আমাদের নায়করাজ

রেজানুর রহমান: খুলনায় মেয়ে জামাইয়ের বাড়ি থেকে ফিরছিলেন তিনি। সঙ্গে আদরের ছোট ছেলে। ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। হঠাৎ তিনি ড্রাইভারকে বললেন, অ্যাই গাড়ি থামাও তো… ড্রাইভার গাড়ি থামালো। ছেলেকে সাথে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে সামনে হাঁটতে থাকলেন।

ছেলে জিজ্ঞেস করলো, বাবা আমরা কোথায় যাচ্ছি?

তিনি মৃদু হেসে বললেন, আয় খোলা মাঠে বসে চা খাই।

ছেলে বাবার এই অভ্যাসের কথা জানে। সে এও জানে একটু পরে তার বাবাকে আশেপাশের মানুষজন ঘিরে ধরবে। একজনের দেখাদেখি অন্যজন দৌড়ে আসবে। রীতিমতো ভীড় লেগে যাবে।

হলোও তাই। তিনি ছেলেকে নিয়ে রাসত্মার ধারে একটা চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়ালেন। দোকানদারকে বললেন, ভাই আমাদেরকে দু’কাপ চা দাওতো।

দোকানদার গরম পানি দিয়ে চায়ের কাপ ধুয়ে নিলেন। তারপর চায়ের কাপে প্রথমে চিনি তারপর দুধ ঢাললেন। লোকটাকে কেন যেন চেনা চেনা মনে হচ্ছে। দোকানের সামনে বেঞ্চের ওপর বসে কয়েকজন চা খাচ্ছে আর গল্প করছে। তাদেরই একজন গভীর আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করলেন, স্যার আপনি এখন কেমন আছেন?

তিনি মৃদু হেসে লোকটিকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, আপনি আমাকে চিনেন?

এর মধ্যে একজন দুইজন করে প্রায় ২০/২৫ জন মানুষ চায়ের দোকানটির সামনে জড়ো হয়েছে। তাঁরা একজন অন্যজনকে ফিসফিস করে কিছু একটা বলছে। তাদেরই একজন সাহস করে বলল, স্যার আপনাকে কে না চিনে? আপনার জন্য জীবনে কত মাইর খাইছি…

আমার জন্য মার খেয়েছেন? কেন? বিস্ময় প্রকাশ করলেন তিনি। সাথে সাথে ভীড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে থাকা অন্য একজন বলল, আপনার সিনেমা দেখতে গিয়াই তো মাইর খাইছি। আপনার এক সিনেমা যে কতবার দেখেছি… এই যেমন ধরেন ‘ময়নামতি’, ‘অবুঝ মন’, ‘বেহুলা’, ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘এতটুকু আশা’, ‘নীল আকাশের নীচে’…

একজনের দেখাদেখি অন্যজন সিনেমার নাম বলেই যাচ্ছে। বলতে গিয়ে একজন থামলে অন্যজন তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। চায়ের দোকানের সামনে রীতিমতো একটা বড় জটলা দেখা দিল। ভীড় থেকে বেড়িয়ে একজন তরুণ মোবাইল ফোনে পরিচিত কাউকে খবরটা জানাল, আরে ব্যাটা তাড়াতাড়ি আয়। সিনেমার বড় নায়ক আসছে। হ…ভীড় লাইগ্যা গেছে… আয় তাড়াতাড়ি আয়…। আশেপাশের এলাকা থেকে জটলার দিকে আরো লোকজন দৌড়ে আসছে। সবাই নায়ককে এক নজর দেখতে চায়।

চায়ের দোকানদার বেশ খুশি হয়েছে। একেই বলে ভাগ্য। তরুণ বয়সে সিনেমায় যার অভিনয় দেখে ভবিষ্যতে কত কল্পনাই না করেছ। একবার যদি এই নায়কের সাথে দেখা হতো। তাকে ছুঁয়ে দেখতাম। তাঁকে জিজ্ঞেস করতাম, আপনি কেমন কইর‌্যা এতো ভালো অভিনয় করেন। আর আপনার মুখের হাসিটা… আহ! দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। দোকানদার গরম পানি ঢেলে নতুন করে আবার চায়ের কাপ ধুয়ে নিলেন। তারপর দুই কাপ চা বানিয়ে স্বপ্নের নায়ক আর তাঁর ছেলের দিকে বাড়িয়ে দিলেন। স্যার চা খান।

