বাংলাদেশের স্থাপত্যে বিশ্বজয়

খোন্দকার হাসিবুল কবির। বাংলাদেশের খ্যাতিমান একজন স্থপতি। ২০০০ সালে তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ২০০৫ সালে যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। কো-ক্রিয়েশন আর্কিটেক্টস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন হাসিবুল কবির। তার সঙ্গে আছেন স্থপতি সুহাইলী ফারজানা। তিনি ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর অব আর্কিটেকচার ডিগ্রি লাভ করেন। সম্প্রতি তাদের ঝিনাইদহের আরবান রিভার স্পেস প্রকল্পটি বিশ্বের স্থপতিদের সর্বোচ্চ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব আর্কিটেক্টস এর দেওয়া ইউআইএ টুয়েন্টি থার্টি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। অ্যাকসেস টু গ্রিন অ্যান্ড পাবলিক স্পেস ক্যাটাগরিতে এই সাফল্য অর্জন করেছে। এ ছাড়াও এই প্রকল্পটি এবার আগাখান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার ২০২২ এ সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পেয়েছে। সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশের আরও একটি প্রকল্প। এবার শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমিতে খ্যাতিমান এই স্থপতিকে নিয়ে লিখেছেন মোহাম্মদ তারেক
নান্দনিক স্থাপনা সব সময়ই দৃষ্টি আকর্ষণ করে, মন জুড়িয়ে নেয়। তার সঙ্গে যদি সার্বিক ভাবে জীবনের গুণগত মানোন্নয়নের দিক বিবেচনায় থাকে, তা হয় সব থেকে আলাদা। বাংলাদেশের এমন একটি স্থাপত্য প্রকল্প বিশ্বের স্থপতিদের সর্বোচ্চ সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব আর্কিটেক্টস এ টুয়েন্টিথার্টি পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। অ্যাকসেস টু গ্রিন অ্যান্ড পাবলিক স্পেস ক্যাটাগরিতে এই সাফল্য অর্জন করেছে ঝিনাইদহের কো-ক্রিয়েশন অব আরবান স্পেস বাই নবগঙ্গা রিভার প্রকল্পটি। জাতিসংঘের ইউএন হ্যাবিট্যাটাস এর সহযোগিতায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা এসডিজির প্রচারের লক্ষ্যে প্রথমবারের মতো করা এ আয়োজনে বাংলাদেশের আরও দুটি স্থাপত্য প্রকল্পও বহুল প্রশংসিত হয়েছে। তার মধ্যে একটি পুরান ঢাকার রসুলবাগ শিশু পার্ক প্রকল্প, অপরটি রংপুরের কারুপন্য ফ্যাক্টরি। এবার আগাখান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার ২০২২ এ সংক্ষিপ্ত তালিকার ২০টি প্রকল্পের মধ্যে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশের দুটি স্থাপত্য। এসব স্থাপত্যকর্মের ছবি লন্ডনের কিংস ক্রসে আয়োজিত প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের কক্সবাজারের টেকনাফে প্রকল্প দুটি রোহিঙ্গা শরনার্থী শিবিরে নির্মিত কমিউনিটি স্পেস ও ঝিনাইদহের আরবান রিভার স্পেস রয়েছে। কিছুদিন আগে আগাখান অ্যাওয়ার্ড ফর আর্কিটেকচার এর ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও ওয়েব সাইটে এ বছরের মনোনীত প্রকল্প গুলোর তালিকা প্রকাশ করা হয়। বিশ্বের ৪৬৩টি প্রকল্প থেকে নির্বাচকরা এই ২০টি প্রকল্প বাছাই করেন। স্থাপত্য পুরস্কারের ক্ষেত্রে আগাখান অ্যাওয়ার্ড