ফুলের গন্ধে ফেব্রুয়ারি- আমজাদ হোসেন

বাবা যখন ফুলকে ঢাকায় আনে, তখন এই ঢাকা ছিল জমজমাট মফস্বল টাউনের মতো ছোট্ট একটি শহর। সন্ধ্যা হলেই অন্ধকার অলিগলিতে জোনাক জ্বলতো। অসংখ্য পাখির কিচির-মিচির ছিল সাত-সকালে। দুপুরবেলায় নওয়াবপুর, ইসলামপুরের ছাদে ছাদে বানর দৌড়াদৌড়ি করতো। শহরের উজ্জ্বলতা ছিল গুলিস্তান থেকে চকবাজার পর্যন্ত। তখন গ্রামে থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ আসতো গুলিস্তান সিনেমা হল দেখতে।
গুলিস্তানের এখান থেকেই শুরু হয়েছে নতুন শহর। ঢাকা স্টেডিয়ামের নির্মাণ কাজ কেবল শুরু হয়েছে। প্রায় একহাতের মতো ইটের গাঁথুনি উঠেছে গোল হয়ে। স্টেডিয়ামের পশ্চিমে মানে রাস্তার এপারে ছিল সুন্দর একটি আধুনিক রেস্টুরেন্ট। নাম ছিল ‘লাসানি’। তারপর ছিল ‘কসবা’ নামের একটি বার। ছোটখাটো কিন্তু দেখতে ছিল ঝকঝকা। ভিতরের বাতিগুলো সেট করেছিল ইউরোপীয় মেজাজে আধুনিক ঢঙে। আলো আঁধারে নির্জন-নিরিবিলি পরিবেশ। আর আজকের বায়তুল মোকাররম ছিল তখন দুর্গন্ধময় একটি পুকুর কিন্তু বেশ গভীর। প্রতিদিনই অসংখ্য ট্রাক বোঝাই করে আবর্জনা ফেলছে এই পুকুরে। খুব দ্রæতগতিতে এই পুকুর ভরাট করার কাজ চলছে। তখন সন্ধ্যার দিকে এই জায়গায় লোকজনের চলাফেরা ছিল খুব কম। বিজয়নগর-কাকরাইলের ওদিক থেকে শেয়ালের ডাক শোনা যেতো ঘন ঘন। গভীর গাঢ় আঁধারে হাজার হাজার জোনাকি উড়ে বেড়াতো। সদরঘাট থেকে বুড়িগঙ্গার বাতাস ছুটে আসতো হু হু করে। গুলিস্তান পর্যন্তই লোকজনের হৈ চৈ ছিল। এই স্টেডিয়ামের দিকে কেউ আসতো না সন্ধ্যার পরে। জোনাকজ্বলা অদ্ভুত এক আঁধার ঝিম ধরে থাকতো। বিষাক্ত সাপ- শেয়ালের ভয় ছিল সব সময়।
তখন আমরা থাকতাম এখনকার কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পশ্চিমে। ধানমন্ডিতে। চতুর্দিকেই জঙ্গল। অনেক দূরে দূরে দু’একটা বাড়ি হচ্ছে কেবল। এখানেও সন্ধ্যা হলে দল বেঁধে শেয়াল ডাকে। ঝিম ঝিম শব্দে জোনাকিরা জ্বলে আর নেভে সারা রাত। বিষাক্ত সাপের মুখে ব্যাঙের শব্দ শোনা যায় প্রতি রাতেই। সূর্য ডুবলেই মা আর ঘর থেকে বেরোয় না। ভয়ে থর থর করে কাঁপে। মাঝে মাঝেই কেঁদে ওঠে। আমরা তখন ছোট ছোট দুই ভাই দুই বোন। এই চারজনের মধ্যে আমি বড়। বাবার ফিরতে একটু দেরি হলেই, চারদিকের দরজা-জানালা সব বন্ধ করে, আমাদের কাছে কোলে নিয়ে বিছানায় বসে বসে কাঁদতে থাকে। বাবা বাড়ি ফিরলেই তার প্রথম কথা হলো,
আমি আর এই ঢাকা শহরে থাকবো না, কাল সকালের ট্রেনেই আমাকে জামালপুর পাঠিয়ে দ্যান।
এই একই কথা প্রতি রাতেই শুনতে হয় বাবাকে। বাবা মিট মিট করে হেসে একটু খোঁচা দিয়ে বলে,
আমার ছেলেমেয়েরা কোথায় থাকবে?