লোকজনের ভীড় ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সবাই শুধু দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। কেউ ভীড় ঠেলে স্বপ্নের নায়ককে একনজর দেখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। তাদেরই একজন ভীড় ঠেলে এসে দাঁড়াল। প্রশ্ন করলো, স্যার আপনার শরীর এখন কেমন? আপনার জন্য আমরা স্যার আল্লাহর কাছে অনেক দোয়া করছি। কিছুদিন আগে আপনি অসুস্থ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হইছিলেন। আমরা আপনার সব খবর জানি। দোয়া করি আল্লাহ আপনাকে আরো অনেক বছর বাঁচায়া রাখুক।

তিনি অভিভূত। দেশের মানুষ তাঁকে এতো ভালোবাসে? ছেলের দিকে তাকালেন। ছেলের গোটা অবয়বে গর্ব আর আনন্দের ঝিলিক। ছেলে বলল, আব্বা, চল যাই।

ছেলের কথায় সায় দিলেন তিনি। হ্যাঁ, এবার উঠা দরকার। মৃদু হেসে সবার দিকে তাকালেন। বললেন, এবার আমরা যেতে চাই।

ভীড়ের মধ্য থেকেই একজন তরুণ উদ্যোগী হয়ে যাবার পথ করে দিল। চায়ের বিল দিতে গিয়ে অবাক হলেন তিনি। দোকানদার বিল নিতে চাচ্ছে না। বরং সে চাচ্ছে তার স্বপ্নের নায়ক আরো কিছুক্ষণ বসে থাকুক। সেটা সে প্রকাশও করল, স্যার আমার অনেক সৌভাগ্য যে আপনি আমার দোকানে বইস্যা চা খাইছেন। আর কিছু খান স্যার। কলা আছে, বিস্কুট আছে… আপনার ময়নামতি ছবিটা স্যার বিশবার দেখছি। আর ‘ঐ যে এতটুকু আশা’… একটা গান আছে, ‘তুমি কি দেখেছ কভু জীবনের পরাজয়’… গানটার জন্যই স্যার কতবার যে ছবিটা দেখছি তার হিসাব নাই…

এবার যেন শুরু হয়ে গেল ছবির নাম বলার প্রতিযোগিতা। কে কোন ছবি কতবার দেখেছে তা হর হর করে বলে যাচ্ছে। তিনি এবার আরো বেশি অবাক হলেন। কারণ এই মানুষগুলো এমন সব সিনেমার নাম বলছেন, যার কথা তিনি অনেকটা ভুলে গেছেন।

ভীড়ের মানুষগুলো নায়ককে তার গাড়ি পর্যনত্ম এগিয়ে দিলেন। নায়ক তার ছেলেকে নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। গাড়ি ছেড়ে দিবে এমন সময় ভীড় ঠেলে এগিয়ে এলেন এক বৃদ্ধ। হাফাচ্ছেন তিনি। বোধকরি দূর থেকে দৌড়ে এসেছেন। হাফাচ্ছেন।

স্যার আপনাকে একনজর দেখার জন্য দৌড়াইয়া আসছি। আপনি কেমন আছেন?

নায়ক মৃদু হেসে বললেন, আল্লাহর রহমতে ভালো আছি…

ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। লোকগুলো হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছে তাদের প্রিয় নায়ককে। ছেলের মুখের দিকে তাকালেন নায়ক, কিরে কী বুঝলি?

ছেলে বাবার হাতে নিজের হাত রাখল। বলল, আই লাভ ইয়্যু আব্বা…

নায়ক ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করতে করতে হঠাৎ যেন সেই অতীতে ফিরে গেলেন। রেলগাড়ির ঝকঝক… ঝকঝক… শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। ঐতো ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে থামলো ট্রেনটি।