অন্যতম প্রাচীন ও সম্মানজনক পুরস্কার। এই পুরস্কার দেওয়া শুরু হয় ১৯৭৭ সাল থেকে। প্রতি তিন বছর পর এই পুরস্কার দেওয়া হয়। সমকালীন নকশা, সামাজিক গৃহায়ণ, সামাজিক অগ্রগতি ও উন্নয়ন সহ জরুরি আরও অনেক বিষয় বিবেচনা করা হয় এতে। এই পুরস্কার কেবল স্থাপত্যের নান্দনিক দিকটির দিকেই খেয়াল করে না, সার্বিক ভাবে জীবনের গুণগত মানোন্নয়নের দিকেও খেয়াল রাখে। স্থাপনা বা ব্যক্তির পাশাপাশি এটি প্রকল্প, সম্প্রদায় ও তার অংশীদারদেরও স্বীকৃতি দেয়। পরিকল্পনা এবং ঐতিহাসিক সংরক্ষণকে গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি উদ্ভাবনী ধারনায় স্থাপনাটি কতটা পরিবেশ বান্ধব, সেটি দেখা হয়। এ পুরস্কারের জন্য নির্বাচনও হয় অত্যন্ত কঠোর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে চূড়ান্ত ভাবে নির্বাচিত বিজয়ীরা ১০ লাখ ডলার অর্থমূল্যের পুরস্কার ভাগ করে নেবেন।
বাংলাদেশে এর আগে ২০১৯ সালে স্থপতি সাইফ উল হকের নকশা করা কেরানীগঞ্জের দক্ষিণ কানাচরের আর্কেডিয়া এডুকেশন প্রজেক্ট আগাখান পুরস্কার লাভ করে। ২০১৬ সালে এই পুরস্কার জিতেছিলেন দুই বাংলাদেশি স্থপতি মেরিনা তাবাসসুম ও স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী। স্থপতি মেরিনা তাবাসসুমের করা বায়তুর রউফ মসজিদের নকশায় রয়েছে সুলতানি স্থাপত্যের অনুপ্রেরণা। আর ফ্রেন্ডশিফ সেন্টারের নকশায় স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী এনেছেন মহাস্থানগড়ের আবহ। তাঁদের আগে বাংলাদেশেল তিনটি স্থাপত্য এ পুরস্কার জিতলেও সেগুলোর স্থপতিরা ছিলেন বিদেশি। জাতীয় সংসদ ভবন, গ্রামীণ ব্যাংক হাউজিং প্রকল্প ও দিনাজপুরের রুদ্রপুরের মেটিস্কুল। তুবে মেটিস্কুলের স্থপতি জার্মান নারী আনা হেরিঙ্গারের সঙ্গে সহযোগী হিসেবে খন্দকার হাসিবুল কবিরও যুক্ত ছিলেন।
রোহিঙ্গা শিবিরের কমিউনিটি স্পেসের স্থপতি রিজভী হাসান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন খাজা ফাতমি ও সাদ বিন মোস্তফা। প্রথাগত পদ্ধতিতে কোনো নকশা বা মডেল তৈরি না করে তাঁরা সরাসরি রোহিঙ্গা কারিগরদের সঙ্গে কাজ করেছেন ও নির্দেশনা দিয়েছেন। স্থানীয় ভাবে সংগ্রহ করা কাঁচামালে তৈরি যা টেকসই ও পরিবেশ বান্ধব স্থাপনা। অপর দিকে ঝিনাইদহের আরবান রিভার স্পেস’এর স্থপতি খোন্দকার হাসিবুল কবির ও স্থপতি সুহাইলী ফারজানা। ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হাসিবুল কবির কো-ক্রিয়েশন আর্কিটেক্টস এর প্রধান। তার কাজ পুরো এলাকার চিত্র বদলে দিয়েছে। নদীর তীর ঘেঁষে হাঁটার রাস্তা, বাগানের ফাকে ফাকে আড্ডা ও সংস্কৃতির্চ্চার জায়গা তৈরি করেছেন। পরিবেশের প্রতি সংবেদনশীলতার পাশাপাশি অন্তর্ভুক্তিমূলক নগরায়নের অনন্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে এটি। নিজ শহর ঝিনাইদহের জন্য প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন স্থপতি খোন্দকার হাসিবুল কবির। দরিদ্র জন গোষ্ঠীকে দেখিয়েছেন স্বল্প খরচে মানসম্মত বাসস্থান তৈরির প্রক্রিয়া। সেখানে ওই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা নিজেরাই ইট, কাঠ, সিমেন্ট, পাথর ব্যবহার করে নিজেদের ঘর বানিয়েছেন, যেখানে ছিল তাদের আত্মিক অংশগ্রহণ। বাইরে থেকে মিস্ত্রি প্রয়োজন না হওয়ায় খরচও হয়েছে অল্প। এ ছাড়া শহরের সৌন্দর্য্যবর্ধন ও এলাকা গুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্কীয় যোগাযোগের উন্নয়নের পাশাপাশি গণপরিসরে নিয়ে কাজ করছেন তিনি। ভূমিকা রাখছেন সমাজ পরিবর্তনে। কো-ক্রিয়েটিভ স্পেস বা মিলেমিশে স্থান নির্মাণই হাসিবুল কবিরের কাজের প্রধান উপজীব্য।