আমার সঙ্গে জামালপুরে।
জামালপুরে অন্ধকার নেই? সন্ধ্যায় ওখানে শেয়াল ডাকে না? ওখানেও তো সাপ ব্যাঙ ধরে খায়।
আমি জামালপুর শহরে থাকবো, আমলাপাড়ায়, আমাদের বাড়িতে।
আমার ছেলেমেয়েরা মানুষ হবে আমার শ্বশুরবাড়িতে? এমন কথা তুমি বললে কী করে? মা চুপ হয়ে যায়। তার দু’চোখের জল নিঃশব্দে বাড়তে থাকে। বাবা তা টের পায়। বাবা নিজেও বোঝে, এ রকম ভয়াবহ নির্জন জায়গায় ছেলেমেয়ে নিয়ে বসবাস করা যায় না। যে কোনো সময় বিপদ ঘটতে পারে। কিন্তু এই ধানমÐি এলাকার ভবিষ্যত খুব উজ্জ্বল। আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যেই সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর উঠবে। দেশের নামকরা মানুষজন এসে বসবাস করবে। মাত্র দশ হাজার টাকায় এক বিঘা জমি আর তখন পাওয়া যাবে না। নিজেও তখন এই টিনের ঘর বিল্ডিং বানাবো। এই এক বিঘা জায়গা নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন। ঝোপ-জঙ্গলের ভয়ে নিজের বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও গিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকা উচিত হবে না। নিজের জায়গা নিজের দখলে না থাকলে অনেক বিপদ। তারপরও বাবা কখনও নরম হতে চায় না মার সামনে। তার ভিতরে যে ভয় ঢুকেছে, এসব বৈষয়িক ব্যাপার সে বুঝবে না। বারান্দায় বসে হাত-মুখ পরিষ্কার করতে করতে আগের মতো খোঁচা দিয়ে বলে,
জামালপুর শহরটাও তো ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁসে দাঁড়িয়ে আছে, কখন যে ধসে পড়বে কে জানে, কী বিরাট নদী, সারা রাত সমুদ্রের মতো ডাকে। ভয়ে আমার ছেলেমেয়েরা কী ঘুমুতে পারবে ওখানে? কেউ যদি খেলতে গিয়ে ঐ নদীতে পড়ে যায়, তখন কী হবে?
তার কথার কোনো জবাব দেয় না মা। সন্ধ্যার আগেই ভাত-তরকারি শোবার ঘরে এনে রেখে দেয়। জামালপুর থেকে মা একটা মাটির চুলা এনেছে। যখন-তখন এ-ঘরে ও-ঘরে নেয়া যায়। ঐ চুলাতেই খাবার গরম করছে। আরও কিছু বাঁকা বাঁকা প্রশ্ন করে বাবা। মা আগের মতোই নীরব থাকে। খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়ে গেলেও মা আর কোনো কথা বলবে না। বাবার সামনে যখন পানের রেকাবি রাখে, তখন বাবা খুব সহানুভ‚তির স্বরে বলে,
কাল থেকে তোমার আর কোনো ভয় থাকবে না।
এই কথায় মা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে বাবার দিকে। মাথার ঘোমটা খসে পড়ে। হাতের চুড়ির কোনো শব্দ হয় না। চোখের পলক পড়ে না। বাবার মুখের এই কথা শুনে যেন মা মাটির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। বাবা পান চিবোতে চিবোতে মুখে একটু চুন চেটে বলে,
ফুলমিয়া আসবে, ফুলমিয়া। তাকে আনতে লোক গেছে। কাল সকালের ট্রেনেই চলে আসবে। তুমগো দেশের মানুষ। ফুলমিয়ারে দ্যাখ্যো নাই।
এইবার মা একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, মাথার ঘোমটা ঠিকঠাক করতে করতে বলে,
