Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

আর্কেশিয়া স্থাপত্য পুরস্কার ২০২৩ দুটি স্বর্ণপদক পেলেন স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার

স্থাপত্যের জন্য এশিয়ার মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার “আর্কেশিয়া স্থাপত্য পুরস্কার ২০২৩” এ দুটি স্বর্ণ পদক পেল কারুপণ্য রংপুর লিমিটেড গ্রিনফিল্ড ফ্যাক্টরি। বাংলাদেশের খ্যাতিমান স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার ডিজাইন করেছেন পরিবেশ বান্ধব এই কারখানাটির। তিনি নকশাবিদ আর্কিটেক্টস এর প্রধান স্থপতি। ফিলিপাইনের বোরাকা আইল্যান্ডে নিউকোস্ট কনভেনশন সেন্টারে আর্কিটেক্টস রিজিওনাল কাউন্সিল এশিয়ার ২০তম কংগ্রেসে এই পুরস্কার প্রদান করা হয়। সামাজিক দায়বদ্ধ স্থাপত্য প্রকল্পের জন্য বিশেষ পুরস্কার হিসেবে কারুপন্য রংপুর লিমিটেডের গ্রিন ফিল্ড ফ্যাক্টরি প্রকল্পের স্বীকৃতি স্বরুপ স্বর্ণপদক পদক জিতেন বায়েজিদ। তিনি শিল্প প্রতিষ্ঠান ক্যাটাগরিতেও বিজয়ী হয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন। এছাড়াও বাংলাদেশের আরও তিন স্থপতি মোস্তফা আমীন, স্থপতি ইকবাল হাবিব ও স্থপতি ইশতিয়াক জহিরও অন্যান্য ক্যাটাগরিতে সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছেন। বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার ২০২২ সালে “ইউআইএ ২০৩০” পুরস্কার পেয়েছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব আর্কিটেক্টস (ইউআইএ) এবং ইউএন হ্যাবিটেট যৌথ ভাবে কারুপণ্যের সবুজ কারখানার জন্য এ পুরস্কার দিয়েছিল। নারায়নগঞ্জের আমান মসজিদের জন্য গত বছর ৩১তম জেকে সিমেন্ট আর্কিটেক্ট অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ডস পেয়েছিলেন তিনি। এবার শাহ্ সিমেন্ট ‘নির্মাণে আমি’তে আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান এই স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন। লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক

বাংলাদেশের স্বনামধন্য স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার। দীর্ঘ দুই দশকের বেশি সময় ধরে আধুনিক স্থাপত্য শিল্পে সৃষ্টিশীল কাজ করে যাচ্ছেন নিজের স্বতন্ত্র ধারা বজায় রেখে। ১৯৯৬ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। স্বাধীন ভাবে কাজ করার তাগিদে এক সময় সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে ২০০০ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘নকশাবিদ আর্কিটেক্টস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ইতোমধ্যে মূলতঃ ঢাকা এবং এছাড়াও চট্টগ্রাম, বগুড়া আর রংপুরে অসংখ্য বহুতল ভবনের নকশা করেছেন এই স্থপতি। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে রংপুরে রবার্টসন গঞ্জের কারুপণ্য লিমিটেডের কারখানা, ঢাকার বিজয়সরনীতে বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর, নারায়নগঞ্জের সোনারগাঁওয়ে বৈদ্যের বাজার এলাকায় আমান মসজিদ, মিরপুর-২ এ কিডনী ফাউন্ডেশন হসপিটাল, পান্থপথে পানি ভবন, মিরপুর-১৫ এ বিজয় রাকিন সিটি, উত্তরায় এবিসি হেরিটেজ, বসুন্ধরায় মাগুরা গ্রুপের কর্পোরেট ভবন, বগুড়ার গোহাইলে জামে মসজিদ। এছাড়াও নতুন কাজের মধ্যে রয়েছে সাভারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একাডেমী এন্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ বিল্ডিং বিপিএটিসি, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আর্মড ফোর্স ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের মিউজিয়াম কমপ্লেক্স এবং মনুমেন্ট প্রকল্প, কুড়িগ্রামে নর্থ বেঙ্গল মিউজিয়াম, নারায়নগঞ্জের কাঁচপুরে রাকিন ট্রানকুয়েল সিটি। বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘর তার কাজের অন্যতম নিদর্শন। প্রবীণ স্থপতি আলী ইমামকে সঙ্গে নিয়ে বায়েজিদ মাহবুব বঙ্গবন্ধু সামরিক জাদুঘরের কাজ করেছেন।
স্থপতি বায়েজিদ দেশের জন্য উপযুক্ত ও পরিবেশ বান্ধব নকশা প্রণয়ন করে যাচ্ছেন। তিনি স্থাপনার সৌন্দর্য, নির্মাণ ব্যয়, স্থাপনার স্থায়িত্বের পাশাপাশি পরিবেশ ও সামাজিক প্রভাব নিয়েও সমান ভাবে ভাবেন। কাজ করেন পরিসর আর পরিবেশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। তেমনই এক স্থাপনার উদাহরণ রংপুরে অবস্থিত কারুপন্য লিমিটেডের কারখানা। কংক্রিট, স্টিল, বাহারি গ্লাসের খোলসের পরিবর্তে সবুজের আবরণে ঘেরা এ স্থাপনা। শুধু মূল স্থাপনাই নয়, পুরো কারখানা চত্বরের আবহাটাই গ্রামের চিরচেনা আবহে পরিকল্পনা করা। জলধার গুলো যেন গ্রামের পুকুরের প্রতিরূপ।

