এ কেমন নাটকের নাম!

বলা হয়ে থাকে নাটক হচ্ছে সমাজের দর্পণ। কিন্তু এই সময়ে এসে আমরা যে ধরনের নাটক দেখি তারমধ্যে কয়টি নাটক সমাজের দর্পণ হয়ে দর্শকদের সামনে হাজির হয়! সামাজিক দায়বদ্ধতা কিংবা ম্যাসেজধর্মী নাটক কয়টি দেখে থাকে দর্শক! অথচ, একটা সময় ছিল যখন নাটক দেখে মধ্যবিত্ত পরিবার তাদের জীবনাচরণ ঠিক করে নিতো। বাসার ড্রয়িং রুমটির সাজ কেমন হবে সেটাও শিখিয়েছিল বিটিভির আমলের নাটক। হালসময়ে ইউটিউব সহ বিভিন্ন স্ট্রিমিং এ নাটকের ভিউ পাওয়ার জন্য যাচ্ছে তাই ভাবে নাটকের নাম রাখা হচ্ছে। অনেক সময় এসব নাটকের নাম মুখে নিতেও বিব্রতবোধ হয়।
ইউটিউব খুঁজে সা¤প্রতিক কালের কয়েকটি নাটকের উদ্ভট নাম পাওয়া গেল- সেন্ড মি নুডস, বেড সিন, ছ্যাকা খেয়ে ব্যাকা, সেইরকম বাকিখোর, চুটকি ভান্ডার, সেলিব্রেটি কাউ, ফালতু, মিউচুয়াল ব্রেকআপ, লেডি কিলার, প্লেবয়, ক্রেজি লাভার, ড্যাশিং গার্লফ্রেন্ড, বংশগত পাগল, ম্যানেজ মকবুল, চ্যাতা কাশেম, হেভিওয়েট মিজান, ছ্যাঁছড়া জামাই, চিটার, প্রোটেকশন, শোবার ঘর, এক্সফেল মফিজ ইত্যাদি। এর মধ্যে কিছু নাটক ইউটিউবের জন্যই তৈরি হয়েছিল। আবার কিছু নাটক বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে প্রচারিত হওয়ার পর ইউটিউবে এসেছে।
নাটকগুলোর এমন নাম শুনে রীতিমতো বিস্ময় ও বিরক্তি প্রকাশ করেছেন নাট্যজনেরা। এ সময়ের কয়েকজন পরিচালকও এ ধরনের নামের বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। অনেকে নাটকের এমন উদ্ভট ও অরুচিকর নামকরণকে পরিচালকদের সৃজনশীলতা ও শিক্ষার অভাবকে দায়ী করেছেন।
বরেণ্য অভিনয়শিল্পী তারিক আনাম খান বলেন, ‘একটা সময় প্রমিত বাংলায় মানুষ কথা বলত। টিভি নাটক দেখে বাচ্চারা কথা বলা শিখছে- সেই জায়গা থেকে আমরা নাটক করতাম। এখন নাটকের নাম শুনলেই মোটামুটি সব বোঝা যায়। ভাষাটাই যেখানে হারিয়ে গেছে, নাম নিয়ে আর কী আশা করতে পারি।’
অথচ আশি ও নব্বইয়ের দশকের নাটকগুলো নিয়ে এখনো দারুণ সব প্রতিক্রিয়া পান তারিক আনাম খান। তিনি বলেন, ‘এখনো বুঝি, দর্শক ওই রকম গল্প চায়। আমরা ভাঁড়ামি গেলাতে চাইছি। জানি না, কীভাবে বেরিয়ে আসা যাবে এখান থেকে। এখানে টেলিভিশন চ্যানেলেরও দায় অনেক।’
সব নাটকের নাম এমন, তা নয়। এই শহরে, আমাদের সমাজবিজ্ঞান, কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মায়া সবার মতো না, কাঠপেন্সিলের কাহিনি, তুমি ফিরে আসোনি, আগন্তুক, ফেরা, বড়ছেলে, শুনতে কি পাও, প্রেম দূত, অচেনা প্রেম, অন্য কোথাও, শিশির বিন্দু, কতোটা পথ পেরুলে-এর মতো সুন্দর নামের নাটকও আছে। মজার বিষয় হচ্ছে, ঘুরেফিরে একই অভিনয়শিল্পীরা এই দুই ধরনের নাটকগুলোতে অভিনয় করছেন।