দেখছি। বয়স কম অইলে কি কি অইবো। ফুলমিয়ার খুব সাহস আছে। শুনছি গাছে উইঠ্যা সাপ ধরে। একটানে সাপের মাথা ছিঁড়া ফ্যালায়? আমগো এলাকায় মইষ যখন রাগে বাড়িঘর ভাঙে, ভয়ে লোকজন দৌড়াদৌড়ি করতে থাকে। ফুলমিয়া নাকি মন্ত্র জানে। ঐ পাগলা মইষের সামনে ফুলমিয়া খাড়াইলেই মইষ নাকি থাইম্যা যায়। ফুলমিয়া ঐ মইষের ঘাড়ে-গর্দানে আদর করে, চুমা খায়। মইষের রাগ তখন পানি অইয়া যায়।
অমি তো আরও শুনছি। তোমাদের ব্রহ্মপুত্র নদীতে কুমির আছে বড় বড়। ফুলমিয়া নাকি একদিন কুমিরের মুখ থেকে মাছ ধরে এনেছে। আমি তখনও ঘুমাইনি। ফুলমিয়ার কথা শুনছি। যে মানুষ কুমিরের মুখ থেকে মাছ ধরে আনে, সেই মানুষ আসবে আমাদের বাড়িতে? এই বাড়িতে একটা কাক আছে, আমাকে দেখতেই পারে না। আমার হাতে কোনো খাবার থাকলেই ছোঁ মেরে নিয়ে যায়। কাল সকালে ফুলমিয়া আসলেই আমি তাকে বলবো, কাকটাকে ধরে ওর পাখনা ছিঁড়ে ওকে যেন পচা ড্রেনের মধ্যে ফেলে দেয়।
বাবা আরেকটু জর্দা মুখে দিয়ে বললো,
তোমাদের জামালপুর শহরের মানুষ তো খুব আইলস্যা ধরনের। সহজেই কাজকর্ম করতে চায় না। সেই জন্যে শহরটার কোনো উন্নতিও নাই। কোর্টকাচারি, স্কুল-কলেজ, সিনেমা হল আছে বলে এক দল ঘরেরটা খায় আর খুব ফুটানি করে ঘুরে বেড়ায়। আরেক দল না খাইয়া থাকে সারা বছরই। ফুলমিয়ার মতো মানুষও কোনো কিছু করতে পারছে না। বাপতো মারা গেছে ফুলমিয়া যখন ছয়-সাত বছরের। আছে এক মা। সেই মা নাকি ফুলমিয়ারে বিদেশ বিভ‚ঁইয়ে পাঠাতে চায় না। কাঁদে। সে মনে করে ঢাকার শহর নাকি অনেক দূরের দেশ। সেখানে তার ফুলমিয়া থাকতে পারবে না। মরে যাবে। অনেক কষ্টে তাকে রাজি করানো হয়েছে।
অসংখ্য পাখির কিচিরমিচির শব্দে আমাদের ঘুম ভাঙ্গে। ঘুম থেকে উঠেই ভোরের বাতাসে ফুলের গন্ধ পাই। রোদ ওঠে আরও পরে। তার আগেই শয়তান কাকটা বসে থাকে শোবার ঘরের চালে। আমার সঙ্গে মুখোমুখি হলেই কা কা করে ওঠে। রাগে আমি ঢিল ছুঁড়ে মারি। কাকটা তবু বেহায়ার মতো ওখানেই বসে থাকে। আমি যখন ভাবছি, ফুলমিয়া আসুক তোমার পাখনা ছিঁড়ে ফেলবে। আর ঠিক তক্ষুণি ফুলমিয়া এসে দাঁড়ালো আমাদের উঠোনে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে হাফশার্ট। হাতে একটি রংচটা টিনের সুটকেস। পায়ে জলকাদায় নষ্ট হয়ে যাওযা পুরানা স্যান্ডেল। রাতে যা শুনেছি তাতে মনে হয়েছে মানুষটা হবে গাট্টগোট্টা। কালো চকচকে। গোঁয়ার। হাত-পা-শরীর খুব শক্ত। মজবুত। বুকটা হবে খুব চওড়া। ব্যায়াম করা মানুষের মতো হবে হাত-পায়ের পেশী। কিন্তু এখন দেখছি তা উল্টো। ফর্সা মতো ম্যানম্যানে একটা মানুষ। মাথার চুল ছোটো ছোটো। মাঝারি ধরনের উঁচু। ঢিবঢিবে বুক। দু’চোখ বোঝাই ভয়-ভীতি। কথা বলতে গেলেই গলার স্বর কাঁপে। সব সময় মাথা নিচু করে থাকে। বড় বেশি অমিল দেখে এক দৌড়ে বাবার কাছে গিয়ে কানে কানে ফিসফিস করে বললাম,
এটা তো মানুষ না বাবা, আমার চাইতে বড় একটা ছেলে?
