জলের গানের রাহুল!

রেজানুর রহমান :  জলের গানের রাহুল আসলে একজন তুখোর অভিনেতাও। মঞ্চে গান গাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে এমন সব কান্ড করেন একবারও মনে হয় না অভিনয় করছেন। যেন বাস্তবেই সব কিছু ঘটছে। এইতো সেদিন গ্রæপ থিয়েটার ডে পালন উপলক্ষে গ্রæপ থিয়েটার ফেডারেশান আয়োজিত এক আনন্দ অনুষ্ঠানে জলের গানের সদস্যদের নিয়ে শিল্পকলা একাডেমিতে হাজির হয়েছিলেন রাহুল। গায়ক হিসেবে তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো মঞ্চে গানের ফাঁকে ফাঁকে দর্শকদের সাথে প্রচুর কথা বলেন। মঞ্চে জলের গান পারফরম করবে আর দর্শকেরা চুপ করে গান শুনবে এমন ঘটনা কখনও ঘটে না। বরং জলের গানের অনুষ্ঠানে কখনও কখনও দর্শকই হয়ে ওঠেন পারফরমার। আর শিল্পীরা হয়ে যান শ্রোতা।
গ্রæপ থিয়েটার ফেডারেশানের অনুষ্ঠানে রাহুলের নেতৃত্বে জলের গান মঞ্চে উঠেছে গান গাইতে। গানের ফাঁকে ফাঁকে যথারীতি দর্শকের সাথে কথপোকথন শুরু হয়েছে। এক পর্যায়ে ফেডারেশানের দুই প্রধান কর্মকর্তা লিয়াকত আলী লাকী ও কামাল বায়েজীদ মঞ্চে উঠে এলেন এবং শিল্পীদের সাথে গাইলেনও। অনুষ্ঠান চলছে। হঠাৎ রাহুলের হাতে দেখা গেল একটি মদের বোতল। মঞ্চের সামনে কাপড়ে ঢাকা ছিল বোতলটি। গান গাওয়ার এক ফাঁকে বোতলটি হাতে তুলে নেন রাহুল। দর্শক সারীতে শুরু হয় মৃদু গুঞ্জন, ফিসফাস… রাহুল কি মদ খেতে খেতেই মঞ্চে গান গাইবেন। রাহুলের হাতে মদের বোতল দেখে মঞ্চে পারফরম করতে থাকা জলের গানের একজন কর্মী রাহুলকে সতর্ক বানী শোনায়Ñ ভাই, প্রকাশ্যে এই কাজটা কইরেন না? রাহুল অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেÑ কোন কাজ? তুই কি বলতেছিস?
জলের গানের কর্মী ইশারায় বোতলটি দেখিয়ে বলে, ঐ যে বোতল…
বোতল তো কি হয়েছে?
এই ভাবে প্রকাশ্যে খুইলেন না… নানা জনে নানা কথা ভাববে… জলের গানের বদনাম হবে… রাহুল বুঝতে না পেরে বোতলের সিপি খুলতে খুলতেই প্রশ্ন করেÑ আরে ভাই কি বলতে চাস খোলাখুলি বল না? বোতল নিয়ে কি হয়েছে? কেন জলের গানের বদনাম হবে?
জলের গানের কর্মী আবার সতর্ক করার ভঙ্গিতে বলে, সবাই দেখতেছে… বোতলটা রাখেন… আসেন আমরা গান করি…
রাহুল গুরুত্বহীন ভঙ্গিতেই বলতে থাকে গান তো করবই… এখানে বোতলের তো কোনো সমস্যা দেখিনা।
আবারও প্রতিবাদ জানায় জলের গানের ওই কর্মী। কিন্তু রাহুল নাছোড়বান্দা। সে প্রকাশ্য মঞ্চে মদের বোতলটি বের করে। ছিপি খোলে। দর্শক সারীতে ফিসফাঁস বেড়ে যায়। হঠাৎ দৃশ্যপট বদলে যায়। বোতল থেকে ভেসে আসে অপূর্ব একটি সুর। বোতলের মুখে ঠোঁট লাগিয়ে সুরের অপূর্ব এক লহরী সৃষ্টি করেন রাহুল। কেউ ভাবতেই পারেনি মদের বোতল থেকে মদ বের না হয়ে এমন প্রাণ কাড়া সুর বের হবে। অবশ্য এটা রাহুলের পক্ষেই সম্ভব। টানা পাঁচ মিনিট বোতলের মুখে ঠোঁট লাগিয়ে গানের নতুন সুর বাজান জলের গানের বিস্ময় রাহুল। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার বিরাট দর্শক সারীতে রাহুলকে নিয়ে তখন আনন্দ আর হর্ষধ্বনিই চলছিল। অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম একজন শিল্পীর বিস্ময় ছড়ানো সঙ্গীত দক্ষতা। অপরূপ! অপূর্ব!
গ্রæপ থিয়েটার ফেডারেশানের অনুষ্ঠানটি হয়েছে সন্ধ্যায়। ঐদিন দুপুরে আনন্দ আলো কার্যালয়ে এসেছিলেন জলের গানের রাহুল। চ্যানেল আই-এর তারকা কথন অনুষ্ঠানে অতিথি ছিলেন। সরাসরি অনুষ্ঠানটি শেষ হতেই তাকে ফোন করি।
রাহুল কেমন আছো? চ্যানেল আইতে তোমার অনুষ্ঠান দেখলাম।
ফোনেই স্বভাবসুলভ হাসি ছড়াল রাহুল। জ্বি ভাই আপনার দোয়া…
রাহুলকে অনেকদিন ধরেই চিনি। তবে সেই অর্থে তার সাথে সে রকম যোগাযোগ নাই। রাহুল গান করে। মঞ্চে অভিনয়ও করে। টিভি নাটকেরও তুখোর অভিনেতা। দিনে দিনে আমি তার ভক্ত হয়ে যাই। বিশেষ করে জলের গানের নান্দনিক পরিবেশনাই আমাকে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে। দেশীয় বাদ্য যন্ত্রের ব্যবহার করে কী এক মায়া ছড়িয়ে ওরা গান করে। আহা! জলের গান মানেই মমতা মাখানো সুরের আলিঙ্গন। যতই শুনি ততই মুগ্ধ হই। ফোনেই রাহুলকে বললাম, আসো না একবার আনন্দ আলো অফিসে। দু’জনে কথা বলি।
দেরী না করে রাহুল চলে এলো আমাদের আনন্দ আলো অফিসে। হাসছে মিটিমিটি! এটাই বোধকরি রাহুলের স্বভাবগত বৈশিষ্ট্য। সারাক্ষণ হাসে। আমাদের দু’জনের আড্ডা শুরু হয়ে গেল!

