চন্দনা মজুমদার। আমাদের সঙ্গীত জগতে অতি পরিচিত এক নাম। পলীগীতি ও লালনের গানের এ শিল্পী একটু নিভৃতেই তার সঙ্গীত সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন বহুদিন এবং সেটাই তাঁর পছন্দ। তাঁর স্বামী কিরণ চন্দ্র রায়ও একজন বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী। চন্দনা মজুমদারের গানের সুরের মতোই উজ্জ্বল উচ্ছল তাঁর মেয়ে শতাব্দী রায় পিংকি। মা মেয়েকে আনন্দ আলো একদিন মুখোমুখি আড্ডায় বসিয়েছিল। ব্যস জমে গেল মা-মেয়ের মধুর আড্ডা। সেই প্রাণবন্ত আড্ডার বয়ান নিয়েই এই প্রতিবেদন। লিখেছেন- মোহাম্মদ তারেক
আনন্দ আলো: মা চন্দনা মজুমদার এবং মেয়ে শতাব্দী রায় পরস্পরের কাছে কে কেমন?
চন্দনা মজুমদার: আমরা দু’জন পরস্পর বন্ধুর মতো। মেয়েকে আমি মাতৃত্ব স্নেহ দিয়ে এখনও আগলে রেখেছি। শাসন, অনুশাসন, ভালোবাসা, রাগ, অনুরাগ, আদর, সোহাগ প্রতিটি ব্যাপারেই মেয়ের সাথে আমার সম্পৃক্ততা। একজন বন্ধু যেমন আরেক জন বন্ধুকে বুঝে, ভালোবাসে ঠিক তেমনি আমাদের মধ্যেও সেই সম্পর্ক। মা-মেয়ে দু’জনই একই প্রফেশনে আছি। আমি গানকরি, শতাব্দীও গান করে।
শতাব্দী রায় পিংকি: আমার মা খুবই দায়িত্বশীল, স্নেহময়ী একজন মা। আমরা পরস্পর ভালো বন্ধু। ছোটবেলা থেকেই মায়ের সাজ গোজের জিনিস আগে আমি ব্যবহার করতাম। তারপর মা ব্যবহার করতেন। আমার জন্য মা কোনোদিনও শখ করে নতুন জিনিস ব্যবহার করতে পারতেন না। আমিও মাকে রেখে কোনোদিন নতুন শাড়ি পড়িনি। আগে নতুন শাড়ি মা পড়বে তারপরে আমি পড়ব। গান নিয়ে, ঘর গছানো নিয়ে মায়ের সাথে আমার ঝগড়া লেগেই থাকত। মা তো চন্দনা পাখি সারাদিন কিচির মিচির করতেই থাকে।
আনন্দ আলো: মায়ের শাসন আর মেয়ের জ্বালাতন এ সর্ম্পকে কার কী অভিমত?