তার সাহস আছে বলতে হবে। সাহসের পাশাপাশি জীবন যুদ্ধে জয়ী হবার জেদও ছিল। তা নাহলে কেউ কী স্ত্রী আর ৮ মাসের শিশু সনত্মানকে নিয়ে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়? থাকতেন কলকাতায়। সেখানে মঞ্চে নাটক করতেন। স্বপ্ন দেখতেন সিনেমায় অভিনয় করবেন। কলকাতায় একবার হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়। মনটা ভেঙ্গে যায় তার। সিদ্ধানত্ম নেন আর কলকাতায় থাকবেন না। বোম্বে চলে যাবেন। কিন্তু নাট্যগুরুর পরামর্শে বোম্বে না গিয়ে কলকাতা থেকে স্ত্রী ও ৮ মাসের শিশুপুত্রকে নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ট্রেনে চেপে ঢাকায় ফুলবাড়িয়া রেল স্টেশনে নেমে কোথায় উঠবেন সেটাও ঠিক করতে পারছিলেন না। একসময় আশ্রয় মেলে এক কামরার একটি ছোট্ট বাসায়। এভাবেই শুরু হয় বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে জীবনত্ম কিংবদনত্মী হয়ে ওঠা একজন চিত্রনায়কের জীবনযুদ্ধ। তিনি নায়করাজ রাজ্জাক।

চলচ্চিত্রে অভিনয় করবেন বলেই কলকাতা থেকে ঢাকায় এসেছিলেন। তার জীবন সংগ্রাম ‘এলাম আর জয় করলাম’ এর মতো এতো সহজ ছিল না। বরং বলা যায় জিরো থেকে হিরো হয়েছেন তিনি। শুরুর দিকে সিনেমায় একটি ছোট্ট চরিত্রে অভিনয় করার জন্য কত চেষ্টাই না করেছেন। কিন্তু কেউ যেন তাকে পাত্তাই দিচ্ছিলেন না। নিজের প্রতিভা প্রকাশের পথ খুঁজে বের করার জন্য ব্যসত্ম পরিচালকের ৪র্থ সহকারীর দায়িত্ব পালন করেছেন। যার কাজ ছিল মূলত সিনেমার ক্যান নিয়ে পরিচালকের পিছনে ঘুরে বেড়ানো। অভিনেতা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করার জন্য বেশ কয়েকটি ছবিতে পাসিং শর্টও দিয়েছেন। তবুও যেনো কিছুতেই কিছু হচ্ছিলো না।

কথায় বলে সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে। নায়ক রাজের বেলায় এই কথাটি খুবই সত্য। ঢাকায় এসে তিনি যখন অভিনয়ের কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তখন বার বার সাহস যুগিয়েছেন প্রিয়তমা স্ত্রী লক্ষ্মী। তার নামটা যেমন সুন্দর তেমনি সুন্দর তার মন। লক্ষ্মী যেনো লক্ষ্মীর মতোই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন নিজের সংসারে। সীমাহীন কষ্টের মধ্যেও স্বামীকে সাহস যুগিয়েছিলেন হতাশ হয়ো না। আল্লাহ একদিন নিশ্চয়ই মুখ তুলে চাইবেন। আমাদের সুদিন আসবেই…

হ্যাঁ সৃষ্টিকর্তার অপার কৃপায় নায়করাজ চলচ্চিত্রে তার প্রতিভার দ্যুতি ছড়ানোর সুযোগ পান। একপর্যায়ে অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে একদিন যারা তাঁকে পাত্তাই দেয়নি সেই পরিচালকরাও তাঁদের ছবিতে নেয়ার জন্য রীতিমতো লড়াই শুরু করেন। যে পরিচালকের সাথে ফোর্থ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছেন, যার কাছে নায়করাজ বার বার বলেছিলেন আমি অভিনয়ের জন্য একটা সুযোগ চাই সেই পরিচালক এক পর্যায়ে রাজ্জাককে নিজের ছবিতে নায়ক করার জন্য অনুরোধের ঝাপি খুলে ধরেন। উর্দু ছবির দাপটে বাংলা ছবি তখন খুবই করুণ অবস্থা। বাঙ্গালী নামকরা পরিচালকেরাও বাধ্য হয়ে উর্দু ছবি নির্মাণে আগ্রহী হচ্ছিলেন। এই সময় বাংলা ছবির জাদুকর হিসেবে আবির্ভূত হন রাজ্জাক। বলা যায় স্রোতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে রাজ্জাককে বেহুলা নামের একটি ছবিতে নায়ক বানান জহির রায়হান। ছবিটা সুপার ডুপার হিট হয়। এরপর রাজ্জাককে নিয়ে একের পর এক বাংলা ছবি নির্মাণ করতে থাকেন ব্যসত্ম পরিচালকেরা। সব ছবিই হিট হতে থাকে। একজন রাজ্জাকই পুরো একটা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে পতনের হাত থেকে রক্ষা করেন। একসময় রাজ্জাকের কারণেই বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রি আবার জেগে ওঠে। এ যেনো সত্যি এক জাদুকরের গল্প। যেখানেই হাত দেন সেখানেই সোনা ফলে। অথচ জাদু নয়, সত্যি গল্প। সিনেমায় একটি ছোট্ট চরিত্র করার জন্য যিনি পরিচালকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন সেই পরিচালকরাই এবার তাঁর পেছনে ঘোরা শুরু করে। এমনো হয়েছে দিনে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ২০ ঘণ্টা শিফট ভাগ করে একাধিক ছবির স্যুটিং করেছেন রাজ্জাক। এফডিসিতে তার বিশ্রামের জন্য একটি রুমের ব্যবস্থাও করা হয়েছিল।