নাট্যজন মামুনুর রশীদ বলেন, ‘ইদানীং বেশির ভাগ নাটকে যে ধরনের নাম দেয়া হয়, এগুলো কিছু দুষ্টু লোকের কাজ। আমাদের দুঃখ ছিল, টেলিভিশন নাটক তো গেল, এখন ইউটিউব আরও জঘন্য। নাটকের নামের এই বিকৃতির পেছনে যাঁরা আছেন, তাঁদের শাস্তি দেয়া উচিত। শুধু তাই নয়- এসব নাটকের গল্প শুধু প্রেম-পিরিতি নিয়ে। যেনো দেশে প্রেম ছাড়া আর কিছুই নেই।’
নাটকের বাজেট কম, এ কারণেই কি নামের এই হাল? মামুনুর রশীদ বলেন, ‘এখানে বাজেট বিষয় নয়। এ ধরনের নাম কিছু টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ পছন্দ করে, যার প্রভাব অন্যদের ওপর পড়ে। শুনেছি, যাঁরা অনুষ্ঠান বিভাগে আছেন, তাঁরা এমনও বলেন, নাটকে মজা কোথায়, মজা বের করেন।’
অভিযোগ আছে, নাটকের নাম যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ, এটা অনেক পরিচালক ও টিভি কর্মকর্তারা বুঝতে চান না। এর পরিণতি খারাপ হবে বলে মনে করেন নাটক সংশ্লিষ্ট অনেকে। তাঁদের আশঙ্কা, ২০০০ সালের দিকে গুটিকয়েক লোক উদ্ভট গল্প, আনাড়ি অভিনয়শিল্পী দিয়ে অরুচিকর নামের সিনেমা বানিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে অশ্লীলতার দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। নাটকেও সেই অবস্থা হতে চলেছে। নাটকে এখন পাল্লা দিয়ে চলছে উদ্ভট সব কনটেন্ট বানানোর প্রতিযোগিতা। উদ্দেশ্য, লাখ লাখ ভিউ এনে রোজগার করা। গত ঈদে দুটি নাটক বানিয়েছেন আশফাক নিপুণ। নির্মিত নাটকের নাম নিয়ে তিনি ইদানীং লজ্জিত। তিনি বলেন, ভালো নামের পেছনে সময় দিতে হয়। কিন্তু পরিচালকেরা দৌঁড়াচ্ছেন, ডজন ডজন নাটক বানাচ্ছেন। সবার ধারণা, একটা ‘ক্যাচি’ নাম দিয়ে দিলেই হলো। কিন্তু ক্যাচি নাম তো অর্থপূর্ণ, নান্দনিক হতে হবে। বাংলা ভাষা তো নান্দনিক।’
বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান তারেক আখন্দ বলেন, এ ধরনের নামের বিষয়টি মোটেও সমর্থনযোগ্য নয়। ইউটিউব-এ নাটক প্রকাশের সুযোগ তৈরি হওয়ার পর লাখ-কোটি ভিউর আশায় অনেকে ‘ক্যাচি’ (আকর্ষণকারী) নাম দিতে গিয়ে এ পথে নেমেছেন। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে হলে শিল্পী, পরিচালক থেকে শুরু করে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
নাটকে ইংরেজি নামের সমাহার!
