Ananda ALo
Ultimate magazine theme for WordPress.

স্বামী-স্ত্রীর ডিজাইন ল্যাব আর্কিটেক্টস

আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর সমন্বয়ে স্থাপত্যশিল্পে যারা সৃষ্টিশীল কাজ করে চলেছেন তাদের মধ্যে মো: নাজমুল হক ও নাজনীন সুলতানা ঝুমি অন্যতম। তারা স্বামী-স্ত্রী। দুজনেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে পড়াশোনা করেছেন। তাদের রয়েছে ‘ডিজাইন ল্যাব আর্কিটেক্টস’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। এই ফার্মের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন স্থপতি নাজমুল হক। আর পার্টনার হিসেবে আছেন স্থপতি নাজনীন সুলতানা ঝুমি। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন স্থাপনার ডিজাইন তৈরি করেছে এবং জাতীয় পর্যায়ে একাধিক পুরস্কার অর্জন করেছে। এবার আনন্দ আলোর ঈদ সংখ্যায় শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে স্বামী-স্ত্রী দুজনকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদেন। লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক

স্থপতি মো: নাজমুল হকের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলায়। সেখানেই তার জন্ম ও বেড়ে ওঠা। নাজমুলের বাবার নাম বাবর আলী সরকার। তিনি ময়মনসিংহের টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন। মা হাসনা হেনা গৃহিনী। ছয় ভাই বোনের মধ্যে নাজমুল পঞ্চম। স্কুলে পড়াকালীন ছবি আঁকার প্রতি ছিল তার প্রচন্ড নেশা। ময়মনসিংহের জয়নুল আবেদিন চিত্র সংগ্রহশালা আর্ট স্কুলে ছবি আঁকা শিখতেন। বাবা মার অনুপ্রেরণায় এবং বড় ভাই ইঞ্জিনিয়ার ফজলুল হকের উৎসাহে স্থপতি হওয়া তার। ময়মনসিংহ জেলা স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৮৬ সালে। ১৯৮৮ সালে আনন্দমোহন কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। মো: নাজমুল হক বুলবুল ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৯৮ সালে। ২০০০ সালে নিজে গড়ে তোলেন ‘ডিজাইন ল্যাব আর্কিটেক্টস’ নামের একটি কনসালটেন্সি ফার্ম। বর্তমানে স্থপতি নামজুল হক বুলবুল এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আর পার্টনার হিসেবে আছেন তার স্ত্রী নাজনীন সুলতানা ঝুমি।
বুয়েটে পড়ার সময় নাজনীন সুলতানা ঝুমির সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ২০০৩ সালে তারা দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। স্থপতি নাজনীন সুলতানা ঝুমির গ্রামের বাড়িও ময়মনসিংহ জেলায়। জন্ম ও বেড়ে ওঠা সেখানেই। নাজনীনের বাবার নাম নওয়াব আলী আকন্দ। তিনি একজন ব্যবসায়ী ও সমাজসেবী ছিলেন। মা নাসিমা সুলতানা গৃহিণী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে নাজনীন সবার ছোট। স্কুল জীবন থেকে ক্রিয়েটিভ কিছু করার প্রতি নাজনীনের ভালোবাসা জন্মায়। নাজনীনের বড় ভগ্নিপতি বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রফেসর ছিলেন। সেই সুবাধে বুয়েটের টিচার্স কোয়াটারে আসা যাওয়া ছিল তার। বড় বোন ও দুলাভাইয়ের উৎসাহে আর্কিটেক্ট হওয়া তার। ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুল থেকে তিনি এসএসসি পাস করেন ১৯৮৮ সালে। ১৯৯০ সালে মোমিনুল নেসা সরকারি মহিলা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগে। ২০০০ সালে তিনি ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। পাস করে বের হওয়ার পর পরই তিনি যোগ দেন প্রয়াত স্থপতি এ জে এম আলমগীরের ‘আর্কি টাইপ ফার্মে’। সেখানে তিনি সততা ও নিষ্ঠার সাথে ১৩ বছর কাজ করেন। এ জে এম আলমগীরের মতো খ্যাতিমান একজন স্থপতির সঙ্গে কাজ করে স্থাপত্যশিল্পের টেকনিক্যাল বিষয় গুলো আয়ত্ব করেন।