বয়স কিন্তু কম হলো না। ২৩ জানুয়ারি ৭৫ বছরে পা দিবেন আমাদের নায়করাজ। কিছুদিন আগে হঠাৎ তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে ওঠেন। হাসপাতালে ছিলেন কিছুদিন। এখন গোটা দেশে তাকে নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছিল। নায়করাজ রাজ্জাক বর্তমানে মোটামুটি সুস্থ। কয়েকদিন আগে আমরা গুলশানে তাঁর বাসভবন লক্ষ্মীকুঞ্জে গিয়েছিলাম। মুখে সেই প্রাণ জুড়ানো হাসি ছড়িয়ে আমাদেরকে অভ্যর্থনা জানান বাংলা ছবির জীবনত্ম কিংবদনত্মী হয়ে ওঠা আমাদের গর্বের ধন নায়করাজ রাজ্জাক। তার স্ত্রী লক্ষ্মীর সাথেও আমাদের দেখা হয়। লক্ষ্মী যেনো লক্ষ্মীর মতোই একজন সাধারণ নারী। নায়করাজের স্ত্রী তিনি। অথচ এতটুকু অহংকার নাই। তার সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে মৃদু হেসে বিনয় প্রকাশ করলেন, আমি কী বলব? অনেক অনুরোধের পর সামান্য কথা বললেন। সবটাই স্বামীর গুণগান।

নায়করাজের সাথে আমাদের দীর্ঘক্ষণ কথা হলো। সেই ফুলবাড়িয়া রেলস্টেশনে ট্রেন থেকে নামা, তারপর ঢাকার সেই কষ্টের জীবন, অবশেষে সিনেমায় নায়ক হয়ে ওঠা… রাজ্জাক বলে চলেছেন। চলমান ছবির মতো আমরা যেন সব কিছুই দেখছিলাম। জীবনের গল্প বলতে গিয়ে নায়করাজ মাঝে মাঝেই আবেগ তাড়িত হয়ে উঠছিলেন। তখন কষ্টের বেদনায় চোখ মুছেছি আমরাও।

বাংলাদেশ আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির যে কোনো সাফল্যে আনন্দে কেঁদে ফেলেন নায়করাজ। দেশীয় চলচ্চিত্রের ছোটখাটো সাফল্যের কথা শুনলে যাকেই কাছে পান তাকেই খবরটা শোনান। ক্রিকেটে যেদিন বাংলাদেশ জিতে সেদিন তার আনন্দের সীমা থাকে না। খেলা দেখার সময় আনন্দে চোখের পানিও ধরে রাখতে পারেন না।

এমনি আবেগী মানুষ আমাদের নায়করাজ। ২৩ জানুয়ারি তাঁর ৭৫তম জন্মদিন। আনন্দ আলোর পক্ষ থেকে তাঁকে জন্মদিনের অনেক শুভেচ্ছা। শুভ শুভ শুভদিন, ২৩ জানুয়ারি নায়করাজের জন্মদিন।

  • প্রচ্ছদ মুখ
  • শীর্ষ কাহিনি
Comments (০)
Add Comment