বাবা খুব বিস্ময় নিয়ে আমরা দিকে মুখ ফেরালো।
আমি আবারও জিজ্ঞেস করলাম,
এই ছেলেটাই কুমিরের মুখ থেকে মাছ কেড়ে এনেছে?
হ্যাঁ, কেন? তোর বিশ্বাস হচ্ছে না?
আমি খুব বিরক্তভাবে মাথা নাড়লাম। বাবা আমাকে আদর করার ভঙ্গিতে বললো, হাজার মানুষ দেখেছে। কত রকম গাড়ি- ঘোড়া। চতুর্দিকেই অচেনা-অজানা মানুষ। ধাক্কাধাক্কি, হৈ চৈ। এসব দেখে ও খুব ভয় পেয়েছে। দু’চার দিন থাকুক। রাস্তাঘাট চিনুক। তারপর টের পাবি ওর কী সাহস।
বাবা আদর করে ডাকলো, ফুল। মা ওকে ঘরের ভেতরে পেট ভরে খাওয়াতে চাইলো, কিন্তু লজ্জায় বেশি খেতে পারলো না। কেমন যেন মনমরা হয়ে বসে আছে বারান্দায়। ফ্যাল ফ্যাল করে চারদিক দেখছে। আমি আস্তে আস্তে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে যেন দেখেও দেখলো না। আমি নিজেই বললাম,
আমার নাম কি জানেন? খোকা! আপনার নাম?
খুব আমতা আমতা করে বললো,
ফুলমিয়া।
বাড়ি কোথায়?
জামালপুর টাউনেই।
আমার একটা উপকার করবেন?
সে খুব মনমরাভাবেই উত্তর দিচ্ছে,
কী উপকার?
বাইরে আসেন।
আমার কথা মতো সে উঠোনে এসেই দাঁড়ালো। শয়তান কাকটা তখনও শোবার ঘরের চালে বসে আছে। আমার সব কথা শুনে কাকটাকে দেখলো সে। কাকটার দিকে চোখ রেখেই বললো,
একটা পাটকেল দিতে পারবা আমারে?
পাটকেল মানে?
শক্ত একটা ঢেল দেও আমার হাতে।
খোঁজাখুঁজি করে একটা পাথরের ঢিল এনে দিলাম তার হাতে। সে কোনো রকম নড়াচড়া করছে না। শুধু কাকটার দিকেই তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে শয়তান কাকটাও মাঝে মাঝে কা কা করে উঠছে। হঠাৎ সে কাকটাকে ঢিল মারলো। এক ঢিলেই কাকটা টিনের চাল থেকে উঠোনে এসে পড়লো। কাকের মাথাটা থেঁতলে গেছে। একটু কেঁপে উঠেই মারা গেলো। কাকটাকে ফুলমিয়াই দূরের জঙ্গলে ফেলে দিয়ে আসলো। কাক তো পাখিই। কাকের মৃত্যু দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে। কিন্তু ফুলমিয়ার কোনো অনুশোচনা নেই। মা খুব সাপের ভয় পায় বলে সে বাড়ির ঝোপঝাড় জঙ্গল পরিষ্কার করতে লাগলো।
খায় দায় ঘুমায়। অমানুষিক পরিশ্রমও করে সারা দিন। কিন্তু তার মন খারাপ থাকে সব সময়। কখনো হাসে না। কারো কাছে কোনো কিছু চায় না। রাত হলেই চুপ চুপ করে কাঁদে। মায়ের কথা মনে পড়ে। মা একদিন টের পেয়ে বললো,
তোর মায়ের কথা মনে পড়ে?
হ্যাঁ, আমি আর এইখানে থাকুম না। জামালপুর যামু।
ওখানে গেলেই তো না খেয়ে থাকবি? আমরা মাসে মাসে টাকা পাঠাচ্ছি, তোর মা ভালই আছে। তোর মা বলেছে, এখানে থাকলে তুই মানুষ হতে পারবি?