‘আর্কি টাইপ’ প্রতিষ্ঠানে
থাকাকালীন প্রজেক্ট আর্কিটেক্ট হিসেবে তার উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে বসুন্ধরায় যমুনা ফিউচার পার্ক, যমুনা হাউজিং মেরিয়ট হোটেল, যমুনা টিভি সহ পুরো মাস্টার প্ল্যান।
১৩ বছর কাজ করার পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনি যোগদেন স্বামীর ‘ডিজাইন ল্যাব আর্কিটেক্টস’ ফার্মে। বর্তমানে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের পার্টনার হিসেবে আছেন। ইট, কাঠ, বালু ও কংক্রিটের মাঝেই নাজমুল ও নাজনীন দম্পতি খুঁজে ফেরেন প্রকৃতির সান্নিধ্য। আর তাই তাদের প্রতিটি ডিজাইনের ক্ষেত্রে আলো, বাতাস, সবুজ সহ প্রকৃতিকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকেন তারা। স্বামী-স্ত্রী দু’জনই সুনিপুনভাবে তৈরি করে চলেছেন একের পর এক দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্য। ইতোমধ্যে এই প্রতিষ্ঠানটি দেশের নামকরা হোটেল, হসপিটাল, নার্সিং ইনস্টিটিউট, ইউনিভার্সিটি, ব্যাংক, কমার্শিয়াল টাওয়ার, অফিস বিল্ডিং, ভেকেশন হাউজ সহ অসংখ্য বিল্ডিংয়ের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছে।
এ প্রতিষ্ঠানের উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে রয়েছে ঢাকা এয়ারপোর্ট রোডে লা মেরিডিয়ান হোটেল, উত্তরা দিয়াবাড়িতে অত্যাধুনিক সামাজিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ক্যালোডোনিয়ান ইনস্টিটিউট অব নার্সিং, মাওনায় মেরিয়ট কোর্ট ইয়ার্ড পাঁচ তারকা হোটেল, কক্সবাজারে কক্সবাজার বীচ ক্লাব পাঁচ তারকা হোটেল এন্ড রিসোর্ট, ধানমন্ডিতে নজরুল ইনস্টিটিউট, মুক্তাগাছায় ক্ষুদ্র নৃ শিল্প জাদুঘর, ঢাকা রেডিসন হোটেলের রেনোভিশনের কাজ, সিলেটে গ্র্যান্ড সিলেট হোটেল, মিরপুর শেওড়াপাড়ায় এক্সিম ব্যাংক হসপিটাল, ময়মনসিংহে বিএনএসপি আই হসপিটাল, কক্সবাজারে বেস্ট ওয়েস্টার্ন হেরিটেজ হোটেলের ইন্টেরিয়র ও রেনোভেশন, বনানী-১৫ তে সবুর খানের রেসিডেন্স বিল্ডিং, বান্দরবানে সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড এগ্রো লিমিটেড, গুলশানে পাইনিওর ইন্সুরেন্স কোম্পানির ইন্টেরিয়র, স্কয়ার গ্রুপের হেড অফিসের ইন্টেরিয়র, এক্সিম ব্যাংকের ইন্ট্রেরিয়র, ময়মনসিংহের ভালুকাতে হেলিভেরি ইন্টারন্যাশনাল বডিং স্কুল, বারিধারায় মি: আমিন রেসিডেন্স বিল্ডিং, লালমাটিয়ায় ডেফোডিল ইউনিভার্সিটি সহ অসংখ্য ভবনের ডিজাইন ও ইন্টেরিয়র করেছে।
এই দম্পতি দুই কন্যা সন্তানের জনক-জননী। বড় মেয়ে নিমাত নুজাবা নবম শ্রেণীর ছাত্রী। ছোট মেয়ে নুদরাত নুহা সানি ডেল স্কুলে অষ্টম শ্রেনীতে পড়াশোনা করছে।
তরুণ স্থপতিরা যারা এ পেশায় ক্যারিয়ার গড়তে চায় তাদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী?