কথা হলো প্রায় ত্রিশ মিনিট। অনেক কথা। কি ভাবে সঙ্গীতে এলেন? সঙ্গীত জীবনের কয়েকটি উল্লেকযোগ্য ঘটনা বলেন। গান আসলে আপনার কাছে কি? কেন গান করেন এই জাতীয় সাধারণ প্রশ্ন করেই যাচ্ছিলাম। হঠাৎ বাদ্যযন্ত্র বিষয়ক এক প্রশ্নের উত্তর শুনে অন্যরকম এক আবেগ ছুঁয়ে গেল মনের ভেতর। জলের গানের শিল্পীরা তাদের গানে যে সব বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে সেগুলোর প্রত্যেকটিই তাদের নিজেদের তৈরি। রাহুল বিশেষ একটি বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে। যন্ত্রটির নাম দিয়েছে মমতা। মায়ের নামে বাদ্যযন্ত্রের নাম। বাদ্যযন্ত্রটি নিজেই বানিয়েছে রাহুল। যখন সে এটি বানানো শুরু করেন তখন এক পর্যায়ে তার মা বাধ্যক্যজনিত কারণে অসুস্থ হয়ে যান। মাঝ পথে রাহুলের মা না ফেরার দেশে চলে যান। তখন একটু যেনো দিশেহারা হয়ে পড়েছিল রাহুল। বাদ্যযন্ত্রটি বানিয়ে দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখে। প্রতিদিন যন্ত্রটি দেখে আর মায়ের কথা ভাবেন। হঠাৎ যন্ত্রটিকে মায়ের মতো মনে হয়। বুকে টেনে নেয় বাদ্য যন্ত্রটি। মমতাময়ী মায়ের নামে নাম দেয় মমতা।
প্রসঙ্গ ক্রমে রাহুল জানাল, জলের গানের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো আমরা যা বাজাই তার সব কিছুই আমাদের নিজেদের তৈরি। প্রতিটি বাদ্যযন্ত্রই আমাদের কাছে মমতাময়ী মায়ের মতোই। যখন সুর তুলি তখন মনে হয় মায়েরাই আশির্বাদের হাত রেখেছেন আমাদের মাথায়। আহ! কী শান্তি।
একথা সকলেই মানবেন জলের গান মানেই শান্তিরও গান। সাধারনত ব্যান্ড ঘরানার গানে এক ধরনের হই চই করার প্রবনতা থাকে। ফলে অনেক সময় গানের বানী বোঝা যায় না। কিন্তু জলের গান এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম।
প্রথাগত সাক্ষাৎকার বলতে যা বুঝায় তাই অনুসরণ করা হয়েছিল রাহুলের ক্ষেত্রেও। আপনার কি পছন্দ? আপনার বন্ধু কারা? বন্ধুত্ব টিকে থাকে কিসে? অবসরে আপনি কি করেন? এমন প্রশ্নও ছিল। প্রতিটি প্রশ্নের স্বচ্ছন্দ উত্তরও দিয়েছে রাহুল। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হলো রাহুলকে আনুষ্ঠানিকতার মাঝে ফেলা ঠিক হবে না। ওর সাক্ষাৎকারটা একটু ব্যতিক্রমই হোক। যেমন সাক্ষাৎকারের এক পর্যায়ে রাহুল দেশীয় বাদ্যযন্ত্রের প্রসঙ্গ তুলে বলেছিল, আমরা আমাদের চারপাশে পড়ে থাকা অনেক কিছুই বাদ্যযন্ত্রে সংযুক্ত করেছি। আজ গ্রæপ থিয়েটার ফেডারেশানের অনুষ্ঠানে নতুন একটি চমক দেখাব ভাবছি। মদের বোতলটাই ছিল চমক। কেউ দুধ বেঁচে মদ খায়। আবার কেউ মদ বেঁচে দুধ খায়। সেদিন মদের বোতলে সুর তুলে রাহুল অন্যরকম এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছে।
শিল্পী রাহুল ও তার গানের দল জলের গানের প্রতি রইল আনন্দ আলোর পক্ষ থেকে অনেক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। শেষে একটা অনুরোধ করতে চাই। জলের গান’এর গান দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে দেওয়া জরুরি। তাহলে আমাদের বাংলা গান আরও বেশি সমাদৃত হবে। আমাদের বাংলা গানের ঐতিহ্য আরও বেশী ছড়িয়ে যাবে।
জলের গানের জয় হোক।

  • এক্সক্লুসিভ