মিছা কথা।
এই বলেই মার সামনে থেকে চলে গিয়েছে ফুলমিয়া। রাতভর অন্ধকারে ঘোরাঘুরি করে আবার সকাল বেলাতেই সংসারের কাজকর্ম শুরু করেছে। রোদ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কাচা মরিচ পেঁয়াজ দিয়ে পান্তাভাত খায় প্রচুর। এটা তার প্রিয় খাবার। পাউরুটি ডিম পরোটা ভাজি এসব সে খেতে চায় না।
ফুলমিয়া আসার পর থেকেই মা আর ভয় পায় না। অন্ধকারেও এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যেতে পা কাঁপে না। শেয়াল ডাকলেই ফুলমিয়া তার মুখ দিয়ে অদ্ভুত এক শব্দ করে। শেয়ারের ডাক থেমে যায়। সাপের শব্দ টের পায়। এই বাড়িতে এসে অনেক বড় বড় সাপ মেরেছে অন্ধকারে। দুপুরে কখনই বাবা বাড়ি ফেরে না। সেই দিন হঠাৎ দুপুরে এসেই ডাকলো, ফুল।
কুড়াল দিয়ে গাছ কাটছিল ফুলমিয়া। ডাক শুনেই বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। বাবার হাতে একটা টেলিগ্রাম। তিনি একটু চুপ থেকে হঠাৎ কাঁপা গলায় বললো, ফুল, তোকে এক্ষুনি জামালপুর যেতে হবে। ফুলমিয়ার যেন সব জানাই ছিল। একদম আবেগ বর্জিত কণ্ঠে বললো,
মায়ের খুব অসুখ, কোন ট্রেনে যামু?
এখন তো আর ট্রেন নেই। রাতের ট্রেনেই যেতে হবে।
এতক্ষণ কী টিকবো খালু?
বাবা খুব রেগে গেলো।
বাজে কথা বলিসনে। টাকা-পয়সা দিয়ে দিচ্ছি। ভালো ডাক্তার দেখাবি। একটু সুস্থ হলেই চলে আসবি, কেমন?
হে আর সুস্থ অইবো না। আমারে যেদিন থাইক্যা ঢাকায় পাঠাইছে, হেইদিন থাইক্যাই অসুস্থ, এইডা ভালো হওয়ার অসুখ না।
ওর কথাবার্তা শুনে বাবা মা দু’জনেই থ। ফুলকে পাষাণের মতো লাগছে।
কয়েকদিন পরেই ফিরে এলো ফুলমিয়া। সে জামালপুরে পৌঁছানোর আগে তার মা মারা গেছে। সে গিয়ে পেয়েছে শুধু বরফের মতো ঠাÐা একটা শরীর। চোখ বুজে আছে। হাত-পা শক্ত। সে এসেই বাবাকে বললো,
টাকাগুলো রাখেন। কাফন সাবান বাঁশ কর্পূর কিনতে কিছু খরচ অইছে। ডাক্তার দেহাবারই সুযোগ পাই নাই, এত টেকা খরচ করমু ক্যামনে?
ওর কতা শুনে মা কেঁদে ফেলেছে, কিন্তু ফুলমিয়ার চোখে জল নেই।
ফুলমিয়া আর কোনো দিন বলেনি, আমি বাড়ি যাবো। এই বাড়িই সে নিজের বাড়ি মনে করে থাকে। মাঝে মধ্যে আমাদেরকেও ধমক দেয়। ধানমÐি এখন অভিজাত এলাকা। সুন্দর সুন্দর বাড়িঘর উঠেছে। গ্যারেজে গ্যারেজে টয়োটা কোম্পানির গাড়ি। বাড়ি বাড়ি ফুলের বাগান। সন্ধ্যা হলেই এখন আর শেয়াল ডাকে না। যখন তখন সাপ দেখা যা না রাস্তাঘাটে। ইলেকট্রিকের বাতি সারা রাত ঝলমল করে ।
বাজারহাট থেকে শুরু করে সংসারের সব কিছুই ফুলমিয়ার হাতে। তেল চুরি করেছে বলে গাড়ির ড্রাইভারকেও এখন ফুলমিয়া ধমকায়। সন্ধ্যার আগেই খেলার মাঠ থেকে ধরে আনে আমাকে। ছোটদেরকে স্কুলে পৌঁছায়। পরীক্ষার হলে টিফিন নিয়ে যায়।