এমন প্রশ্নের উত্তরে স্থপতি মো: নাজমুল হক বলেন, স্থাপত্য পেশা হচ্ছে প্রযুক্তিগত শিক্ষার সাথে সৃজনশীলতার সংমিশ্রণ। সাশ্রয়ী ও টেকসই নির্মাণ পরিবেশ তৈরি করা এখন যুগের চাহিদা, যার ফলে স্থপতিদের কর্মপরিসর সারা বিশ্বে বৃদ্ধি পেয়েছে। সৃজনশীল শিক্ষা বেকারত্ব দূরীকরণে এবং তরুণ গ্র্যাজুয়েটদের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে এবং নিজস্ব একটা পরিচিতিও দিচ্ছে। আর্কিটেকচার বা স্থাপত্য হচ্ছে এ রকমই ক্রিয়েটিভ শিক্ষা। দেশে-বিদেশে এখন স্থপতিদের ব্যাপক চাহিদা। বর্তমানে স্থপতিদের কর্মক্ষেত্র অবারিত। আর্কিটেক্ট ফার্ম, রিয়েল এস্টেট কোম্পানি গুলোতেও তাদের কাজের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। যেহেতু তাদেরকে পাঠ্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের সফটওয়ার অনুশীলন করতে হয়। গেমিং ইন্ডাস্ট্রি-থ্রি ডি ভিজুয়ালের ক্ষেত্রে স্থপতিরা সহায়তা করতে পারেন। অ্যানিমেশন ইন্ডাস্ট্রিতেও আর্কিটেক্টদের কাজের সুযোগ আছে। এছাড়া বর্তমানে আর্কিটেকচার পাস করার পর গ্র্যাজুয়েটরা অন্যান্য সৃজনশীল কাজ যেমন ফিল্ম মেকিং, ফটোগ্রাফি, সিনেমাগ্রাফি, এডভারটাইজিং, ইন্টেরিওর ডিজাইনের কাজেও যুক্ত হচ্ছেন। আমরা মনে করি ভবিষ্যৎ স্থপতিদের সৃজনশীল ও পরিশ্রমই হতে হবে। আধুনিক স্থাপত্য সহায়ক সফটওয়্যার গুলো অধ্যায়ন করে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে তাদেরকে বিশ্ব উপযোগী হয়ে উঠতে হবে।
স্থাপত্যচর্চার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী ও আনুষাঙ্গিক বিষয় যেমন-১, নিজ দেশের জলবায়ু, পরিবেশ, অর্থনীতি ও নির্মাণ সামগ্রীর ব্যাপারে সচেতন থাকা। ২. ক্লায়েন্টের আর্থসামাজিক অবস্থা বুঝে তার সম্পদ ও সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখে ডিজাইন করা যাতে তার সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার হয়। ৩. সর্বোপরি আধুনিক প্রযুক্তির সাথে সৃজনশীলতার সংমিশ্রণ করে প্রতিনিয়ত নিজেকে সময়ের উপযোগী হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। ৪. দেশী-বিদেশী বিভিন্ন স্থাপত্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি করার চেষ্টা করতে হবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে স্থপতি নাজনীন সুলতানা ঝুমি বলেন, মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের লোকদের আবাসন পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অন্যতম একটি সমস্যা। যদিও স্পষ্টভাবে একটি নীতি এবং রাজনৈতিক সমস্যা তবে এক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূণ। কিন্তু এক্ষেত্রে স্থপতিদের অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। নির্মিত পরিবেশের উন্নয়ন ও সাশ্রয়ী টেকসই আবাসন নিয়ে কাজ করাই আমাদের ভবিষ্যত পরিকল্পনা।
এই সফল স্থপতির কাজের পেছনে আছে তাদের সফল দাম্পত্য জীবন। সফলতাই সফলতাকে নিয়ে যায় শিখরে। তাদের অবিচ্ছেদ্য সম্মিলিত আন্তরিক প্রচেষ্টাই তৈরি করছে নতুন নতুন মহান সৃষ্টি। শুভ কামনা তাদের জন্য।