Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

রুখসানা সম্পার বাবুই বাসা

আধুনিক স্থাপত্য শৈলীর সমন্বয়ে স্থাপত্য শিল্পে যারা সৃষ্টিশীল কাজ করে চলেছেন তাদের মধ্যে রুখসানা সুলতানা সম্পা অন্যতম। ২০০০ সালে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। ২০১০ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘বাবুই বাসা’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ইতোমধ্যে এ প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। স্থাপত্যচর্চার পাশাপাশি শিক্ষকতাও করছেন শান্তমারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে। এবার শাহ্ সিমেন্ট ‘নির্মাণে আমি’তে এই স্বনামধন্য স্থপতিকে নিয়ে প্রতিবেদন লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
ইট, কাঠ, বালু ও কংক্রিটের মাঝে খুঁজে ফেরেন প্রকৃতির সান্নিধ্য। আর তাই তার প্রতটি স্থাপনায় থাকে সবুজের ছোঁয়া। প্রতিটি ডিজাইনের ক্ষেত্রে আলো বাতাস, সবুজ প্রকৃতি বিষয়কে দিয়ে থাকেন তিনি। স্থপতি রুখসানা সম্পা তিন ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট। তার গ্রামের বাড়ি খুলনা জেলায়। জন্ম ও বেড়ে ওঠা খালিশপুরে। সম্পার বাবার নাম শেখ মোখলেস আহমেদ। তিনি রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সচিব ছিলেন। মা রেহেনা বেগম গৃহিনী। ক্রিয়েটিভ কোনো কিছু করার উদ্দেশ্যে আর্কিটেক্ট হওয়া তার।
রাজশাহী পিএন গর্ভমেন্ট গার্লস হাই স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৯১ সালে। ১৯৯৩ সালে রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ডিসিপ্লিনে। ২০০০ সালে তিনি খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এর স্থাপত্য ডিসিপ্লিন থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পরই সম্পা যোগদেন স্বনামধন্য আর্কিটেক্ট এনামুল করিম নির্ঝর এর সিস্টেম আর্কিটেক্টস এ। সেখানে দুই বছর কাজ করার পর ২০০২ সালে রুখসানা সম্পা সিনিয়র আর্কিটেক্ট হিসেবে যোগ দেন পারটেক্স গ্রুপে। সেখানে তিনি সততা ও নিষ্ঠার সাথে ২০০৯ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ২০১০ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘বাবুই বাসা’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের দায়িত্ব পালন করছেন।
তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে নারায়নগঞ্জে সামারা ভিলেজ, নোয়াখালির চাটখিলে শিকড় বহুমুখী কমপ্লেক্স, রাজবাড়িতে বাংলাদেশ রেলওয়ের ১০০০ সিটির অডিটোরিয়াম, বসুন্ধরায় যমুনা ফিউচার পার্কে পারটেক্স রিলিউস শোরুম, সাভারে প্রফেসর শাহনাজ এর ডুপলেক্স বিল্ডিংয়ের ডিজাইন, গুলশানে হাইরাইজ বিল্ডিং, নাফকো গ্রুপের মাল্টি পারপাস হলের ইন্টেরিয়র ডিজাইন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ইউনাইটেড কর্মাশিয়াল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সিটি ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক, মার্কেনটাইল ব্যাংক এর ইন্টেরিয়র ডিজাইন, খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়রের অফিস ইন্টেরিয়র, পান্থপথে ছায়া অ্যাপার্টমেন্টে ডা: রেহান এর আবাসিক ভবনের ইন্টেরিয়র, গুলশান-২ এ লুসাকা গ্রুপের চেয়ারম্যানের আবাসিক ভবনের ইন্টেরিয়র, উত্তরায় ছয় তলা কর্পোরেট অফিসের ইন্টেরিয়র, নারায়নগঞ্জে রশিদ মঞ্জিল স্মৃতিস্তম্ভ, স্কুল সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছেন। এছাড়াও তিনি বর্তমানে বেশ কিছু নতুন প্রজেক্টের কাজ করছেন।
স্থাপত্যচর্চার পাশাপাশি শিক্ষকতাও চলছে। স্বনামধন্য এই স্থপতি শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার ক্লাস এবং মাস্টার্স অব ইন্টেরিয়র ডিজাইন এর ক্লাস নিচ্ছেন। ২০০০ সালে তিনি বিয়ে করেন। স্বামীর নাম সাজিদ বিন দোজা। তিনিও একজন স্বনামধন্য আর্কিটেক্ট। এই দম্পতি এক পুত্র সন্তানের জনক-জনন।