চন্দনা মজুমদার: মেয়ের জ্বালাতন বলতে নেই। আমার মেয়েটা খুবই লক্ষী। ও খুব একটা জ্বালাতন করেনি। এখন করে না। কোনো কোনো সময় ওর উপর রাগ হয়। এক সময় শতাব্দী বুঝতে পারে মায়ের রাগ করাটা প্রয়োজন ছিল। সবচাইতে ভালো লাগে ও বোঝার চেষ্টা করে।
শতাব্দী রায় পিংকি: শাসন তো অবশ্যই চাই। শাসন না করলে তো সামনের দিকে এগোতে পারব না। আমার কোনো কিছুতে ভুল হলে আম্মু আমাকে বকা দেয়। বুঝি সেটা আমার ভালোর জন্যই দেয়।
আনন্দ আলো: আপনাদের গানের জগতে বাবা-মায়ের প্রভাব কতটুকু? চন্দনা মুজমদার: আমার জন্ম সঙ্গীত পরিবারেই এবং সঙ্গীতের মধ্য দিয়েই আমার বেড়ে ওঠা। আমার বাবা বাংলাদেশের অত্যন্ত গুণী একজন শিল্পী নির্মল চন্দ্র মজুমদার। রেডিও এবং টেলিভিশনের সাথে যুক্ত আছেন লোক সঙ্গীত লালন সঙ্গীত নিয়েই গান করে আসছেন, এখনও গাইছেন। বাবার কাছেই মূলত হাতে খড়ি। তবে বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তিনি যেহেতু লোকসঙ্গীত করেন তার মেয়ে যেন একটু ক্ল্যাসিক এবং নজরুল সঙ্গীতে অনুরক্ত হয়। আমার শুরুটা অবশ্য ক্ল্যাসিক এবং নজরুল সঙ্গীত দিয়েই। আমার জন্ম কুষ্টিয়ায়, লালনের দেশে। কিন্তু বাবার চাকরি সুবাদে ঢাকায় থাকতাম আমরা। আমার গান শেখার কালটা বেশি কেটেছে রামপুরায়। নরুলের গান করতে করতেই আমি একসময় লালনের গানের প্রতি প্রচন্ড ভাবে আকৃষ্ট হই। আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই আমাদের লালনের গানের বিশিষ্ট শিল্পীÐ ফরিদা পারভীনের কথা। তাঁর কণ্ঠে ওই অল্প বয়সেই যখন লালনের গান শুনি তখন আমার মধ্যে আগ্রহের সৃষ্টি হয়। রেডিওতে তখন দিনে দু-তিনবারও তাঁর গাওয়া লালনের গান বাজানো হতো। তখন আমি শুধু গানের কথাগুলো সংগ্রহ করতাম, সুর শুনে শুনে সহজেই আমার মুখস্থ হয়ে যেত। তারপর আস্তে আস্তে আমি লালনের গানে ঢুকে গেলাম। বাবাও দেখলেন তার মেয়ে লালনের গানের ভক্ত হয়ে যাচ্ছে। তখন আমি লালনের গানের গুরু হিসেবে পেয়ে গেলাম মরহুম মোকসেদ আলী সাঁইকে। তিনি ফরিদা পারভীনের গুরু। লালনের গানে আমার প্রথম হাতে খড়ি তার কাছেই। তারপর আমি পেলাম খোদাবক্স সাঁইকে। র্দীঘদিন তাঁর কাছে গান শেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে।
শতাব্দী রায় পিংকি: ছোটবেলায় আমি গান করতাম বাবা-মা কখনোই জানতেন না। উনারা গান বাজনা নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আমি গান গাইব সেরকম কোনো ইচ্ছাও ছিল না। পড়াশোনার প্রতি আমার দূবর্লতা ছিল অনেক বেশি। আমি যে গান করতে পারি প্রথম খেয়াল করেছিলেন আমার দাদী। দাদী আমার গানের খবরটা বাবা-মাকে দেন। বাবা-মা দু’জনই যখন কোনো প্রোগ্রামে চলে যেত তখন আমি চুরি করে হারমোনিয়াম তানপুড়া নিয়ে বসে পড়তাম। আমি প্রথম গান শিখি তানপুড়া দিয়ে। এরপর বাবা মার কাছে শিক্ষাটা নেই। আমার সঙ্গীতে হাতে খড়ি মায়ের কাছে। বাবা খুব একটা জোর করতেন না। কিন্তু মা সব সময় জোর করে হলেও আমাকে গাইতে বসাতেন। সঙ্গীতে আমার ক্ষেত্রে মায়ের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। তবে
আনন্দ আলো: মায়ের কাছে মেয়ের কোন গানটি আর মেয়ের কাছে মায়ের কোন গানটি প্রিয়?