ভাষা আন্দোলনের সময় বাবা ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ১৪৪ ধারা যারা ভঙ্গ করেছে, বাবাও তাদের একজন। বাবা তখন বিবাহিত ছিলেন। অনার্স ফাইনাল দিয়েই ধানমÐির এই জায়গা কিনেছিলেন। আমার দাদুই টাকা দিয়েছিলেন এই জমি কেনার জন্য। ফেব্রæয়ারি। শোক মিছিল। শহীদ মিনার। বাবার আত্মার সঙ্গে এ সবের যোগাযোগ। ফেব্রæয়ারি মাসে বাবার হৃদয়টাই থাকে শহীদ মিনারের মতো।
সবাই তখন শহীদ মিনারে যেতো, ভয়ে ভয়ে খালি পায়ে। পুলিশের দৃষ্টির আড়ালে। সারা রাত বাড়ি বাড়ি থেকে সবাই ফুল যোগাড় করতো। একুশে ফেব্রæয়ারি সকালে সেই ফুল নিয়ে যেতো শহীদ মিনারে। আজিমপুর গোরস্থানে। আমাদের ফুল যোগাড় করতো ফুলমিয়া। নিশাচর প্রাণীর মতো সারা রাত এ-বাড়ি ও-বাড়ি বাগানে ঢুকতো আর টাটকা সুগন্ধি ফুল চুরি করে আনতো।
বাবা সারা রাত জেগে থাকতেন। একা একাই ভালো ভালো কবিতা আবৃত্তি করতেন। মসজিদের মাইকে ফজরের আজানের ধ্বনি শোনার সঙ্গে সঙ্গেই খালি পায়ে ফুল নিয়ে বেরিয়ে যেতেন শহীদ মিনারের দিকে।
একবার হলো কী, রাত শেষ হয়ে যাচ্ছে, বাবা বেরিয়ে যাবে বলে খালি পায়ে অপেক্ষা করছে, কিন্তু ফুলমিয়া আর ফুল নিয়ে আসছে না। বাবা খুব রেগে যাচ্ছে। ফর্সা হয়ে যাচ্ছে চতুর্দিক। ফুল কোথায়? ওর খবর কী? রাগে থর থর করে কাঁপছে। লাল হয়ে যাচ্ছে মুখ। ফুলকে এখন সামনে পেলে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। এই রকম গনগনে মেজাজ নিয়ে সে পায়চারী করছে। পাখিদের কিচিরমিচির শুরু হলো। রোদ উঠে গেলো। অনেকেই ফিরে এলো শহীদ মিনার থেকে। এই প্রথম শহীদ মিনারে যেতে পারলো না বাবা। হঠাৎ খবর এলো, রক্তাক্ত অবস্থায় ফুলমিয়া রাস্তায় পড়ে আছে। পাগলের মতো দৌড়ে গেল বাবা। সঙ্গে সঙ্গে আমরাও। রক্তে ফুলমিয়ার জামাকাপড় সব ভিজা। মাথা ফেটে গেছে। নাক দিয়ে কান দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। এত রক্ত দেখে মার মাথা ঘুরে গেলো। মাকে নিয়ে আমরা বাসায় ফিরে এলাম। ফুলমিয়াকে নিয়ে বাবা এবং আরও কয়েকজন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতলের দিকে রওয়ানা দিলো। হাসপাতালে পর্যন্ত যেতে পারেনি, রাস্তাতেই মারা গেছে ফুলমিয়া।
পরে শুনেছি, কারা যেন সত্যি সত্যি চোর মনে করে খুব মারধর করেছে ফুলমিয়াকে। তারপর অবস্থা খুব খারাপ দেখে রাস্তায় ফেলে রেখে গেছে।
মা নেই। মারা গেছে অনেক আগেই। আমরা সব বড় হয়েছি। আমার ছোটো দু বোন কানাডায় সেটেল্ড। ছোট ভাই আমেরিকায়। নিউইয়র্কে। শুধু আমিই আছি বাবার কাছে। এই ধানমÐির বাড়িতে। বয়স হয়েছে। বাবা সব সময় অসুস্থ থাকে। বাড়ি থেকে বের হয় না কখনো। সবচাইতে অসুবিধা হচ্ছে তিনি এখন কিছুই দেখতে পান না। প্রায় অন্ধ। লন্ডন, নিউইয়র্কে চিকিৎসা করেও কোনো লাভ হয়নি। তিনি এখন গলার আওয়াজ আর শরীরের গন্ধ পেয়ে মানুষ চেনার চেষ্টা করেন।
কে? বৌমা?
আমার পায়ের শব্দ পেলেই বলেÑ
কেরে খোকা? খোকা, এটা কী ফেব্রæয়ারি?
জ্বি।
চতুর্দিকেই খুব ফুল ফুটেছে নারে?
এক্ষুণি ফুলের কথা ভেবে বাবা খুব অতীতে চলে যাবে। থোকা থোকা বিষণœতার ভেতরে ডুবে যাবে তার হৃদয়।

  • গল্প