রুকসানা সুলতানা সম্পা

‘বাবুই বাসা’ সম্পর্কে স্থপতি রুখসানা সম্পা বলেন, আমার স্টুডিওটির নাম ‘বাবুই বাসা’। এই নামটি দেওয়ার গল্প বলতে গেলে প্রথমেই বাবুই পাখিটি সম্পর্কে বলতে হয়। বাবুই পাখিকে বলা হয় তাঁতী পাখি বা বুনন শিল্পী বা শৈল্পিক আর্কিটেক্টও বলা হয়। আবার এদেরকে কঠোর পরিশ্রমী পাখিও বলা হয়। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন বাবুই পাখি হচ্ছে পৃথিবীর সব থেকে নান্দনিক ও ক্রিয়েটিভ পাখি।
যে তার নান্দনিকতা ও ক্রিয়েটিভি দিয়ে তার বসবাসের জন্য সবচেয়ে টেকসই বাসা তৈরি করে যেটি আলো বাতাসে পরিপূর্ণ কয়েকটি প্রকোস্ট বিশিষ্ট একটি মজবুত বাসা। যেটাকে পৃথিবীর বেস্ট আর্কিটেকচার বললে মনে হয় ভুল হবে না। সাধারনত তাল গাছ বা উঁচু গাছের ডালে এরা বাসা তৈরি করে যা প্রচুর ঝড় বাতাসেও ভেঙ্গে যায় না, দুলতে থাকে। আবার এই বাসার ভেতরে অনেক গুলো কক্ষ থাকে। তবে যে কক্ষটিতে ডিম রাখা হয় সেটি একটু গভীরে থাকে, যাতে ডিম গুলো পড়ে না যায়। নল খাগড়া ও হোগলার পাতা ও খড় দিয়ে বাসাটা বুনন করে এই পাখি। গোলাকৃতির এই বাসার অবয়বটিকে পেট দিয়ে ঘষে মসৃন করে। আবার রাতের বেলায় আলোকিত করার জন্য ঘরের ভেতরে পুকুর পাড়ের কাঁদামাটি ঠোঁটে করে এনে এর ভেতরে বিভিন্ন জায়গায় লাগিয়ে তার উপরে জোনাকি পোঁকা আটকিয়ে দেয়। সাধারনত ছেলে পাখিটা তার ঠোঁট দিয়ে এই বাসা বুনে এবং কমপ্লিট হলে মেয়ে পাখিটাকে নিয়ে আসে বাসা দেখাতে। মেয়ে পাখিটার যদি বাসা পছন্দ হয় তাহলেই এরা ঐ বাসায় থাকতে শুরু করে। না হলে আবার নতুন করে বাসা বুনন করে। কত ক্রিয়েটিভ আর পরিশ্রমী পাখি বাবুই। আমার মনে হয় আমরাও এমনই একটি বাসা বানাতে চাই যেটি টেকসই হবে, দিনে আলো বাতাসে পরিপূর্ণ থাকবে, আর রাতের বেলায় একটা স্বপ্নিক আলো ছায়ায় ঘিরে থাকবে এবং সর্বোপরি নান্দনিক হবে। ঠিক যেন বাবুই বাসার মতো প্রকৃতির সাথে মিলে মিশে একাকার একটি সাসটেইনেবল আর্কিটেকচার। বাংলাদেশের আবহাওয়া, জলবায়ু ও প্রকৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রতিটি কাজে নজর দেন স্থপতি রুখসানা সম্পা। এই স্থপতি তার কাজ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে করতে ভালোবাসেন।
‘বাবুই বাসা’ স্টুডিও এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি রুখসানা সম্পা বলেন, আমার বাবুই বাসা স্টুডিওটাকে আমি বাবুই বাসা গ্যালারীও বলে থাকি। কারণ আমি কিন্তু এই স্টুডিওটাকে সাধারন অফিসের মতো ডিজাইন করিনি। এটা একটি ক্ষুদ্রাকৃতির গ্যালারি বলা যেতে পারে। যেখানে স্থাপত্যচর্চা আমরা বরাবর করেই আসছি ইন্টেরিয়র ডিজাইনেরও কাজ করছি। ভবিষ্যতে এই চর্চা অব্যাহত থাকবে। তবে ভবিষ্যতে স্থাপত্যচর্চার পাশাপাশি একটি ক্রিয়েটিভ প্লাটফর্ম তৈরী করতে চাই, যেখানে সাহিত্য চর্চা, লেখালেখি, স্কেচ, পেইন্টিং, ভাস্কর্য নিয়েও কাজ করে যাচ্ছি। মাঝে মাঝে আমাদের বাবুই বাসা গ্যালারীতে এ সবের প্রদশনীর আয়োজন করার মাধ্যমে অন্যদেরকে উৎসাহিত করার একটি প্রয়াস থাকবে।