স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার

ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকলেই সাত তলা ভবন। দেখে মনে হয় বিশাল কোনো সবুজ বাগান। নানা প্রজাতির গাছে ঢাকা পড়েছে ইট-পাথরের দালান। সাত তলা ভবনের দেয়ালজুড়ে ঝুলছে নানা রকম লতাপাতা। পরিবেশ বান্ধব কারখানার মধ্যেই কর্মীদের খাবার ও বিনোদনের জন্য আছে ভিন্ন ভিন্ন জায়গা। সেখানেও কাজ করছে শৈল্পিক ভাবনা। সব মিলিয়ে দারুন এক কর্মপরিবেশ। এটি রংপুর শহরের রবার্টসনগঞ্জের কারুপণ্য রংপুর লিমিটেডের কারখানা। নকশাবিদ আর্কিটেক্টস এর প্রধান স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকারের নকশায় গড়ে উঠেছে এই ভবন। এই ভবনের জন্য অজঅঝওঅ দুটি স্বর্ণপদক জিতেছেন তিনি।
কারখানার ভবন শীতল রাখতে প্রয়োগ করা হয়েছে বিশেষ এক স্থাপত্য কৌশল। এতে সাশ্রয় হচ্ছে কারখানাটির ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের ব্যবহার সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামিয়ে এনে একটি সবুজ কারখানা গড়ে তোলাই ছিল বায়েজিদের লক্ষ্য। সেভাবেই সাজানো হয় ভবনের অন্দর-বাহির। কারখানার স্থাপত্য নকশায় প্রয়োগ করা হয়েছে এমন বিশেষ এক কৌশল, যাতে কারখানার ভেতরে সহজে প্রবাহিত হয় বাতাস। নিচতলায় পুকুরের মতো বড় বড় চারটি জলধার রাখা হয়েছে। ১৫ হাজার বর্গ ফুটের জলধার গুলো এক সঙ্গে ধারণ করতে পরে পাঁচ লাখ লিটার পানি। কারখানায় শতরঞ্জি ডাইংয়ের কাজে ব্যবহারের পর আয়রনমুক্ত এই পানি জলধারে আসে। সবুজ গাছপালা আর এই পানির ওপর দিয়ে উড়ে আসা বাতাস ৩৭ ফুট ব্যাসার্ধের চারটি চক্রকারে শূন্য স্তম্ভের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে কারখানার ভেতরে। তারপর বিভিন্ন তলায় উঠে যায়। ফলে এসি বা ফ্যান ছাড়াই ভবনের বাইরের চেয়ে ভেতরের তাপমাত্রা ৪ থেকে ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমে যায়।
কারখানার নকশা প্রণয়নকারী স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার বলেন, এই শীতলীকরণ প্রক্রিয়ায় গ্রাম বাংলার লোকজ জ্ঞানই প্রয়োগ করা হয়েছে। গ্রামাঞ্চলে ভিটে বাড়ির দক্ষিণ দিকটি খোলা রাখা হয় এবং সেদিকে একটা পুকুর থাকে। গরম কালে পুকুরের ওপর দিয়ে বাতাস শীতল হয়ে এসে বাড়িতে প্রবেশ করে বেরিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী গরম বাতাস ওপরে ওঠে। আর শীতল বাতাস নিচে পড়ে থাকে। এই গরম বাতাস ছাদের ওপর চিমনির ভেতর দিয়ে বেরিয়ে যায়। ফলে পুরো ভবন শীতল হয়ে আসে।
স্থপতি বায়েজিদ মাহবুব খন্দকার বলেন, ছয় বছর আগে কারখানাটির নির্মাণ কাজ শেষ করি। আগেও ভবনটি একাধিক আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছে। এবার আর্কেশিয়ায় পেলাম দুটি স্বর্ণ পদক। সামাজিক দায়বদ্ধ স্থাপত্য প্রকল্পের জন্য বিশেষ পুরস্কার ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ভবন ক্যাটাগরিতে আরেকটি পুরস্কার। পুরস্কার পাওয়া নিশ্চয়ই আনন্দের একটা ব্যাপার। আন্তর্জাতিক সম্মান পাওয়া দেশের জন্য যথেষ্ট সম্মানের। নিজের জন্য তো বটে। ইট, কাঠ, বালু ও কংক্রিটের মাঝে খুঁজে ফেরেন প্রকৃতির সান্নিধ্য। আর তাই তার প্রতিটি স্থাপনায় থাকে সুবজের ছোঁয়া। প্রতিটি ডিজাইনের ক্ষেত্রে আলো, বাতাস, সবুজ প্রকৃতি বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন তিনি।