল অভিনেতা অভিনেত্রীকেই যদি না পাওয়া যায় তাহলে তো সমস্যার পাহাড় সৃষ্টি হয়।
এখানেই আসে নীতি ও নৈতিকতার প্রশ্ন। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় আমি আমার পেশার প্রতি কতটা কমিটেড। যে সময়ে আমাদের চলচ্চিত্রে নানা সংকটের মোকাবিলা করে এগিয়ে যাচ্ছে সে সময়ে শিল্পীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের উচিত নিজেকে স্পষ্ট একটি অবস্থানে দাঁড় করানো। আমি যা করছি তা কি ঠিক করছি? আমার কারণে অন্যেরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে না তো?
অপু বিশ্বাসের কথাই যদি ধরি…। তিনি আমাদের দেশের একজন নির্ভরযোগ্য চলচ্চিত্র তারকা। আমাদের চলচ্চিত্রে তার অনেক অবদান আছে। সে কারণেই তার অথবা তার মতো আর যারা আছেন তাদের প্রতি আমাদের চাওয়া পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রত্যাশাটাও বেশি। একজন শিল্পী আসলে একজন মানুষ। তারও ব্যক্তিগত সুবিধা অসুবিধা আছে। সে কারণে তিনি হয়তো ভুল করবেন এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাকে তো পেশার প্রতি কমিটেড থাকতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট পড়ে মনে হয়েছে অপু বিশ্বাস কাউকে কিছু না জানিয়ে হঠাৎ ডুব দিয়েছেন। ফলে বিপাকে পড়েছে তার শুটিং শুরু করা ছবির প্রযোজক, পরিচালকেরা। তার চেয়েও বড় কথা এ ধরনের ঘটনায় চলচ্চিত্রের মতো একটি বড় মাধ্যম বিতর্কিত হচ্ছে। আলোচনা সমালোচনার ডালপালা বিসৱৃত হচ্ছে। গুজব ছড়িয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। অপু বিশ্বাসকে কেন্দ্র করে নানামুখি গুজব এখন বেশ সক্রিয়। গুজব এক. অপু বিশ্বাস বিয়ে করেছেন। বরের সঙ্গে ভারতে চলে গেছেন। গুজব দুই. অপু বিশ্বাস অনেক আগেই বিয়ে করেছেন। বাচ্চার মা হবেন বলে আড়ালে অবস্থান করছেন। গুজব তিন. অপু বিশ্বাস সনৱানের মা হয়েছেন। তাই নিজেকে গুছিয়ে নেয়ার জন্য আড়ালে রয়েছেন। গুজব চার. শাকিব খানের সঙ্গে অপু বিশ্বাসের বিয়ে হয়েছে। তাই তিনি নিজেকে আড়ালে রেখেছেন। গুজব পাঁচ. ইদানিং শাকিব খান অন্য নায়িকার সঙ্গে বেশি অভিনয় করছেন তাই অভিমান করে অপু বিশ্বাস নিজেকে আড়ালে রেখেছেন। আমরা কোনো গুজবেই কান দিতে চাই না। আমরা চাই শিল্পের প্রতি পেশার প্রতি দায়বদ্ধতা। বিয়ে জীবনের একটি সুন্দরতম অধ্যায়। এ ব্যাপারে রাখঢাক করার কোনো মানে হয় না। একজন শিল্পীর মনে রাখা উচিত তার ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর অনেক কিছুই নির্ভর করে। কাজেই তার এমন কিছু করা উচিত নয় যা চলচ্চিত্রাঙ্গনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
আমরা মনে করি পরিবারে সংকট থাকে, সংকট আসে। পরিবারের বাইরে থেকে এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। পরিবারে থেকেই সংকট মোকাবিলা করতে হবে।
চলচ্চিত্র আমাদের অতি আদরের একটি গণমাধ্যম। অথচ অনাদর ও অবহেলায় মাধ্যমটির বড়ই কাহিল অবস্থা। মাধ্যমটির ব্যাপারে আমরা শুধুই অভিযোগ করি। এটা হচ্ছে না, ওটা হচ্ছে না… শুধু অভিযোগ। কিন্তু নিজের কি করা উচিত একবারও ভাবি না। যৌথ প্রযোজনায় ছবি নিয়ে অনেক বিতর্ক হচ্ছে। এই বিতর্কের অবসান হওয়া দরকার। আরও জরুরি যুগের প্রয়োজনে আমরা কতটা তৈরি হয়েছি তা দেখা। কারিগরি সুযোগ সুবিধা থেকে শুরু করে অভিনয় ও ছবি পরিচালনার ক্ষেত্রেও আমরা কতটা এগিয়েছি তা পর্যালোচনা করা সময়ের দাবি। গত ঈদে ‘শিকারী’ নামে যৌথ প্রযোজনার একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল। ছবিটি দেখে অনেকে মনৱব্য করেছেন এ ধরনের কারিগরি মানসম্পন্ন অ্যাকশন ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে ঢাকার সিনেমাপাড়া এখনো তৈরি নয়। তাই যদি হয় সেটি হবে আশঙ্কার কথা। সবচেয়ে বড় কথা এই দেশের চলচ্চিত্র বিকশিত হোক আমরা মনেপ্রাণে সেটা বিশ্বাস করছি কি না।
এটি বাস্তব গল্প। কিন্তু এই বাস্তবতা এখন কারও কাম্য নয়। এখন প্রয়োজন চলচ্চিত্রের মানুষগুলোর মধ্যে আরো বেশি আনৱরিকতা, সহমর্মিতা। একজনের পাশে অন্যকে দাঁড়িয়ে যেতে হবে। একদিন যে মাধ্যম আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে তার বিকাশের স্বার্থে আমার এখন কিছু করা জরুরি। এই সাধনায় সকলের মনসংযোগ জরুরি।
জয় হোক বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের।