পর্তুগালে অল ইউরোপীয়ান বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের (আয়বার) দ্বিতীয় গ্রান্ড কনভেনশনে যোগদানের জন্যই এবার আমার ইউরোপ সফর। পাশাপাশি প্যারিস, এথেন্স এবং বার্সেলোনা প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিশেষ আমন্ত্রণে সঙ্গীত পরিবেশনারও পরিকল্পনা ছিল। আটলান্টিকের পাড়ে অবস্থিত পর্তুগালের ‘আয়বা’ সম্মেলনের মিলনমেলায় আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে বহুধাবিভক্ত ইউরোপের বাংলাদেশী কমিউনিটিকে ‘ইউনিটি ও একতার’ পতাকা তলে সমবেত করার উদ্যোগ। যাহোক সম্মেলন শেষে আমরা ১ জুন লিসবন শহরটি ঘুরে দেখি। প্রথমেই ছুটে যাই ১৪০০ খৃষ্টাব্দের পর্তুগীজ অভিযাত্রীদের স্মৃতিসৌধে। পাশেই মিউজিয়াম। আমার সঙ্গে ছিলেন প্যারিসের স্বপন আর মোমেন শরীফ। পর্তুগালে বসবাসরত মোমেন শরীফের ভাগিনা রিজন সংক্ষিপ্ত সময়ে আমাদের সবকিছু ঘুরিয়ে দেখায়। শহরের পৌর এলাকা, প্রাচীন রাজার বাড়ী, সমুদ্র অভিযাত্রীদের স্মৃতিসৌধ। দুই পাড়ে রক্ষিত নাবিকদের বিভিন্ন স্মৃতি সামগ্রী। তাছাড়া তাগাস নদীটি পূর্ব থেকে হয়ে রাজধানী লিসবন ছুঁয়ে আটলান্টিকে মিশেছে। তাগাস নদীর দক্ষিণে অনেক পাহাড় আছে। প্রাচীন সভ্যতা আর ভৌগোলিক পরিবেশের অনেক ছাপ রাজধানী লিসবনকে দেখলে বোঝা যায়। এবার সদলবলে প্যারিসে ফেরা। লিসবন থেকে প্যারিসে ফেরার ফ্লাইট ছিল বিকেল ৭-২৫ মিনিটে। গ্রীস্মের সময় এখন সূর্য ডোবে রাত ৯টার পরে। তাই শেষ বিকেলে চমৎকার আবহাওয়ার মাঝে, আয়বা সম্মেলনের প্রানপুরুষ, প্যারিসে বাঙালীদের বন্ধু কাজী এনায়েতউলাহ ইনু সাহেবের নেতৃত্বে, মোমেন শরীফ, শুভ, স্বপন, কামাল, কাজল, শাহিন, ফেরদৌসসহ অনেকে একসাথে ২ ঘন্টার ফ্লাইটে প্যারিসে ফিরি। প্রায় ২৩ বছর পর আমার প্যারিসে আসা। সেই ১৯৯২ সালে ইতালী সফরের একপর্যায়ে আমি প্যারিস ভ্রমণ করি। এবার প্যারিস সফর করার একটি বিশেষ কারন ছিল সদ্য প্রয়াত ভাস্কর নভেরার স্মৃতিঘেরা বাড়ীটি দেখা এবং তার সমাধিতে পূস্পার্ঘ অর্পন করা। প্রায় ২৩ বছর আগে পৃথিবীখ্যাত আইফেল টাওয়ার, প্যারিস গেট (সঞ্জুলে) ল্যুভর মিউজিয়াম, ভার্সাই, মমার্তসহ অনেক স্থাপত্য দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম, তখন ছিল শীতকাল। আর এবার বসন্তে প্যারিস দেখা। বহু চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, দার্শনিক, লেখক, চিত্র পরিচালক, সঙ্গীতকার, স্থাপত্য শিল্পী এখানে বাস করেন। এছাড়া সীম নদীর তীরে রেস্তোরাঁ, নাইট ক্লাব, লুভ্যর মিউজিয়াম এবং শিল্প-সংস্কৃতির পাঠস্থান হিসেবে প্যারিসের খ্যাতি বিশ্বময়। এবার প্যারিসে কথা হয় প্রখ্যাত মুখাভিনেতা পার্থ প্রতীম মজুমদার, শিল্পী শাহাবদ্দিন আহমেদ তার স্ত্রী আনা ইসলামসহ অনেকের সঙ্গে। দেখা হয় শিল্পী তারুণ্য কাব্য কামরুল, আবৃত্তিকার রবিশংকর মৈত্রী, নির্মাতা মিঠু, ওবায়দুল, নোভা, ওয়াহীদ, দ্বীপসহ অনকের সঙ্গে। এছাড়া ইতালী প্রবাসী সাংবাদিক, নির্মাতা নাসিম সার্বক্ষণিকভাবে আমাকে সহযোগিতা করেছে। তবে কর্মব্যস্ততার মধ্যেও কাজী এনায়েত উলাহ আমাকে সব সময় সহযোগিতা করেছেন। অন্যদিকে স্বপন, কামাল সব
কজন চমৎকার মানুষের তত্ত¡াবধানে, অসাধারন একটি জায়গায় ছিলাম, একদম শহরের কেন্দ্রস্থলে, চমৎকার লোকেশন, অতিসহজে সবখানে চলাফেরা করা যায় অনায়াশে। আমি আগেই তার কথা উলেখ করেছি, তিনি প্রবাসী বন্ধু, প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কাজী এনায়েত উলাহ যিনি তার রেষ্টুরেন্ট ‘ক্যাফে ডি লুনার’ দোতালায় চমৎকার পরিবেশে আমার থাকার ব্যবস্থা করেন। নিচেই ‘ক্যাফে ডি লুনার’ বিভিন্ন স্বাদের, নানা ধরনের ইউরোপীয় খাবারের আয়োজন। আমার সঙ্গে ছিলেন ইতালীর সাংবাদিক নাসিম, যার সান্নিধ্য আমাকে মানসিক স্বস্থি দিয়েছে। অন্যদিকে ক্যাফে ডি লুনার কর্মরত, ফরিদ, সদরুল ভাই, ফ্রাস্কো ওয়াং, জন, হাসান এবং বিজয়ের আন্তরিকতাপূর্ণ আপ্যায়নের কথা আমার অনেকদিন মনে থাকবে। বিশেষ করে ফ্রাস্কো একদিন সন্ধ্যায় বিশ্ববিখ্যাত (ুমলফধভ ৗমলথণ) মোলারস ঐরটভঢ ওদমষ দেখার ব্যবস্থা করে। চোখ ধাঁধানো নাচ, গান, এ্যাক্রোবেটিক আর অবিশ্বাস্য সব পারফরমেন্স দেখে মুগ্ধ হই। মঞ্চের আলোয় উদ্ভাসিত সব নৃত্য শিল্পীদের দেখে এক স্বর্গীয় আনন্দে যেন সারা মিলনায়তন ভাসছিল। বলতে গেলে এটাই পর্যটকদের প্রধান স্থান। ঐ নির্জন রাতেও পর্যটকদের ভীড়। রাস্তার ওপরেই অনেক রেস্তোরাঁয় অনেক চেয়ার টেবিলে পর্যটক কফি নিয়ে বসে আছে। ক্যাফে ডি লুনাসহ অনেকগুলি রেস্তোরাঁয় তখনও অনেক গ্রাহকদের আনাগোনা। সামনের পার্কটায় বেঞ্চে তখনও অনেক পর্যটক। শুধু পার্কে নয়, গ্রীস্মে প্যারিসের অনেক রাস্তায় এখন পর্যটকদের ভীড়ে গিজগিজ করে। হাটতে গেলে গায়ে ধাক্কা লাগে। তবে কখনও কখনও জনবিরল পথে বসে থাকা কিংবা পার্কের বেঞ্চিটায় বসে পর্যটকদের চলাচল লক্ষ্য করা, রাস্তার ওপরেই অনেক রেস্তোরাঁয় চেয়ার টেবিল, সেখানে এককাপ কফি নিয়ে বসে থাকা, বসে বসে শুধু পথের নানা বর্ণের মানুষ দেখা। শুনেছি অনেক বেশী সংখ্যায় টুরিষ্টদের শুভাগমনে সরকার খুশি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের সুবিধা হয় বটে কিন্তু অভিজাত ফরাসী নাগরিকরা অনেক সময় নাক সিটকায়। টুরিষ্টদের অত্যাচার এড়াবার জন্য তারা এই সময় প্যারিস ছেড়ে চলে যায় বেড়াতে। তবে সে বিষয়টা এখন কমে এসেছে, তাছাড়া প্যারিসে ফরাসিদের অফিস-আদালতসহ ব্যস্ততা রয়েছে। এখন টুরিষ্টদের মধ্যে আমেরিকান, ইউরোপীয়দের সঙ্গে পালা দিয়ে জাপানী, চীনা, কোরিয়ানদের সংখা বেড়েছে। মাঝে মাঝে ভারতীয় ও বাংলাদেশীদের সঙ্গেও দেখা মেলে তবে অনেক কম। প্রবাসী বাংলাদেশীদের সঙ্গে দেখা হলে আন্তরিকতাপূর্ণভাবে শুভেচ্ছা বিনিময় করলে খুশী হয়। দেশের একজন শিল্পীকে কাছে পেয়ে, ছবি তোলে, এসব আমি বেশ উপভোগ করি। পথে পথে নানা দেশের নানা বর্ণের পর্যটকদের মধ্যে ফরাসিদের আলাদা করে চেনা যায়। বিশেষ করে অফিস ছুটির সময় ট্যুরিষ্টদের ছাপিয়ে যায় সাধারন ফরাসীদের ভীড়। তাদের চলার গতি, সাজ পোশাক, স্টাইল, আচরন দেখেই আলাদাভাবে চেনা যায়। টুরিষ্টদের মধ্যে অনেকের উগ্রতা লক্ষ্য করলেও, ফরাসীরা উগ্র সাজ পোশাক পরে না। তাদের সাধারণ প্রসাধনে আরও লাবণ্য হয় তাদের রূপ। সাধারন ফরাসী মেয়েরাও মুগ্ধ করে তাদের সাধারন সাজ পোশাকে। প্যারিসে ‘মমার্ত’ আর প্লাস পিগাল-এর মাঝখানে অসংখ্য ‘নাইট ক্লাব’ পিপ শো, লাইভ শো,
সিপি বেশী চলে। সালাদের চাহিদা বেশী। ফরাসীরা বাঙালীর মতোই আড্ডাবাজ, রসিক। বাগেত রুটি ছাড়াও সেখানে নানা ধরনের রুটি পাওয়া যায়। ফরাসীদের জনপ্রিয় ডিশ হলো রোষ্ট করা বিফ যার নাম স্টেক এবং ফ্রেঞ্চফ্রাই। প্যারিসের রুটিরও একটি মিউজিয়াম আছে। মাথা পিছু মদ্য পানের তালিকায় ফরাসীর স্থান পৃথিবীতে দ্বিতীয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার নেপোলিয়ান বোনা পার্টের নামে কোন রাস্তা নেই। নিজেদের রাষ্ট্র প্রধানদের নামে রাস্তা করতে ফরাসীদের রুচিতে বাধলেও অন্য দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের নামে রাস্তা করতে ফরাসীদের আপত্তি নেই। সেই জন্যে জর্জ ওয়াশিংটন, ফ্রাস্কলিন, রুজডেল্ট, চার্চিল, জেনারেল আইজেন হাওয়ার এমন কি মহাত্মা গান্ধীর নামেও রাস্তা আছে। প্যারিসের দর্শনীয় স্থান গুনে শেষ করা যাবে না। সিন নদীর তীরে রয়েছে নোটরডেম ক্যাথিড্র্যাল, যা প্যারিসের প্রধান আকর্ষন, রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত আইফেল টাওয়ার, নেপোলিয়ানের তৈরি আর্ক-দে ট্রায়াস্কদে এল এতোইল নামের বিখ্যাত বিজয় তোরন, রয়েছে লুক্সেমবুর্গ প্রাসাদ, তুলেরিস প্রাসাদের উদ্যান, ল্যুভর মিউজিয়াম,
মমার্তের মতো শিল্পীদের আড্ডা স্থল, পথের পাশে অসংখ্য কাফে, লং চ্যাম্প কোর্সের মতো বিখ্যাত ঘোড়দৌড়ের মাঠ। প্যারিসে প্রচুর বিদেশী শ্রমিক রয়েছে, এদের মধ্যে কালো ও আরবরা প্রধান। আরেকটি মজার ব্যাপার হচ্ছে প্যারিসের রাস্তায় সবাই সবার কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে খায়। প্যারিসের রাতের জগতের জন্য বিখ্যাত হচ্ছে ১৮নং আরোদিসাস অঞ্চল। এখানে রয়েছে অসংখ্য সিনে ক্লাব। ইউরোপে সাই ক্লিং করা যেমন নিরাপদ তেমনি মজার। ফরাসিরা সাইক্লিং খুবই পছন্দ করে। সাইক্লিং এর উৎপত্তি হয়েছে ফ্রান্স থেকেই। প্যারিসের সবচেয়ে উলেখযোগ্য হচ্ছে পাতাল রেল। কঐগ-তে না চড়লে প্যারিস ভ্রমণই বৃথা। বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত পাতাল রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে জাপান ও প্যারিসে। মেট্রো স্টেশনও বিশাল বড়। সারা শহর সাজানো গোছানো, বড় বড় অট্রালিকা আর স্থাপত্য শিল্প প্যারিসকে আকর্ষনীয় করে তুলেছে। সে কারনেই প্যারিসে অবস্থান করছে বিভিন্ন দেশের নামিদামী কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীরা। এ যেন মহাগুণীদের মিলিন কেন্দ্র। প্যারিসের আঞ্চলিক নাম প্যারি। আজ থেকে ২০০০ বছর আগে খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মাঝামাঝি উত্তর পশ্চিম ইউরোপের এই অঞ্চলে প্যারিসি নামের গণ উপজাতীয়দের একটি ছোট্টগ্রাম গড়ে ওঠে। তারও দু’শতক পর রোমানদের অধিকারে আসে এই অঞ্চল। সম্রাট জুলিয়াস সিজারের আদেশনুযায়ী এখানে গড়ে ওঠে নিউটেশিয়া নামের একটি রোমান উপনিবেশ। শহরটি জার্মান আক্রমনকারীদের হাতে ধ্বংস হয় তৃতীয় খৃস্টাব্দের গোড়ার দিকে। কিন্তু নিউটেশিয়ার নাম পরিবর্তিত হয়ে পারিসি নামনুসারে নাম হয় প্যারিস। সেই প্যারিসই আজ সারা পৃথিবীর শিল্পীদের তীর্থস্থান।
প্যারিসের পথে পথে: ফকির আলমগীর
- ভ্রমণ