স্থপতি খোন্দকার হাসিবুল কবির বলেন, কাজটা শুরু করেছি ২০১৫ সালে। নদীকে কেন্দ্র করে নগর সাজাতে চেয়েছি আমরা। এ কাজে শহরের মেয়র থেকে শুরু করে হকার পর্যন্ত সবাইকে যুক্ত করেছি। স্থপতি সুহাইলী ফারজানা বলেন, মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে স্থাপনা নির্মাণই আমাদের কাজের প্রধান উপজীব্য। নানা ভাবে জনগণকে সংপৃক্ত করতে সিটি ওয়াইড পিপলস নেটওয়ার্কও গড়েছি। আমাদের স্লোগান নদী ও পুকুরের দিকে করি মুখ। বাড়িয়ে দেই ঝিনেদার সুখ।
খ্যাতিমান এই স্থপতি কমিউনিটি স্থপতি হিসেবে পরিচিত। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক খোন্দকার হাসিবুল কবিরের অনন্য পরিচয় তিনি গরীবের স্থপতি। জনপ্রিয় এই শিক্ষক এক সময় বসবাস করতেন ঢাকার করাইল বস্তিতে। সেখানকার মানুষের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে তিনি কাজ করেছেন। তাদের জন্য তৈরি করেছিলেন ‘আশার মাচা’। স্থাপত্যের একজন শিক্ষক বস্তিতে থেকে বস্তির মানুষদের জন্য কাজ করেছেন এই বিষয়টি সে সময় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। হাসিবুল কবিরের তৈরি করা ওই আশার মাচা ছিল বাঁশের তৈরি। এর ওপর বসে করাইলের বাসিন্দারা আড্ডা দিতেন। কখনো বাচ্চারা পড়াশোনা বা খেলাধুলা করতো। সে সময় এটি একটি কমিউনিটি স্পেস হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গাছপালা ও লতা পাতায় বেস্টিত ছিল আশার মাচা।
স্থপতি খোন্দকার হাসিবুল কবির ২০০০ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর স্থাপত্য বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে। ২০০৫ সালে তিনি যুক্তরাজ্যের শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। সেখানে তার গবেষণার বিষয় ছিল আমাদের দেশের পথের পাশের বনফুল ও অবহেলিত গাছ পালা কীভাবে বাগানের সৌন্দর্য ও জীববৈচিত্র্য বাঁচিয়ে দেশের নিজস্ব একটা পরিবেশ তৈরি করতে পারে। পরে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। সুহাইলী ফারজানা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি থেকে মাস্টার্স ইন ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাডি করেছেন।
তাদের কাজের উদ্দেশ্য হচ্ছে-মানুষ নিজেদের সঞ্চয় ও সম্পদ দিয়ে আত্মসম্মানের সাথে নিজের ও অন্যের সমস্যা সমাধান করবে। স্বল্প আয়ের মানুষের নেটওয়ার্ক ও স্থানীয় প্রশাসন মিলে নদী-নালা-খাল-বিল ও অন্যান্য পরিবেশ রক্ষা করে সুন্দর শহর ও গ্রাম গড়ে তুলবে। যেখানে বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীরা বাস্তব জ্ঞান অর্জন ও মানুষকে সময় দেয়ার আনন্দে কাজ করে যাবে।

  • শাহ্ সিমেন্ট নির্মাণে আমি