পাহাড়ের প্রাণ-প্রকৃতি

-মুকিত মজুমদার বাবু

দৃষ্টিনন্দন অবারিত সবুজের হাতছানি, কলকল, ছলছল করে নিরনৱর বয়ে চলা মিষ্টি পানির ঝরনা, সর্পিল নদী, বৃক্ষরাজি, উঁচু নিচু পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে চলা বন্ধুর পথ, পাখ-পাখালির কলরবে মুখরিত চারদিক, বুনো ফুলের মাতাল গন্ধ, কোথাও বন্যপ্রাণীর বিচিত্র ডাক, জুমের জমিতে সোনালি ফসলের হাসির ঝিলিক আর পাহাড়ের ঢাল সমতল করে কখনো কখনো ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির আবাস। এইতো পাহাড়। সবুজ পাহাড়। বৈচিত্র্যময় পাহাড়। পাহাড়ের নান্দনিক এই পরিবেশ দেশের অন্য যেকোনো পরিবেশের চেয়ে আলাদা। পাহাড়ের প্রকৃতির সান্নিধ্য যেন মানুষকে করে তোলে এক অন্য জগতের বাসিন্দা, অন্য আদলের মানুষ।

পৃথিবীতে প্রায় ৩৭০ মিলিয়ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির মানুষ বসবাস করছে ৭০টি দেশে। বাংলাদেশে রয়েছে প্রায় ২৬ ভাষাভাষীর ৪৫ জাতিসত্তার ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি, যার সংখ্যা প্রায় ১ মিলিয়ন বা মোট জনসংখ্যার ১ ভাগ। এদের মধ্যে চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি। চাকমা ছাড়া মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, মনিপুরী, কুকি, রাখাইন, গারো, সাঁওতাল, হাজং, বম, ত্রিপুরা উল্লেখযোগ্য। এদের বেশির ভাগ পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে। আবার সিলেট ও উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় এদের দেখা যায়। বংশানুক্রমে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির লোকেরা এসব এলাকাতে বসবাস করে আসছে। পাহাড়ি পরিবেশের সাথে এদের জীবন, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, সংস্কৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বলতে গেলে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা এইসব ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির মানুষ প্রকৃত অর্থেই প্রকৃতির সনৱান।

বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির পোশাক-আশাক, দৈনন্দিন জীবন যাপন, খাদ্যাভ্যাস, ঘরবাড়ির ধরণ প্রায় সবকিছুই সমতলে বসবাসরত মানুষের চেয়ে আলাদা। পাহাড়ের গায়ে গায়ে মাটি থেকে একটু উঁচুতে তৈরি করা ঘরগুলো প্রায় সবই বাঁশ বা কাঠের। বন্য জীবজন্তু থেকে রক্ষা পাবার জন্যই হয়তো ঘরগুলো উঁচুতে বানানো। প্রায় প্রতিটি ঘরের সামনেই মাচার মতো একটি বাসার জায়গা যেখানে বসে তারা নিত্যদিনের কাজকর্ম অথবা অবসরের অলস আড্ডা দেয়। দূরের দিকে তাকিয়ে দেখে প্রকৃতির অপরূপ সাজ।

খাদ্যের জন্য ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির মানুষ প্রকৃতির ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। জুমচাষ তাদের প্রধান পেশা হলেও বংশানুক্রমেই তারা পাহাড়ে জন্মানো বিভিন্ন লতাপাতা, সবজি, ফলমূল খেয়ে আসছে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই জুমচাষের সাথে কোনো না কোনোভাবে জড়িত। পাহাড়ের ঢালে জুম পদ্ধতিতে তারা বিভিন্ন ধরনের ফসল উৎপাদন করে এবং উৎপাদনকৃত ফসল স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে। নারী-পূরুষ সবাই কঠোর পরিশ্রমী। ভোর হতেই পিঠে ঝুড়ি বেঁধে কাজের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। নিজেদের তৈরি ঝুড়িগুলো তারা বিভিন্ন জিনিসপত্র বহনের কাজে ব্যবহার করে। মহিলারা কাজের সময় বাচ্চাদের কাপড় দিয়ে পিঠের সাথে পেঁচিয়ে রাখে। নানা সমস্যার মধ্যে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির অন্যতম সমস্যা হলো পানি সংকট। পানির জন্য নদী বা পাহাড়ি ঝরনার ওপর তাদের নির্ভর করতে হয়। আর এ কারণেই যেখানে ঝরনা বা নদী রয়েছে তার আশেপাশেই জনবসতি গড়ে ওঠে। ঝরনাগুলো স্থানীয়দের কাছে ছড়া নামে পরিচিত। কাপড় কাচা, গোসল করা, খাওয়া ও রান্না-বান্নাসহ দৈনন্দিন কাজে তারা ঝরনার পানির ওপর নির্ভরশীল।

ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির মধ্যে বাংলাদেশে সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি চাকমা। শিক্ষা-দীক্ষা, সামাজিক ও আর্থিক অবস্থানের দিক থেকে তারা অন্যদের তুলনায় বেশখানিকটা এগিয়ে রয়েছে। আজকাল অন্যান্যদের মধ্যেও শিক্ষার হার বাড়ছে।

প্রতিটি জাতিসত্তাই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এদের রয়েছে নিজস্ব রীতি-নীতি, পোশাক, ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম। নিজস্ব ভাষা থাকলেও কোনো কোনো জনগোষ্ঠির নেই কোনো লিখিত বর্ণমালা। তবে বেশির ভাগ জনগোষ্ঠিরই রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা, ছড়া, গল্প, কবিতা, নাচ ও গান। অধিকাংশ ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির মানুষ নিজেদের কাপড় নিজেরাই বুনে। কাপড় বুনায় তারা তাদের নিজস্ব সুতা ও রঙ ও রুচিকে প্রাধান্য দেয়। তাদের রঙ-বেরঙের বাহারি পোশাক সত্যিই আকর্ষণীয়। সিলেট অঞ্চলের মনিপুরী সম্প্রদায় তাদের ঐতিহ্যবাহী বর্ণিল পোশাক ও ভিন্ন সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের জন্য সারাদেশে বহুল পরিচিত। ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির মহিলারা গহনা পরতে ভালোবাসে। তাদের মধ্যে সোনা, রূপা, ব্রোঞ্জ, লোহা ছাড়াও বিভিন্ন ধাতুর তৈরি অভিনব নকশার ঐতিহ্যবাহী গহনা পোশাকের সাথে মিলিয়ে পরার প্রচলন রয়েছে।

দৈনন্দিন কাজে ব্যবহারের জন্য তারা বাঁশ, বেত ও কাঠের তৈরি বিভিন্ন জিনিসপত্র ব্যবহার করে, যেগুলো তাদের নিজেদেরই তৈরি। ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির এই ভিন্ন সংস্কৃতি ও ভাষা দেশীয় সংস্কৃতিকে করেছে সমৃদ্ধ ও বৈচিত্র্যময়। ধর্ম ও সংস্কৃতি অনুযায়ী তারা বিভিন্ন উৎসব পালন করে যার আচার-আচরণ লক্ষণীয়। কিছু কিছু গোষ্ঠির মানুষ প্রকৃতিকে পূজা করে। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে বলেই প্রকৃতির গুরুত্ব তাদের কাছে অনেক বেশি।

প্রকৃতির সাথে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠির সম্পর্ক গভীর। নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার্থে বনাঞ্চল টিকিয়ে রাখা তাদের ঐতিহ্যগত বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির মতোই তারা সহজ-সরল। কিন্তু বর্তমানে প্রকৃতি যে আগের মতো নেই এটা তাদেরও উপলব্ধিতে এসেছে।

যুগযুগ ধরে প্রকৃতি থেকে প্রাপ্ত জ্ঞান দিয়েই ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠি জীববৈচিত্র্য রক্ষা করে এসেছে তা জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অন্যান্য পারিপার্শ্বিক কারণে আজ হুমকির মুখে। পাহাড়ি জীবন, ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রাকৃতিক সম্পদের সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে প্রকৃতি ও জীবনের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটানোই পারে জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে।

 লেখক: চেয়ারম্যান, প্রকৃতি ও জীবন ফাউন্ডেশন

  • প্রকৃতি কথা
Comments (০)
Add Comment