‘ব্রেক-আপ ব্রেক-ডাউন আফটার ম্যারেজ’, ‘কট ম্যারেজ’, ‘হিট উইকেট’, ‘ব্যাকআপ আর্টিস্ট’, ‘আইইএলটিএইচ’, ‘ফোকাল পয়েন্ট’, ‘হেলমেট’, ‘হাউস হাসব্যান্ড’, ‘বøাইন্ড ইমোশন’, ‘আফটার ব্রেক’- না, হলিউডের চলচ্চিত্র নয় এগুলো। এমন সব ইংরেজি নামেই তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশি বাংলা নাটক-টেলিছবি।
এই তালিকা আরও দীর্ঘ। যেমন ‘ফেয়ার গেম’, ‘হোয়াট ইজ ইয়োর ফাদারস নেম’, ‘হোপলেস ম্যান’, ‘লার্নড ম্যান’, ‘শর্ট টেম্পার’, ‘হান্ড্রেড আউড অব হান্ড্রেড’, ‘টেনশন টিউশন’ প্রভৃতি। বাংলা নাটকে অযথা ইংরেজি নামকরণ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে ‘উদ্ভট’ ইংরেজি নামগুলো নাটক-টেলিছবি সংশ্লিষ্টদের হাসির পাত্র ছাড়া আর কিছুই করছে না।
কয়েক বছর ধরে চিত্রটা একেবারে পাল্টে গেছে। এখন বাংলা নামের নাটক খুব কম চোখে পড়ে। যেগুলো আছে, সেখানেও দৈন্যতা লক্ষ করা যায়। পুরো নাটকে কোনো ইংরেজি সংলাপ নেই অথচ নাম ইংরেজিতে, এটাকে বাড়াবাড়ি ছাড়া আর কী বলবেন?
একমাত্র বাংলা ভাষার জন্যই যুদ্ধ করতে হয়েছে, দিতে হয়েছে জীবন। বিশ্বে কোটি কোটি মানুষ বাংলায় কথা বলছেন। এক সময় সাহিত্যনির্ভর গল্প নিয়ে তৈরি হতো টেলিভিশন নাটক। সে নামগুলোতে পাওয়া যেতো কাব্যিক ছোঁয়া। এখন সে দিন নেই। ইংরেজির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় চলচ্চিত্রে ইংরেজি নামকরণ নিয়ম করে বন্ধ করা হয়েছে। এবার বুঝি সময় এসেছে নাটক-টেলিছবিতে অনর্থক ইংরেজি নামকরণ বন্ধের।
সংশ্লিষ্টরা প্রায়ই বলেন যে, বেশি সংখ্যক দর্শকের কাছে পৌঁছবার জন্য তারা ইংরেজি নাম রাখেন। কিন্তু এমন অনেক নামই পাওয়া যাচ্ছে যেগুলোর অর্থ দর্শকও ঠিক জানে না। তাহলে কেন এই প্রবণতা?
আবার কিছু নাম দেখে সংশ্লিষ্টদের পড়াশোনার দৌঁড় টের পাওয়া যায়। যাচ্ছেতাই একটি নাম নির্বাচন করে তারা চ্যানেলে নাটক জমা দিচ্ছেন। কোন নাটকের নাম প্রয়োজনে আর কোনটা অপ্রয়োজনে ইংরেজিতে রাখা হয়েছে, দর্শক সেটা বুঝতে পারেন। প্রশ্ন উঠেছে, ইংরেজি নাম রাখাটা কী ফ্যাশন হয়ে গেছে?
সুন্দর সুন্দর নামে এখনও কবিতা, উপন্যাস, মঞ্চনাটক তৈরি হচ্ছে। এমনকি চলচ্চিত্রেও সেটা বহাল রয়েছে। পাঠক-দর্শক সেগুলো উপভোগ করছেন। কেবল টিভি নাটকের বেলায় বাংলা শব্দের সংকট দেখা দিলো? টিভি নাটকের মানুষেরা আসলে অন্য কিছুর সংকটে ভুগছেন। তারা ভালো করেই জানেন যে, বাংলা দুর্বল কোনো ভাষা নয়, এটা বিশ্বস্বীকৃত ও প্রমাণিত শ্রেষ্ঠ ভাষা।

  • টিভি গাইড