চন্দনা মজুমদার: ‘আমার মুর্শিদ পরশমনিরে লোহারে বানাইলা কাঁচা সোনা’ শতাব্দির কণ্ঠে এই গানটি আমার সবচেয়ে বেশি প্রিয়।
শতাব্দী রায় পিংকি: মায়ের গাওয়া ‘যাও পাখি বল তারে’, ‘আর আমারে মারিস না মা’, ‘গুরু আমারে কি রাখবেন করে চরণও দাসী’, এই গান গুলো খুব ভালো লাগে। আর বাবার সব গানই আমার ভালো লাগে। বাবার গাওয়া ‘ভালো আছি ভালো থেকো’, আমার হাত বান্দিলাম পা বান্দিলাম গানদুটি আমার খুবই প্রিয়।
আনন্দ আলো: মেয়ের ভালো-মন্দ দিক নিয়ে কিছু বলুন?
চন্দনা মজুমদার: শতাব্দীর ভালো গুণ গুলো বেশি। সৃষ্টিকর্তা তাকে গানের একটা প্রতিভা দিয়েছেন। ও যেন এটাকে সাধনার মাধ্যমে টিকিয়ে রাখে এবং আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেটা আমার প্রার্থনা। শতাব্দীর মন্দ দিক হচ্ছে ও গানের প্রতি একটু অমনোযোগী। আমি যেভাবে প্রাকটিস করতে বসি ও সেভাবে বসে না। ও ঘুম থেকে সময়মতো উঠে না। খাওয়া-দাওয়া নিয়ে একটু সমস্যা করে।
শতাব্দী রায় পিংকি: মা অনেক সহজ মানুষ। তাকে বুঝতে অসুবিধা হয় না। সবার সাথে সহজেই মিশে যায়। অহংকার বলতে নেই। মা সবাইকে নিয়ে আনন্দে থাকতে ভালোবাসেন। কেউ কোনোদিন তার কাছ থেকে অসম্মান পায়নি। সবাইকে আদর করে। মায়ের এই গুণটা আমার অনেক ভালো লাগে।
আনন্দ আলো: মা-মেয়ের একসঙ্গে স্মৃতিময় কোনো ঘটনা?
চন্দনা মজুমদার: ২০০৯ সালে আমরা সবাই মিলে একবার চায়নাতে প্রোগ্রাম করতে গিয়েছিলাম। মেয়ের বাবা কিরণ চন্দ্ররায়ও ছিলেন। সেখানে আমরা গ্রেটওয়াল দেখতে গেলাম। সেখানে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে হয়। যেটা ছিল ঢাল সিঁড়ির মতো মেয়ে টপাটপ উপরে উঠে যাচ্ছে আর আমি একদম পেছনে পরে আছি। আমার পেছনে আছে ওর বাবা। এদিকে আমি উপরে উঠতে না পেরে মেয়েকে বললামÐ আমার হাতটা ধর। ও হেসেই অস্থির। একটা সময় দেখলাম ও গ্রেটওয়ালের সর্বোচ্চ চূড়ায় উঠে গেছে। আমরা কিন্তু শেষ মাথায় যেতে পারলাম না। ও আমাদেরকে ডাকছে। আমরা বেশ কিছুটা দূরে থাকলাম। সেটা আমার জীবনে আনন্দের একটা স্মৃতি।
শতাব্দী রায় পিংকি: মা আমাকে দেখতে একবার কলকাতায় গিয়েছিলেন। এয়ারপোর্টে ফ্লাইট থেকে নেমে প্রথমেই মা আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগলেন। ওই সময় আশে পাশের লোকজন তাকিয়ে দেখছিলেন। তখন আমি ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলাম। সেই দিনের সেই ঘটনা এখনো মনে পড়ে।
আনন্দ আলো: গানের পাশাপাশি আপনারা আর কী করছেন?
চন্দনা মজুমদার: বর্তমানে আমি ছায়ানটে লোকসঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছি।
শতাব্দী রায় পিংকি: আমি গানের পাশাপাশি শর্টফিল্মের সাথে জড়িত আছি। বর্তমানে লালন সাঁইয়ের ওপর একটি ডকুমেন্টারি করছি।
মধুর আমার মায়ের হাসি…
- মুখোমুখি